শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

চামড়া শিল্পের সঙ্কট কবে দূর হবে

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৩ এএম

প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময় এলে চামড়া শিল্প নিয়ে নানা কথা, মন্তব্য, সমস্যাসহ এ শিল্পের নানা দিক নিয়ে পত্রপত্রিকা, মিডিয়া এবং টকশোতে আলোচনা হয়। আশির দশক থেকেই চামড়া শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও এই শিল্পকে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আশা যায়নি। অথচ, পোশাক খাতের প্রতি নজর বেশি থাকায় এ খাত অনেক দূর এগিয়েছে। চামড়া নিয়ে ঐ রকম কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কোরবানির ঈদে চামড়া নিয়ে প্রায় সময় তেলেসমাতি কান্ড ঘটে থাকে। নানা সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। চামড়ার দর সঠিকভাবে পাওয়া যায় না, চামড়ার মূল সুবিধাভোগী গরিব, অসহায় মানুষ, এতিমখানাসহ এমনকি ফড়িয়া, ব্যাপারী ও আড়তদাররাও চামড়ার ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয় এখন মাত্র ২০০-৩০০ টাকায়। এক সময়ে যে চামড়া বিক্রি হতো ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকায়। অনেক সময় কোরবানির পশুর চামড়া ক্রেতার অভাবে, ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে নদীতে ফেলে দেওয়া, মাটিতে পুঁেত ফেলার ঘটনাও ঘটে থাকে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি বছর চামড়া পাচার হচ্ছে। কারণ, আমাদের দেশের তুলনায় ভারতে চামড়ার দাম বেশি। আমাদের দেশের চামড়ার দাম ভারতের বাজার থেকে বেশি নির্ধারণ করা এবং দেশীয় বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, চাহিদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করলে চামড়া পাচার ও রোধ করা সম্ভব।

বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে চামড়া শিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার (সিইটিপি), ডি ওয়াটারিং ইউনিট, পাম্প, জেনারেটর ও ল্যাবের কাজ এখনো শেষ হয় নাই। সিইটিপি কার্যকর না থাকায় সব বর্জ্য গিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে পড়ে। ফলে দূষণের কারণে ধলেশ্বরী নদীও এখন হুমকির মুখে। চামড়া শিল্পনগরে বর্জ্য ও পানি আলাদা করতে ডি ওয়াটারিং ইউনিট আছে ৯টি। তার মধ্যে তিনটি ইউনিটই অকার্যকর রয়েছে। ফলে চামড়া শিল্পনগরের বেহাল দশায় কারখানার মালিক, শ্রমিক, আড়তদার ও ব্যাপারীসহ সবার নানা সমস্যার মধ্যে পরিবেশ দূষণেও ভয়াবহ রূপ দেখা দিচ্ছে। অপ্রস্তুত চামড়া শিল্প নগরীতে কঠিন বর্জ্য (সলিড ওয়েস্ট) ব্যবস্থাপনা এবং ক্রোম রিকভারি ইউনিটের কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। সিইটিপির কাজ শেষ না করেই চীনা ঠিকাদার চলে গেছে। এ শিল্প নগরীকে উন্নতকরতে হলে অবকাঠামো আধুনিকরন করতে হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চামড়া শিল্পের শিল্প সমাধানের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। কারণ, প্রায় দুই দশকেও এই শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পওয়া যায়নি এখনো। তাই, ইউরোপ আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকদের নিকট সরাসরি চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ভালো ক্রেতাদের নিকট বিক্রি করতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে এ খাতের রপ্তানি কমতির দিকে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির ছিল ১২৩ কোটি ডলারেরও বেশি। ২০১৭-২০১৮ তে তা ১০৮ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ১০২ কোটি ডলারে নেমে আসে। কোভিডের কারণে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে এই খাতের রপ্তানি কাংখিত মানের হয়নি। তবে এ খাতের ঘুরে দাঁড়ানো এখনো অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, চামড়া খাতে প্রত্যেক্ষভাবে প্রায় ৬ লাখ এবং পরোক্ষভাবে আরো ৩ লাখ মানুষ জড়িত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট রপ্তানির মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ। জুতা বাজারেও চামড়া শিল্পের বিরাট অবদান রয়েছে। চামড়া ও চামড়া বিহীন প্রধানত ২ ধরনের জুতা তৈরি হয় দেশে। এতে আমাদের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের রপ্তানি হয়েছিল ৭৮ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের রপ্তানি হয় ৮০.৯৬ কোটি, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৮৭.৯৩ কোটি ডলার ও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের ৭৫.০৫ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর যা রপ্তানি হয় তার মধ্যে চামড়ার তৈরি জুতাই ৮৫ শতাংশ। অবশিষ্ট অংশ সিনথেটিকসহ অন্যান্য পণ্যের। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপ্রোটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) সূত্রে জানা যায়, বিশ্বে জুতার মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ চীনের দখলে। বিশ্বে জুতার বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের এখাতে অবদান মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। সাভারের চামড়া শিল্প নগরী যদি পরিবেশবান্ধব ও কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য শোধানগারের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে তবে জুতা রপ্তানি ৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে প্রায় ৯০টি দেশে বাংলাদেশের জুতা রপ্তানি হচ্ছে।বিশ্ব বাজারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বা জুতা রপ্তানিতে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাভারের শিল্পনগরীকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তৈরি করা। সিইটিপির আধুনিকরণ করা। সাথে সাথে বিশ্ব বাজারের সাথে মিলিয়ে মূল্য প্রতিযোগিতামূলক করা। চামড়া শিল্প পিছিয়ে পড়ার আর একটি কারণ হলো, দেশি বাজারে নতুন কোনো ব্রান্ড, কোম্পানির প্রতিযোগিতা কম। কমপ্লায়েন্সের অভাব, পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে জটিলতা। পরিবেশবান্ধব চামড়া ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও ডেভেলপমেন্টমূলক কাজ না থাকা। তাছাড়া মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে আচরণগত ও সুযোগ-সুবিধার জন্য দূরত্ব থাকা। চামড়া শিল্প নগরী শ্রমিকদের জন্য আবাসন ও বিনোদন ব্যবস্থাপনা ও সন্তানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি সুবিধা থাকা দরকার। কাঁচা চামড়া রপ্তানির জন্য নিয়ম কানুন শিথিল করা, ক্যামিক্যেল কষ্ট কমানো এবং শ্রমিকের বেতন-বোনাস নিয়মিত দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী হাতে গোনা যেসব শিল্পখাত রয়েছে তার মধ্যে চামড়া শিল্প অত্যন্ত পুরান। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পটি অভ্যন্তরীণ ও কাঠামোগত নানা সমস্যায় রয়েছে। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সঙ্গে কারখানার মালিক-শ্রমিকদের সমন্বয় থাকা চাই।

চামড়া শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে এই শিল্পের বিকাশের পথে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। এখাতের প্রধান সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে: (১) চামড়া শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বর্জ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি বলে বিশ্ব বাজারে চামড়া পণ্যের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। (২) লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের মতো বৈশ্বিকসংস্থার মান সনদ অর্জন করতে না পারা। কোন দেশের এ সনদ না থাকলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সেই দেশ থেকে চামড়াজাত পণ্য আমদানি করতে উৎসাহ দেখায় না। সরকারকেই এ সব সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন