শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ন্যায়বিচার ও নাগরিক নিরাপত্তার সঙ্কট

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করাই তার স্বভাব এবং বিষয়টি বিজ্ঞানভিত্তিক। মানুষের চাহিদা অনেক বেশি, যা সাধারণত পূরণ হওয়ার নয়। যে সম্মান ও সম্পদ পেয়েছে, সে তা আরো পেতে চায়। যে পায়নি সে না পাওয়ার দুঃখ বেদনায় সব সময় পাওয়ার আকাক্সক্ষায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। ক্ষেত্র বিশেষে প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নানাবিধ ষড়যন্ত্রসহ কাউকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। কোনো কোনো মানুষের জৈবিক ও মানসিক চাহিদা এতই বেশি যে, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে আকাক্সক্ষা থেকেই যায়, যা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে।

তারপরও পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে, যারা মানুষের দুঃখ কষ্টের সমাধানে নিজেকে বিলিয়ে দিতে আনন্দ পায়। সে আনন্দ পাওয়া থেকেই ‘সমাজসেবা’ বা ‘জনসেবার’ উৎপত্তি, যার বিপরীতে গ্রামীণ প্রবাদ রয়েছে, ‘ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানো’। নানাভাবে মানুষ জনসেবায় উদ্বুদ্ধ হয়। এর মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি অন্যতম। ইসলাম ধর্মের জাকাত প্রথাসহ ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই অনেক মানুষ সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করে। সব ধর্মেই মানবসেবার তাগিদ দেয়া আছে। অন্ন, বস্ত্রসহ নিরাশ্রয় মানুষকে আশ্রয় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘উত্তম কাজের উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?’ (সূরা আর-রহমান, আয়াত-৬০) উত্তম কাজের অর্থই হলো মানুষকে সৎপরামর্শ দেয়া এবং নিজেকেসহ অন্যকে অপরের উপকারের জন্য সচেতন করে আত্মনিয়োগ করা এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত করা।

মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববান হওয়া সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অনেক দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। যথা (১) ‘কেউ যদি দান করে, আল্লাহভীরু হয় এবং ভালো ও কল্যাণকর বিষয়গুলো জীবনের সত্য হিসেবে গ্রহণ করে তবে আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করবো।’ (সূরা: লাইল আয়াত ৫-৭)। (২) ‘অতএব, তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হইয়ো না। কোনো সাহায্যপ্রার্থীকে তিরস্কার করো না।’ (সূরা: দোহা, আয়াত ৯-১০)। (৩) ‘যে পৃথিবীতে অনুপরিমাণ সৎকর্ম করেছে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে অনুপরিমাণ অন্যায় করেছে, সে তাও সুষ্ঠুভাবে দেখবে।’ (সূরা: জিলজাল, আয়াত ৭-৮)। (৪) ‘তখন সৎকর্মে যার পাল্লা ভারী হবে, সে অনন্ত সুখে অবগাহন করবে।’ (সূরা: ক্বারিয়াহ, আয়াত ৬-৭)। (৫) ‘বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল ছাড়া প্রতিটি মানুষ অবশ্যই ক্ষতিতে নিমজ্জিত। বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলরা সঙ্গবদ্ধভাবে পরস্পরকে সত্যের পথে উদ্বুদ্ধ করে।’ (সূরা: আসর, আয়াত ২-৩)। (৬) ‘(হে নবী) তুমি কি কখনো চিন্তা করেছ, কোন ধরনের লোকেরা কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে? এ ধরনের লোকেরা এতিমের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে, অভাবগ্রস্তকে অন্নদানে কোনো আগ্রহবোধ করে না বা অন্যকে উৎসাহিত করে না।’ (সূরা: মাউন, আয়াত ১-৩)। (৭) ‘যারা সৎ কর্মের নির্দেশ দেয়, অসৎকর্মে নিষেধ করে আর আল্লাহর সীমারেখা মেনে চলে, তুমি সেই বিশ্বাসীদের সুখবর দাও।’ (সূরা: তওবা, আয়াত ১১২)। (৮) ‘আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সূরা: আল-ই-ইমরান, আয়াত ১৪৮)। (৯) ‘তারাই ভালো কাজের জন্য প্রতিযোগিতা করে ও তারাই সে কাজে এগিয়ে যায়।’ (সূরা: মুমিনুন, আয়াত ৬০), (১০) ‘তোমরা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করো।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত ১৪৮)। এমনিভাবে আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন সৎকর্ম করার জন্য পবিত্র কুরআনে অসংখ্যবার তাগিদ দিয়েছেন। এই সৎকর্মের অপর নামই জনসেবা বা সমাজসেবা।

একজন মানুষ যখন লোভ লালসা ত্যাগ করে নিজে সৎ জীবনযাপন করে তখন সে পক্ষান্তরে একটি পরিবার, একটি জাতিকে সৎ থাকার জন্য সহায়তা করে এবং এটাও এক ধরনের সমাজসেবা বা জনসেবা। একজন মানুষের নিজে অসৎ হয়ে অন্যের উপকার করাকে সাময়িকভাবে জনসেবা মনে করা যেতে পারে, কিন্তু দূরদৃষ্টিতে জনসেবার আবরণে সমাজে এটি একটি দুষ্টুক্ষত সৃষ্টির উদাহরণমাত্র। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছে, যারা শুধু কালোবাজারি বা মুনাফাখোর নয় বরং মানুষের জীবন ধ্বংসকারী ব্যবসার সাথে জড়িত, এমনকি খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল দিয়ে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে এবং মুখ রক্ষা ও নিজেদের সম্মান বৃদ্ধি করার জন্য দান খয়রাতসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ, মাদরাসার পৃৃষ্ঠপোষক বনে যায়। এ ধরনের লোকদের নামের পাশে সন্নিবেশিত হয় সমাজসেবক। এমতাবস্থায় প্রকৃতপক্ষে কে সমাজ হিতৈষী আর কে নয়, তাও নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় না। আধুনিক সমাজ সংস্কারবাদীরা সমাজকর্ম ও সমাজসেবাকে আলাদাভাবে দেখছেন। সমাজসেবার প্রধান কাজ হলো নাগরিকদের সমস্যার সমাধানসহ সামাজিক বন্ধনের উন্নয়ন করা। সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে সমাজসেবার (Social Service) কার্যক্রম জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া, যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, যা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান মোতাবেক সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

জাতিসঙ্ঘের সমাজ ও অর্থনৈতিক কমিশনের মতে, ‘মানুষের সাথে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও পরিবেশ উন্নয়নের সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টাই সমাজকর্ম।’ সমাজ সংস্কারক Harry M. Cassid বলেছেন যে, ‘মানবসম্পদ সংরক্ষণ, নিরাপদ রাখা এবং উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক ও সরাসরি সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টাই সমাজকর্ম বা সোসাল সার্ভিস।’ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১৯৩৫ সালে ‘সামাজিক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যমুক্তিসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। Robert L. Barker ২০০৩ সালে বলেছেন যে, ‘সমাজকর্ম হলো সমাজসেবীদের সেই সব কর্ম যা দ্বারা স্বাস্থ্যের উন্নয়নসহ মানুষের পরনির্ভরতা কমিয়ে তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলে।’ ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসের ৬ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত ১৭৭টি রাষ্ট্র প্রধানের উপস্থিতিতে ‘বিশ্বসমাজ উন্নয়ন’ শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে নেলসন ম্যানডেলা উপস্থিত ছিলেন। সে সম্মেলনে সমাজ উন্নয়নে ১০টি করণীয় বিষয় সম্পর্কে রাষ্ট্রপ্রধানগণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন, যার অন্যতম ছিল দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করা।

সমাজ পরিবর্তনশীল, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা সামাজিক সংস্কৃতির বিভিন্ন রকম পরিবর্তন ঘটে। সমাজবিজ্ঞানী Horoton Ges Hunt এর মতে, সমাজের পরিবর্তনের অর্থ হলো সামাজিক কাঠামো ও সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন। নিম্নবর্ণিত চার ভাগে সমাজের পরিবর্তন ঘটে যথা (১) পুরোপুরি পরিবর্তন, (২) আংশিক পরিবর্তন, (৩) বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও (৪) মূল্যায়নগত পরিবর্তন।

বৈপ্লবিক পরিবর্তন আকস্মাৎ আসে এবং স্থায়িত্ব দীর্ঘদিনের নয়, কিন্তু মূল্যায়নগত পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হয়। আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসাল ওয়ার্ক সমাজসেবা সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত ৬টি উপাদান মূল্যায়ন নির্ধারণ করেছে। যথা (১) সেবা, (২) সামাজিক ন্যায়বিচার, (৩) সম্মান ও সম্পদ, (৪) পারস্পরিক সম্পর্ক, (৫) বিশ্বস্ততা, সততা ও নির্ভরযোগ্যতা এবং (৬) যোগ্যতা ও পারদর্শিতা।

সামাজিক ন্যায়বিচার এখন অনেক সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে উঠে গেছে। এখন কেউ আর সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করে না। কোন কথাটি বললে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজে উপকৃত হবে বা ক্ষমতাবানরা খুশি হবে সে কথাটাই বলে। বিনিময়ে নিজে ফয়দা লোটে। যারা ক্ষমতাবান তারা দেশ জাতি ও সমাজকে লুটেপুটে খাচ্ছে। কেউ এর প্রতিবাদ করে না, হক কথা বলতে চায় না এবং হক কথা বলার জন্য মানুষ মানুষকে উৎসাহিত করে না। এতে দুর্বল-নিরীহ মানুষদের দোষারূপ করা যায় না। কারণ, তারা অসহায়। সত্য কথা বলে বা কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর যখন ক্ষমতাসীন কর্তৃক বজ্রাঘাত আসে তখন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং আইন আদালত তার পাশে দাঁড়ায় না। সমাজের বুদ্ধিজীবী যারা, তাদের কাছ থেকে অবহেলিত মানুষ, দেশ ও জাতি অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। তারা মনে করে যে, জাতিগত অবমূল্যায়ন যখন শুরু হয় বা সামাজে যখন ঘূণ ধরে তখন বুদ্ধিজীবীরাই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে ব্যতিক্রম এই যে, এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা এখন চামচাগিরিতে ব্যস্ত, বিনিময়ে তারা দামী বাড়ি-গাড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

সামাজিক ন্যায়বিচার সভ্যতার প্রধান শর্ত। আইন-কানুন, রাষ্ট্র, সরকার গঠন হওয়ার অনেক আগে সমাজ গঠিত হয়েছে। বনে জঙ্গলে যারা বাস করত, সভ্যতার ছোঁয়া যেখানে পৌঁছে নাই সেখানেও সমাজ ছিল। আদিম যুগে বনে-জঙ্গলে বসবাসকারীরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে নিজস্ব নিয়মনীতি অনুসরণ করত এবং সেখানেও সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল, বর্তমানে যা বাংলাদেশে নেই। নীরবে-নিভৃতে সহ্য করে নেয়াই নিপীড়িত মানুষ ‘মন্দের ভালো’ বলে মনে করছে। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি জনহিতকর কাজ যেমন- সমাজসেবা, অনুরূপ সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সমাজসেবার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

সামাজিক ন্যায়বিচার যখন সমাজ থেকে উঠে যায় তখন সমাজ থেকে সুখ শান্তি স্বচ্ছন্দ ও গণমানুষের নিরাপত্তা চলে যায়। সেখানে তারাই ভালো থাকে যারা ক্ষমতাশীন ও তাদের ছায়াতলে অবস্থান করে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack Ali ২ আগস্ট, ২০২১, ১২:৩৮ পিএম says : 0
আজকে স্বাধীনতার পর থেকে যদি বাংলাদেশে আল্লাহর আইন দিয়ে চলত তাহলে এই ধরনের আর্টিকেল লেখার কোনো দরকারি ছিল না. আমাদের দেশের যারা শাসক তাদের মনের মধ্য একদিন বিন্দু দয়া মায়া নাই.. তারা আমাদেরকে কথায় কথায় গুলি করে হত্যা করে গুম করে শাসকদের গুন্ডারা সারাদেশে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে এদেশে আমাদের কোন জীবনের নিরাপত্তা নাই প্রতি পদক্ষেপে আমরা ভীষণ ভয় এর মধ্য জীবন যাপন করছি
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন