মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
দেশের মানুষ আজ অস্বস্তিতে ভুগছে। কোথাও যেন মাথা গোজার ঠাঁই নেই। যারা রাজনীতি করেন তারা সমস্যায় পড়তে পড়তে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আর যারা রাজনীতি কখনোই করেননি বা একসময় করলেও সম্প্রতি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না, সকলেই যেন মামলা-হামলার আশঙ্কা করছেন। তাদের এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা, একে একে দেশের সব কিছুই দলীয় চিন্তার আলোকেই ঘটছে। পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো যখন এভাবে হয়- ‘দলীয় বিবেচনায় চাকরিতে নিয়োগ’; ‘আদালতের মামলায় ন্যায়ভ্রষ্ট রায়’; ‘মামলা গ্রহণে পুলিশের গড়িমসি’; ‘আ’লীগ খালাস বিএনপি কাঠগড়ায়’Ñএ ধরনের সংবাদ শিরোনাম নিশ্চয়ই উদ্বেগের কারণ। সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদ থেকে পিয়ন পর্যন্ত সব স্তরেই নিজ দলের লোকদের নিয়োগ দেয়ার রীতি চালু রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা আর্থিক প্রয়োজনে যদি কোন দলীয় লোককে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন অনুভব হয় সে ক্ষেত্রে সমযোগ্যতার বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ না দিয়ে অযোগ্য একজন লোককে নিয়োগ দেয়া হলে একই সময়ে কয়েকটি অপরাধ হয়ে থাকে। এতে করে যোগ্য লোকটি দুশ্চিন্তায় ভোগে, অন্যায়ের কোন পথ বেছে নেয়নি বলে তিনি হেরে গেলেন এমনটি ভাবতে থাকে। পরবর্তী সময়ে সে অন্যায়ের পথ অবলম্বন করে। এভাবেই দেশের বৃহৎ একটি শ্রেণী সর্বদাই অনিয়ম চর্চার পাশাপাশি ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। দুর্বল শ্রেণীর অধিকার কেড়ে নিয়ে জুলুম প্রতিষ্ঠা করছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
সাধারণ মানুষ এক সময় মনে করতো দেশের অন্য কোথাও ন্যায়বিচার না থাকলেও বিচারালয়ে নিরপেক্ষতা বজায় আছে। কিন্তু তাদের সেই ধারণাও ভুল প্রমাণিত হলো। আমরা যখন জানতে পারলাম আদালত চত্বর থেকে যখন সাক্ষীকে তুলে নেয়া হয়, বিচারক ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করলে সেই রায় আসামীর পক্ষে গেলে বিচারককে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বদলি করা বা মৌখিকভাবে শাসানো হয়- এরকম ঘটনার কথাও শোনা যাচ্ছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সর্বোচ্চ আদালতে অনেকাংশে দলীয়করণ হয় তার প্রমাণ দিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক। কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, ‘উচ্চ আদালতে আইনের শাসন নেই। বলতে লজ্জা করে হাইকোর্টে আজকাল বিচারকরা বাদী, বিবাদী আর আইনজীবীর চেহারা দেখে বিচার করেন। এর কারণ, বেশিরভাগ বিচারক রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হচ্ছেন। নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যা চলতে থাকবে।’ একজন সিনিয়র আইনজীবীর এমন বিরূপ মন্তব্য সরকার আমল নেয়নি। বরং বিচার বিভাগ আইনের ভিতর থেকেই সরকারের দেয়া রায় বাস্তবায়ন করছেন বলেই অনেকেই মনে করেন। এই সত্যটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধই হবে। হিংসা-প্রতিহিংসার রাজত্ব চলতে থাকলে দেশে আরো অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে। এভাবে এক দল অন্য দলের ওপর আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চালাবেÑএটাই কি সমাধান? তা হতে পারে না, সেই সুযোগও রাখা নেতিবাচক একটি কাজ। এতে করে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই স্থায়িত্ব লাভ করবে।
নিজ দলের লোকদের বেলায় ‘দুপুরে মামলা বিকালে প্রত্যাহার’ এই নীতি অবলম্বন করা হলে সেখানে প্রকৃতভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বিগত দিনে বিচারিক আদালতে কী পরিমাণ দলীয়করণ হয়েছে তা ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান থেকেই সহজে অনুমান করা যাবে। আওয়ামী লীগ গত আমলে দায়িত্ব ছাড়ার আগে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায়’ ৪০টি খুনের মামলাসহ ৯৮টি আলোচিত মামলা এবং মামলা থেকে আসামীদের নাম প্রত্যাহার সুপারিশ করে মোট সাত হাজার ১৯৮টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহার করেছিল। তাছাড়া ১৯৭২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত মোট ২৫ জনের মধ্যে বর্তমান সরকার গত মেয়াদে (২০০৯-২০১৪) ২১ জনের মৃত্যুদ- মাফ করে দেন! তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক আমলে করা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের হওয়া ১৫টি মামলার সবকটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ বিএনপি চেয়ারপার্সনের মামলাগুলোসহ জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত সব মামলায় তারা ন্যায়বিচারের আশায় লড়াই করে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে আনীত রাজনৈতেক মামলাগুলোর একটিও প্রত্যাহার হয়নি। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধপল্লীতে হামলায় সরকারি নেতাকর্মীদের ধরতে মানা করেছিল স্থানীয় সরকারদলীয় ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ। সেখানকার ১৯টি মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে আসামী করা হয়, তাতে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। অপরদিকে সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে এখনো। একই দেশে বসবাস করে একেক দলের জন্য একেক নিয়ম! এ ধরনের অসঙ্গতি থাকা ঠিক নয়। এখানেই শেষ নয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়াও অন্যান্য অপরাধীরা রাজনৈতিক লেভেল লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করছেন। খুনি, ধর্ষক, সন্ত্রাসীসহ প্রায় এক লাখ ব্যক্তিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনা লজ্জাস্কর। একই সাথে রাজনৈতিক বিবেচনায় সন্ত্রাসী আর অপরাধীদের মাফ করে দেয়া খুবই অন্যায়। দলীয় পরিচয় বিবেচনা না করে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে এই নির্দেশনার বিপরীত।
মত প্রকাশে স্বাধীনতা থাকলেও শফিক রেহমান বিএনপি ঘরানার সাংবাদিক হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করে সরকার আবারও একদলীয় মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যিনিই সত্য কথা বলেন তিনিই সরকারের টার্গেটে পরিণত হন। গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে মিথ্যা মামলার আসামী বানিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। বিশেষ করে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সাংবাদিক শওকত মাহমুদকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করার মধ্যে দিয়ে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতাই প্রকাশ পেয়েছে। এভাবে দেশের নাগরিকদের বছরের পর বছর কারাবন্দি করে নির্যাতন করার ঘৃণ্য মানুষিকতা নিঃসন্দেহে অন্যায়। সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষগুলো কারাবন্দি হয়ে দিন কাটালেও অবৈধ পথে মানুষ পাচারের হোতা বদী ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুন হত্যার নেপথ্যে জড়িত গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী-সমর্থক ব্যতীত অন্যরা যেন এক বা একাধিক মামলা নিয়ে ঘুরছেন। কেউ আবার নির্যাতনের কারণে পঙ্গু হয়ে অতি কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। এছাড়া কেউ আবার নিজের পরিচয় গোপন করে চার দেয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে মানসিক অশান্তিতে ভুগছেন। যে লোকটি বছরের পর বছর ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তার অপরাধ একটাই, তিনি কেন প্রভাবশালীদের মন রক্ষা করে চলতে পারছেন না। যত আইন আছে তা কেবল সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জন্যÑএমনটিই মনে হয়। প্রভাবশালী বা সরকারদলীয়রা আইনের ঊর্ধ্বে কেন? তারা আইনকে অমান্য করবে আর অন্যরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। এমন দ্বৈতনীতির শাসনে জাতির বিভক্ত বাড়ছে। এ থেকে উত্তোরণের জন্য যথাযথভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা উচিত। প্রকৃত ও সুন্দর একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সাথে নিরীহ মানুষদের হয়রানি না করে তাদের অধিকার আদায়ে রাষ্ট্রকে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন