শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

নিঃসঙ্গতার অভিশাপ

প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
এক বিশেষ মূহূর্তে টলস্টয় শেক্সপিয়রকে বলেছিলেন ‘ভাঁড়’। কারণ, শেক্সপিয়র এক দিকে যখন নিজের বাড়ি তৈরির জন্য জমি কিনছিলেন, তখন আর একদিকে লিখছিলেন- জীবন ঘুমের মতো, কখন আসে, কখন যায় টেরই পাওয়া যায় না। এ এক অদ্ভুত বৈসাদৃশ্য! যিনি নিজের সচ্ছল বাসস্থানের ব্যবস্থা করছেন, অসচ্ছলতর জীবনের দিন গুনছেন- মনের গভীরে তাঁর নিঃসঙ্গতার নীরব প্রবাহ বইছে।
আসলে নিঃসঙ্গতার স্বভাব এ রকমই। সে ঘুমের মতো-কখন আসে, কখন চলে যায় আমরা টের পাই না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে অনেক সময় তার বিশেষ কোনো বহিঃপ্রকাশ থাকে না। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দোসর’ ছবির কাহিনীর মতো, যেখানে নায়িকার ঝিল্লিমন্দ্রিত নিবিড় নিঃসঙ্গতাবোধ শান্ত ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্পটার মতো। বাড়ির বউ রান্না করে, কাপড় ধোয়, সকলের সেবা করে, সকলেই তার ভালোটুকু নিংড়ে নেয়, কিছু প্রশংসা করে। কিন্তু অন্তরে সে নিঃসঙ্গ, তার কুণ্ঠিত নিঃসঙ্গতার ভাষা চিরকাল অনুক্ত থেকে যায়। নিঃসঙ্গ মানুষ বুঝতে পারে না তার মনে- যেখানে সহস্র তরঙ্গের নিয়ত লীলা কি ঘটে চলেছে। শুধু নদীর ঢেউয়ের মতো নিঃসঙ্গতার ঢেউ এসে তার হৃদয়ের অববাহিকাকে ছুয়ে যায়। ঢেউ ফিরে যায়, কিন্তু বালি আর নুড়ি খসে পড়ে। নিঃসঙ্গ মানুষ ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। প্রকাশ করেন কবি। তাঁর সঙ্গীতে বেজে ওঠে নিঃসঙ্গতার করুণ রাগিনী :
‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি
হে আমার প্রাণে,
মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা
মনই জানে।’
নিঃসঙ্গতা শব্দটা আবার নিজেই নিঃসঙ্গ। ধরুন, আপনি কোনোদিন খুব বিমনস্ক হয়ে বাড়ির জানালার ধারে চুপটি করে বসে মেঘের খেলা দেখছেন। দেখছেন কেমন মালার মতো বকের দল উড়ে যাচ্ছে সেই মেঘলোক পেরিয়ে। খানিকক্ষণ এভাবে চলার পর হয়তো দেখবেন যে বাড়ির মহিলারা এসে আপনাকে শুনিয়ে বলছেন, ‘ওর বড়ো রাগ হয়েছে’ বা ‘ওর বড়ো অভিমান হয়েছে।’ মজার ব্যাপার হলো, কেউ কিন্তু বলছেন না, ‘বড়ো নিঃসঙ্গ বোধ করছে।’
চার্লস ল্যাম্বের সেই ‘সুপার অ্যানুয়েটেড ম্যান’ গল্পটার কথা মনে করা যাক। লেখক অফিসে বসে ফাইলের পর ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে অবসন্ন বোধ করতে থাকেন। এতে তাঁর শিল্পীসত্তা আর কর্মীসত্তার মধ্যে ক্রমবিরুদ্ধতা দানা বাঁধতে থাকে। নিজের অন্তরের নিঃসঙ্গতার কথা লেখক বুঝিয়ে বলতে পারেন না। অফিসের কাজে ভুল হতে থাকে। শেষে একদিন চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন।
নিঃসঙ্গতা নানা রকমের হয়ে থাকে। যেমন, জৈবিক নিঃসঙ্গতা। এ অভাব বোধ করি যখন আমরা দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের সংস্থান করতে ব্যর্থ হই; জীবন সংগ্রাম এবং দারিদ্র্য আমাদের মনকে বিপর্যস্ত করে। তখন মনে হয় এখানে আমাদের বাঁচার আশা নেই, বাঁচার ভাষা নেই। যেখানে রয়েছি সে বেহেশত নয়, দোজখও নয়। জীবনকে মনে হয় অসহায়ত্বের এক অনন্ত রেললাইন। সংকীর্ণ সমাজের স্নেহহীনতায় আমরা আহত হই।
এক ধরনের নিঃসঙ্গতা আছে যা হলোÑ আধিভৌতিক নিঃসঙ্গতা, আল্লাহকে না পাওয়ার বেদনা থেকে যা উৎকৃষ্ট বা পাওয়ার আকুল প্রত্যাশা থেকে। ‘তুমি একলা ঘরে বসে বসে কি সুর বাজালে/প্রভু আমার জীবনে।’ ভাবুন কবির এ অসাধারণ গান, যেখানে কবি ভাবছেন তাঁর জীবন একটা নির্জন গৃহ, যেখানে ইস্টদেব বসে বসে তাঁর ঐশি বীণা বাজাচ্ছেন এবং কবি নিবিষ্ট মনে তা শুনছেন। কী অসাধারণ ব্যঞ্জনা!
আর এক ধরনের নিঃসঙ্গতা হলো- রোমান্টিক নিঃসঙ্গতা। প্রিয়তমকে না পাওয়ার বেদনা এ রোমান্টিক নিঃসঙ্গতায় সম্পৃক্ত হয়- যে বেদনা যুগে যুগে ফুটে উঠেছে কালিদাস, নজরুল, ফররুখ আহমদ, বেনজির আহমদ, শেক্সপিয়র বা গ্যেটের কাব্যে, হাইনে, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের কবিতায়। মনে পড়ে একটা গানের পঙ্ক্তি-‘কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে/তখন তুমি ছিলে না, ছিলে না মোর সনে।’ নিজের সুদূরের পিয়াসী মনকে অধরা রূপলোকে মিশিয়ে দেয়ার আকুলতাকে এ রোমান্টিক নিঃসঙ্গতা আখ্যা দেয়া হয়। এ রোমান্টিকতা রবীন্দ্রনাথের গানে অপূর্ব ব্যঞ্জনা লাভ করে, যখন কবি লেখেন-
‘যে গান কানে যায় না শোনা,
সে সুর যেথা নিত্য বাজে,
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব
সেই অতলের সভামাঝে।’
আর এক ধরনের নিঃসঙ্গতা আছে, যাকে বলা হয় বৌদ্ধিক নিঃসঙ্গতা। সব থাকা সত্ত্বেও আমরা কখনো নানা আত্মজিজ্ঞাসায় পীড়িত হই। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে এ জগতে আমরা কেন আসি? কেন যাই? আসিই যদি এত দুঃখ পাই কেন? আসিই বা কোথা হতে? এসব দার্শনিক বোধগুলো আমাদের হৃদয়-মন্দিরে ঘণ্টার মতো বাজতে থাকে।
সংসারে থেকে এ সংসারকে তখন সং মনে হয়। জীবনানন্দের ‘আট বছর আগে’ কবিতার পঙ্ক্তিগুলো মনে পড়ে যায়-
জানি তবু জানি/নারীর-হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ নয়/সবখানি।
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়-/আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে,
আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে/সেই ক্লান্তি নাই
তাই-
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।
সৌন্দর্যপ্রেমী ও স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষরা কি বেশি নিঃসঙ্গতায় ভোগেন? অন্তত কির্কেগার্ডের মতে, মানুষের সৌন্দর্যপ্রেমই তাকে তার অস্তিত্বেরস্বরূপ সম্বন্ধে সচেতন করে এবং এ চেতনা মানুষকে নিঃসঙ্গতাবোধে আক্রান্ত করে। ঊর্ধ্বলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে সৃষ্টিকর্তা-সান্নিধ্যলিপ্সু নিঃসঙ্গ মানুষ তখন বলে, ‘আনন্দধ্বনি জাগাও!’
সৌন্দর্যপ্রীতি যে মানুষকে নিঃসঙ্গতাবোধে হৃদয়দ্রাবিত করে সে সিদ্ধান্ত দার্শনিক ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। যেমন ধরুন, আপনি জীবনে প্রথম দার্জিলিংয়ের মতো কোনো শৈলনগরীতে বেড়াতে গেলেন। সেখানে ভোরবেলায় কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে দেখতে গেলেন সূর্যোদয়ের মহাজাগতিক ইন্দ্রজাল। সে দিগন্ত-পাবিত আলোকময় দূতি আর অনন্ত নির্জনতা দেখে আপনার মনে হয়তো জেগে উঠবে এক বিরল ভাবাদেশ। মনে মনে আপনি হয়তো বলবেন, ‘কত বিচিত্র হে বিচিত্ররূপিণী!’ তখন মনে হবে কলরবমুখর নাগরিক জীবন ছেড়ে পালিয়ে আসি এ মায়াময় শূন্যতার কাছে- যে নাগরিক জীবনে আপনি মানুষের মধ্যে প্রেম-স্বরূপতার সন্ধান করতে গিয়ে এতদিন ব্যর্থ হয়েছেন, ব্যর্থ হয়েছেন খুঁজে পেতে আত্মসুখী, জড় বুদ্ধিসম্পন্ন এক সমাজের অধীন মানুষের হৃদয়ের অভিজ্ঞান। পিতৃ-মাতৃস্নেহ-বঞ্চিত শিশুর মতো এক নিঃসঙ্গ অভিমান হয়তো আপনার হৃদয়কে তখন উদ্বেল করবে।
মানুষের নিঃসঙ্গতা বা এ অস্তিত্বের সংকট যে দর্শনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, সে দর্শনের নাম হলো- অস্তিত্ববাদী দর্শন। ঊনবিংশ শতকে ড্যানিশ দার্শনিক সোরেন, কির্কেগার্ড এ দর্শনের প্রবর্তন করেন। কির্কেগার্ড তাঁর এক গ্রন্থে লেখেন, ‘আমরা আছি, কিন্তু আমাদের থাকার কোনো ভিত্তি নেই।’ সমূহ জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার এ আর্তি, এরপর কার্ল জেলপার্স, মার্টিন হাইডিগার এবং জাঁ পল্ সার্ত্রর দর্শনে আরো ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো প্রবক্তা সার্ত্র মানুষের সত্তাকে দু’টি ভাগে ভাগ করেন। একটি হলো- সত্তার অন্তরঙ্গ, অপরটি সত্তার বহিরঙ্গ। এই সত্তার অন্তরঙ্গ যখন বহিরঙ্গের দিকে সঞ্চয়মান হয়, তখন মানুষ সত্তা একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছায়, সার্ত্র যার নাম দিয়েছেন অ্যাংগাস। এ অ্যাংগাস হল ভয়ভীতি, আতঙ্ক ও নিঃসঙ্গতায় পূর্ণ। মানুষ সেই একাকিত্বের নারকীয় জগৎ থেকে মুক্তি পায় তাঁর আত্মস্বাধীনতার মধ্যদিয়ে। সুতরাং, মানুষ হলো তাই, সে নিজে নিজেকে যা নির্ণয় করে। অস্তিবাদী দর্শন প্রভাবিত করেছে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বহু কবি ও লেখককে। এদের মধ্যে পড়ছেন কাম্যু, কাফকা, জাঁ, পল্ সার্ত্র, টি এস এলিয়ট, রাইনের মারিয়া, রিলকে, স্যামুয়েল বেকেট, ব্যারি কোল প্রমুখ। নজরুলের বিভিন্ন কবিতা বা রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থ’ প্রভৃতি কবিতায় অস্তিবাদী চেতনার প্রচ্ছন্ন আভাস থাকলেও, তাঁর বোধ শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়েছে চেতনার অমৃতময় লোকে?
শুধু একালের লেখাতে নয়, যুগে যুগে কাব্য ও সাহিত্যের নায়ক-নায়িকারা এ সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। মেঘদূতের যক্ষ নিঃসঙ্গতায় আহত হয়েছে প্রেমিকার বিরহে। হ্যামলেট নিঃসঙ্গতা বোধ করেছে মা-এর বিশ্বাসঘাতকায়। গ্যেটের ফাউস্ট পাপ-পুণ্যের দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে সর্বদা দ্বিধার আবর্তে পাক খেয়েছে। আর্থার মিলারের ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’ নাটকের নায়ক অসহায়ভাবে আর্তনাদ করেছেন ভাগ্যবিপর্যয়ের ঘোর তমসাকে এগিয়ে আসতে দেখে। চিত্রশিল্পে এ একাকিত্ব ফুটে উঠেছে। শিল্পী গ্যাব্রিয়েল রসেটি থেকে আরম্ভ করে কিউবিস্ট শিল্পী পাবলো পিকাসো পর্যন্ত। এভাবে যুগে যুগে মানুষের নির্মম একাকিত্বের বেদনা ও সভ্যতার বিপর্যয়ের পূর্বাভাস শিল্পে ও সাহিত্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
বড় ধরনের নিঃসঙ্গতা ছাড়াও ছোটোখাটো বহু রকম নিঃসঙ্গতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে মায়া দিয়ে ঘিরে রাখে। যেমন, বহুদিন ধরে কোনো প্রিয় বন্ধুর চিঠি পাই না, দেখাও হয় না। বহুদিন কোনো প্রিয় ফুলের দেখা পাই না। বহুদিন কোনো পাহাড়ি ঝরনার কাছে যাওয়া হয় না, বহুদিন কোনো প্রিয় শিল্পীর গান শোনা হয় না। এভাবে বহুদিনের বহু রকম নিঃসঙ্গতা আমাদের বুকের মধ্যে একটু একটু করে জমা হতে থাকে।
নিঃসঙ্গতাকে আধুনিক সভ্যতার অভিশাপ বলা চলে। কারণ, আধুনিক সভ্যতার নিঃসঙ্গতা হচ্ছে মূলত ইন্দ্রয়েজ বা তমোগুণী নিঃসঙ্গতা। আধুনিক মানুষ বাণিজ্য ও বিজ্ঞানে যত উন্নত হচ্ছে, মনের জগৎ তার তত সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং তত বেশি সে একাকিত্বের শিকার হচ্ছে। জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আধুনিককালের যুবকরা নানারকম মাদকদ্রব্যে আসক্ত হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানের বইতে আসছে নিঃসঙ্গতা বিষয়ক নানারকম আধুনিক শব্দ-জেনারেশন গ্যাপ, এলিয়েনেশন ইত্যাদি। নিঃসঙ্গতা থেকে নানারকম রোগের সৃষ্টি হয় যা থেকে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। নিঃসঙ্গতার সঙ্গে অন্যান্য আবেগের একটি তফাত আছে। অন্যান্য আবেগ যেমন ক্রোধ, দুঃখ, ভয় ইত্যাদির বাহ্যিক প্রকাশ আছে। কিন্তু নিঃসঙ্গতার কোনো প্রকাশ নেই। নিঃসঙ্গতা শুধু ঘাটে বসে থাকা গৃহহীন মানুষের দিন শেষের শেষ খেয়ার জন্য প্রতীক্ষা। আমরা নিজেদের উপর বিশ্বাস হারাই বলে নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হই। আমরা ভুলে যাই, আমরা অমৃতের সন্তান আমাদের চলার পথে নিঃসঙ্গতার স্থান নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন