পদার্থের ভৌত বা রাসায়নিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে ব্যবহারযোগ্য যে শক্তি নিঃসৃত হয় তাই জ্বালানী। এমন এক প্রকার জ্বালানি হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানী। পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল জীবাশ্ম জ্বালানী হিসেবে পরিচিত। মৃত গাছ বা মৃতদেহ হাজার হাজার বছর ধরে মাটির নিচে চাপা পড়ে এই জ্বালানী তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত ৬৫০মিলিয়ন বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এই সকল জ্বালানীতে উচ্চ পরিমাণে কার্বন থাকে। জীবাশ্ম জ্বালানীতে রাসায়নিক শক্তি জমা থাকে এবং পোড়ালে তাপশক্তি পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে গতি শক্তিতেও রূপান্তর করা যায়। কিন্তু এগুলো পোড়ানোর ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। প্রতি বছর জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে ২১.৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। বায়ুতে ক্ষতিকারক কার্বন ডাই-অক্সাইড মিশে গেøাবাল ওয়ার্মিং-এর মত ঘটনা ঘটছে। বাতাসের জলীয়বাষ্পের সাথে মিশে কার্বনিক এসিডরূপে ভ‚মিতে নিপতিত হচ্ছে এবং মাটি ও ফসলের ক্ষতি সাধন করছে। অনেক ক্ষেত্রেই জীবের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, কয়লা থেকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ত্বরিৎ আহরণে কর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা পারমাণবিক রিয়েক্টরে কর্মীর মৃত্যুর হারের সমান। সুতরাং জীবাশ্ম জ্বালানী টেকসই জ্বালানী নয়।
পরিবেশের কোন প্রকার ক্ষতি সাধন না করে আর্থসামাজিকভাবে লাভবান হয়ে ও বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগতভাবে লাভবান হওয়ার প্রযুক্তিকে জৈবপ্রযুক্তি বলা হয়। জৈবপ্রযুক্তির প্রতিটি উপাদান আহরণ করা হয় সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিকভাবে পরিবেশের কোন প্রকার ক্ষতি সাধন না করে। পেট্রোল-ডিজেলের মাধ্যমে যে তাপশক্তি বা গতিশক্তি আমরা পাচ্ছি, ঠিক একই পরিমান শক্তি বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিবেশগতভাবে পরিবেশের কোন ক্ষতি সাধন না করে লাভ করা যায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। জৈব জ্বালানী বা বায়োফুয়েল হচ্ছে এক ধরনের পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী। জৈব জ্বালানীতে ইথানল ও ডিজেলের সমন্বয় ঘটানো হয় এবং এর মূল উপাদান হচ্ছে চাল, ডাল, গম, ভুট্টা ও তেলবীজ জাতীয় খাদ্যশস্য। বর্তমানে এটি শুধু উন্নত বিশ্বেই ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ, এ জ্বালানী প্রস্তুত অনেক ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই জ্বালানীকে উন্নত বিশ্বের জ্বালানী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী, জ্বালানীর চাহিদা ও জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে তেল, ২০৬০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ২০৮৮ সালের মধ্যে কয়লার মজুদ শেষ হয়ে আসবে। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই সকলকে বিকল্প উৎস খুঁজতে হচ্ছে। বাংলাদেশও বসে নেই। চলছে নানা রকম প্রস্তুতি। টেকসই শক্তি উৎপাদন ও জ্বালানী চাহিদা পূরণ করার জন্য দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে। জৈবপ্রযুক্তি এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ হাতে কলমে দেখানো হয়েছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বায়োগ্যাস প্লান্ট এর মাধ্যমে কিংবা সোলার প্যানেল ব্যবহারের মাধ্যমে। ফলেশ্রæতিতে ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, ১৯৮০ সালে সিলেটে সোলার হোম সিস্টেমের যাত্রা শুরু হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানী নীতি তৈরি করে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানীকে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট শক্তির ১০% করার আহŸান জানায়। ২০১২ সালে ‘টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থায় যোগদান করে। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে নিত্যদিনের বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস, বায়োফুয়েল, বায়ো ফার্টিলাইজারসহ নানা টেকসই শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে। যা পরিবেশ ও মানুষের জন্য প্রায় শতভাগ নিরাপদ জ্বালানী হিসেবে খুবই কার্যকরী। এগুলো নিঃসন্দেহে প্রচলিত ও জীবাশ্ম জ্বালানীর টেকসই বিকল্প উৎস।
দ্রæত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নগরায়ন ও শিল্পায়নের দ্রæত স¤প্রসারণের সুবাদে পৌর অঞ্চল এমনকি সারাদেশেই কঠিন ও তরল বর্জ্য ক্রমবর্ধমান। বড় শহরগুলো কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। তবে এই বর্জ্যগুলোই হয়ে উঠতে পারে শক্তি উৎপাদনের অন্যতম উৎস। বর্জ্যকে শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে ১,৮৬,৪০৮ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বিভিন্ন পচনশীল জৈব পদার্থ বাতাসের অনুপস্থিতিতে গাঁজন প্রক্রিয়ায় বায়োগ্যাস নামক জৈবজ্বালানী তৈরি করা হয়। এর প্রধান উপজাত হল মিথেন গ্যাস। ৬০%-৭০% মিথেন পাওয়া যায় এবং অবশিষ্টাংশ উন্নতমানের জৈবসার হিসেবে জমিতে প্রয়োগযোগ্য। শুধু মিথেন গ্যাস নয়, জৈবশক্তি ব্যবহার করে যানবাহনের জ্বালানী হিসেবে ইথানল ও বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। এরপর সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত দেশে মোট ৭৬,৭৭১ টি বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বায়োগ্যাস প্রযুক্তিতে উন্নয়নের সম্ভাবনা ব্যাপক। দেশের গবাদি পশুর বর্জ্য থেকে দৈনিক ৩০০ কোটি ঘনমিটারের বেশি জৈবগ্যাস উৎপাদন করা যেতে পারে। ৩ ঘনমিটার উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্লান্ট থেকে ৭-৮ সদস্যের একটি পরিবারে রান্নার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। এর জন্য প্রয়োজন ৬০-৭০ কেজি গোবর যা ৫-৬ টি গরু থেকেই পাওয়া যায়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াও জৈবগ্যাস উৎপাদনের পর ব্যবহৃত পশুবর্জ্যকে জৈবসার হিসেবে কৃষিতে ব্যবহার করা যায়। এমনকি মাছের খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা সম্ভব যা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত। বিভিন্ন রাসায়নিক সার কৃষি জমিতে প্রয়োগের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়, মাটির গুণগত মান নষ্ট হয়, উদ্ভিদের ক্ষতি হয়, পাশাপাশি জীববৈচিত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং পানি দূষিত হয়। রাসায়নিক সারের বিকল্প হতে পারে পরিবেশসম্মত ও পরিবেশবান্ধব জৈবসার। পরিবেশবান্ধব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার, জৈব বালাইনাশক ও জৈব ব্যবস্থাপনা থাকে। জৈবপদার্থকে উদ্ভিদের হৃদপিন্ড বা প্রাণ বলা হয়, কারণ তা মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, পুষ্টি উপাদান সহজলভ্য করে, মাটির অণুজীবগুলোর ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি করে। তাই আমাদের দেশের কৃষক ও চাষীদের এখন জৈবসার ব্যবহারে উৎসাহ অনেক বেশি। আরো কিছু জৈবসার বাংলাদেশে সহজলভ্য। এগুলো হল কম্পোস্ট সার। আমাদের দেশে সাধারণত চার ধরনের কম্পোস্ট সার বাজারজাত করা হয়। এগুলো হলো, সাধারণ কম্পোস্ট সার, ভার্মি কম্পোস্ট সার, কুইক কম্পোস্ট সার এবং ট্রাইকো কম্পোস্ট সার। সাধারণ কম্পোস্ট সার তৈরি করতে ২-৩ মাস সময় লাগে এবং কুইক কম্পোস্ট সার ১৪-১৫ দিনেই তৈরি করা সম্ভব। এ জাতীয় সারগুলো সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং এগুলো ব্যবহারে জমিতে ফলনও বেশি হয়।
টেকসই শক্তি উৎপাদনে জৈব প্রযুক্তির অসামান্য অবদান হচ্ছে বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন যা বায়োগ্যাস, বায়োফুয়েল ও বায়োফার্টিলাইজার বা জৈবসার রূপে প্রতীয়মান। একটি জৈবগ্যাসের প্লান্ট থেকে একাধারে গ্যাস, জ্বালানী, সার ও মাছের খাবার পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাস প্লান্ট ব্যবহার করার ফলে জ্বালানির জন্য গাছপালার উপর চাপ অনেক কম পড়ে। বায়োগ্যাস প্লান্টে খরচ কম হওয়ায় এবং পশুপ্রাণীর বর্জ্য বেশি ব্যবহার করায় বাড়িতে গবাদিপশুর খামার গড়তে অনেকে উৎসাহবোধ করে।
আমাদের দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু সুযোগের অভাব আর উদাসীনতায় নষ্ট হচ্ছে অনেক কার্যকর সম্পদ। বেশিরভাগই প্রাকৃতিক সম্পদ এবং তা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আমাদের সামনে জৈব প্রযুক্তির সুযোগ রয়েছে। এর সাহায্যে পাওয়া যাবে জ্বালানীর টেকসই সমাধান। এই প্রযুক্তি বহির্বিশ্বে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমাদেরকেও প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করে জ্বালানী উৎপাদন করতে হবে। এতে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন হবে, তেমনি প্রকৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন