কে এস সিদ্দিকী : গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে ছিল ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কীভাবে তা অতিবাহিত হয়ে গেল অনেকে জানেও না। মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর একক সংস্থা ওআইসি। এর সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা বাংলাদেশসহ ষাটের কাছে। এটি মুসলিম উম্মাহভিত্তিক সংস্থা, মুসলমানদের গর্ব করার বস্তু। এর সদস্য রাষ্ট্রবর্গের প্রত্যেকটিরই জাতীয় দিবসসহ আরো নানা দিবস রয়েছে। ধর্মীয় উৎসব দিবসগুলো সকল রাষ্ট্রে অভিন্ন দিন তারিখে রাষ্ট্রীয় বা সরকারিভাবে উদযাপিত হয়ে থাকে। উদহারণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের বাংলাদেশে দুই ঈদ, শবেকদর, শবেবরাত, আশুরা এবং ঈদে মিলাদুন্নবী সরকারিভাবে উদযাপিত হয়ে থাকে এবং ওই দিবসগুলোতে সরকারি ছুটি থাকে। আরো কয়েকটি ধর্মীয় দিবসে ঐচ্ছিক ছুটি থাকে। তবে হিজরি নববর্ষ অর্থাৎ ১ মহররমকে সরকারিভাবে উদযাপনের যৌক্তিক দাবি বহু দিনের। কিন্তু এ দিবসটি অতীতে যেমন উপেক্ষিত ছিল এখনো উপেক্ষিতই রয়েছে, অথচ হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের প্রথম দিন হতে হিজরি গণনা করা হয়ে থাকে। ৯৫ ভাগ মুসলমানের এই বাংলাদেশে অন্য জাতির ক্যালেন্ডারের নববর্ষের ন্যায় এবং বাংলা নবর্ষের ন্যায় হিজরি নববর্ষ সরকারিভাবে উদযাপনের দাবি ন্যায় ও যুক্তিযুক্ত। শুরু করেছিলাম ওআইসির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে। এ সংস্থাভুক্ত সকল রাষ্ট্র জাতিসংঘেরও সদস্য। বিশ্ব মানবের ওই আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষে যতগুলো দিবস ঘোষণা করা হয়েছে সবগুলোর বিশাল তালিকা গুনেও শেষ করা যাবে না, কিন্তু এসব আন্তর্জাতিক দিবসের মধ্যে মুসলমান দিবস কটি আছে, তা-ই প্রশ্ন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওআইসি মুসলিম উম্মাহভিত্তিক সংস্থা হয়েও তার জন্মবার্ষিকী সংস্থাটি কেন্দ্রীয়ভাবে উদযাপন করে বলে জানা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে সংস্থাটি উদযাপন করে থাকলে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোও তা অবশ্যই উদযাপন করত। এ সংস্থার ছুটির তালিকা থাকলে তা পর্যালোচনা করার সুযোগ থাকত। ওআইসির আত্মপ্রকাশের পটভূমিকা বিচার-বিবেচনা ও পর্যালোচনা করলে যে ভয়াবহ চিত্র চোখের সামনে ফুটে উঠে তাতেই ওআইসির প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়। এর সাথে জড়িত রয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশেষভাবে আরব রাষ্ট্রবর্গের করুণ দৃশ্য। ওআইসি যদি তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রতি বছর উদযাপন করত অন্তত এ সুবাদে মুসলমানরা মুসলমানদের সঠিক অবস্থা সম্পর্কে বছর বছর ওয়াকেবহাল হতে পারত।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল ফিলিস্তিন ভূখ-ে তার সম্প্রসারণ নীতি দ্রুত বাস্তবায়িত করে চলছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ খবর ঘন ঘন আসছে। বৃহৎ শক্তিবর্গের কারসাজিতে সাম্প্রতিককালে যে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে ইসরাইল সে সুযোগটাই গ্রহণ করে ফিলিস্তিনে নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব দেশে খুনাখুনি, রক্তপাত ও পরস্পর হানাহানি, অরাজকতা তথা সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা অব্যাহত রাখা হলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা যেমন সহজ সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী ইসরাইলের পক্ষেও সম্ভব ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করা। প্রকাশিত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখ-ে ইহুদিবাদী ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপনের হার চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ইসরাইলের বসতি স্থাপনের বিরোধী এক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ইহুদিবাদী ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখ-ে ১১৯৫টি অবৈধ বসতি স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় এ ক্ষেত্রে ইসরাইলি তৎপরতা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ইহুদি বসতি স্থাপনের যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। পিতৃমাতৃ ভূমি ইসরাইলের কবল হতে মুক্ত করার জন্য প্রতিনিয়তই ফিলিস্তিনীদের রক্ত ঝরছে, সেখানে। এ যাবত কত ফিলিস্তিনি নারী-শিশু-পুরুষকে ইসরাইলি খুনিরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এবং নিষ্ঠুর নির্যাতন ও জেল-জুলুম চালিয়েছে বহির্বিশ্বের কাছে তার সঠিক তথ্য পৌঁছে না। পৌঁছলেও তার প্রতিকার করার উপায় তাদের নেই। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ব্যতীত তাদের আর করণীয় কী আছে? বিশ্ববাসীর প্রতিবাদ- নিন্দায় ইসরাইলের কি আসে যায়?
ইসরাইল আন্তর্জাতিক কোনো আইনেরই তোয়াক্কা করে না, মানে না। পত্রিকায় প্রকাশিত অপর একটি খবর অনুযায়ী, ইসরাইল পশ্চিমতীরে বসতি বাড়াবে। বিবিসি ও রয়টার্স পরিবেশিত এই খবরে বলা হয়, অধিকৃত পশ্চিমতীরে নতুন করে আরো ২৮৫টি ইহুদি বসতি তৈরির অনুমোদন দিয়েছে ইসরাইল। ইহুদি বসতি নির্মাণ পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান পিস নাউ-এর বরাত দিয়ে সম্প্রতি বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। কয়েকটি এলাকাতে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে এবং ১৭৯টি বিদ্যমান বাড়ির বৈধতার অনুমতিপত্রও দেওয়া হয়েছে বলে খবরে বলা হয়েছে। পিস নাউ জানিয়েছে, ইসরাইলের সেনাবাহিনী পরিচালিত বেসামরিক প্রশাসন পশ্চিমতীরে ২ হাজার ৬২৩টি বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা চলতি বছরই অনুমোদন দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৭৫৬টি অবৈধ বাড়িও রয়েছে। আগের দেওয়া অনুমতি দেখিয়ে এগুলো বৈধ করে নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালের পর পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইল ১০০টিরও বেশি বসতি নির্মাণ করেছে। এসব বসতিতে প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার ইসরাইলি বাস করে। আন্তর্জাতিক আইনে বসতি নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করা হলেও ইসরাইল বিষয়টি মানতে নারাজ।
অধিকৃত এলাকাগুলোতে ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতার ক্রমবর্ধমান হার সেখানকার চলমান করুণ পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলবে তাতে সন্দেহ নেই। এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বিপদ সংকেত। ১৯৬৭ সালে যেখানে মাত্র ১০০টি ইহুদি বসতি ছিল, প্রায় অর্ধশতাব্দী পর সেখানে দুই হাজার ৬২৩টি বাড়ি নির্মিত হলে ইহুদিদের সংখ্যা আরো কতগুণ বেড়ে যাবে তা সহজে অনুমেয়। ইসরাইলকে যারা সামরিক-অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী ও বলীয়ান করে তুলেছে এবং সর্ব প্রকারের বৈষয়িক সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রেখে চলেছে, তাদের সমর্থনপুষ্ট হয়েই ইসরাইল শক্তির দাপটে মেতে উঠেছে এবং একের পর এক ফিলিস্তিনি এলাকা কুক্ষিগত করে চলেছে। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ইসরাইলকে যথেষ্ট আত্মনির্ভরশীল করা হয়েছে। সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই বাস্তবায়িত করতে সক্ষম। আরব রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান দুর্বলতাগুলো ইসরাইলের উত্তম রূপে জানা আছে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসির নীরব ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ইসরাইলের ঔদ্ধত্য কে বাড়িয়ে দিচ্ছি। এ কথা যেসব মহৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে এ সংস্থা গঠিত হয়েছিল তার এতটুকু কি সফল হয়েছে?
ওআইসির ভূমিকা প্রসঙ্গে বলতে গেলে এ সংস্থার প্রতিষ্ঠা কাহিনী স্মরণ করতে হয়। ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট ইহুদিরা মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসায় অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার প্রতিবাদ নিন্দায় মুসলিম বিশ্বের মানুষ তীব্র বিক্ষোভে ফেটে উঠে। এ উত্তেজনাকর ও নাজুক পরিস্থিতিতে মরক্কোর তৎকালীন বাদশাহ হাসানের আহ্বানে রাজধানী রাবাতে মুসলিম রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের দুই দিনব্যাপী এক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দিনের সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় মরক্কোর ফেজ নগরীতে। এ শীর্ষ সম্মেলনে গঠিত হয় প্রথমবারের মতো ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)। মসজিদে আকসার অগ্নিসংযোগের মাত্র এক মাসের মাথায় সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে এ সংস্থা গঠিত হয়। সে হিসেবে সংস্থাটি তার জন্মের এখন ৪৭ বছর অতিক্রম করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সুদীর্ঘ প্রায় এই চার যুগে ফিলিস্তিনে তথা আগ্রাসন ঠেকাতে এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম জাহানের নানাবিধ অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলির সুষ্ঠু সমাধানে ওআইসির বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকা এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বৃহত্তর সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠাসহ ইসরাইল ও পরাশক্তিবর্গ কর্তৃক ইসলামবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র তৎপরতা ও নানা দেশে মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার নির্যাতন এবং বিতাড়ন ইত্যাদি নানা অপতৎপরতা, অপপ্রচার প্রতিহত করতে এ সংস্থার অবদান-কীর্তি কি আদৌ দৃশ্যমান? বিগত শতকে বিশেষ করে ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশে যেসব বড় বড় ও মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে, সেসব ব্যাপারে ওআইসির ভূমিকা জনমনে যে সংশয়-সন্দেহের সৃষ্টি করে সেগুলো কখনো দূরীভূত করা হয়নি। বর্তমান শতকের শুরু থেকে এ যাবৎ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব দেশে বৃহৎ শক্তিবর্গ কর্তৃক যেসব আগ্রাসী তৎপরতা ও রক্তাক্ত ঘটনাবলি ঘটনো হচ্ছে, সে ব্যাপারেও ওআইসির নীরব ভূমিকার অভিযোগ সর্বত্র।
কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত সৃষ্টির গরম গরম খবরের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা দেখে কারো পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব ছিল যে, সেই বহুল প্রচারিত আরব বসন্ত অচিরেই ‘জলবসন্তে’ পরিণত হবে। কোনো বিশেষ দেশের নাম উল্লেখ না করেও বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের নানা স্থানে সাম্প্রতিক বছরগুলো সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এবং নৃশংস তৎপরতার অব্যাহত ঘটনাবলির দায়-দায়িত্ব ও দোষ চাপানোর প্রতিযোগিতা পর্যালোচনা করলে যে সত্যটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে এসব সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ রফতানিকারকরা হচ্ছে পশ্চিমা পরাশক্তিবর্গ ও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ওইসব দেশের উচ্চপদস্থ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এসব গোপন তথ্য এখন ফাঁস করে চলেছেন, যা আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমেও আসছে। উদাহরণস্বরূপ এখানে একজন ব্রিটিশ এমপির মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট-এর বরাতে পত্রিকায় প্রকাশিত ইসরাইলই জিহাদি তৈরি করছে শীর্ষক খবরে বলা হয়েছে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে নির্বাচিত হাউস অব লর্ডসের সদস্য ব্যারোনেস টঙ্গ বলেন, আমি মহৎ লর্ডদের বলতে চাই, যেভাবে ইসরাইল ফিলিস্তিনি শিশুদের গুলি করে হত্যা করছে তাতে একটি জঙ্গি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। এটা ইসরাইলের জন্য ভয়ঙ্কর। জঙ্গি এ প্রজন্ম ইসরাইলে ও তার সমর্থক দেশগুলোর বিরুদ্ধে হামলাকে জায়েজ করতে এ ঘটনাকে ব্যবহার করবে। এটা ঘটতে দেওয়া যায় না। টঙ্গ আরও বলেন, যেভাবে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইল আচরণ করছে তার কারণেই প্রধানত ইসলামী উগ্রপন্থা ও আইএসের জন্ম হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর এবং তাদের শিশুদের ওপর ইসরাইলের নানাভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরলে তাকে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছেন ব্রিটেনে বসবাসরত ইহুদিরা।
ব্রিটিশ এমপির বক্তব্য স্পষ্ট। ফিলিস্তিনে ইসরাইলে আগ্রাসী সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং সেই সন্ত্রাসকে যেসব রাষ্ট্র সমর্থন, সাহায্য প্রদান করে মূলত তারাই সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত প্রজন্মের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা থাকা খুবই স্বাভাবিক। তাদের জিহাদী মনোভাব উগ্রতায় পরিণত হলে তা ফিলিস্তিন ভূখ-েই সীমিত থাকার কথা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামের নামে যে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস চলছে, তাতে ইসরাইল ও তার দোসররাই জড়িত। ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে তার মর্যাদা ক্ষুণœ করা, দুর্নাম করাই ওদের লক্ষ্য এবং উদ্বাস্তু করা হয়েছে তার সঠিক হিসেব কে দেবে? ইসরাইলি ইহুদিদের আগ্রাসী খুনিদাস্তান বর্ণনা করা এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে ক্ষতবিক্ষতকারী বিষফোঁড়া ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতার সুদীর্ঘ ৬৮ বছরের কাহিনী বিশ্ববাসীর অজানা নয়। সুযোগ মতো ইসরাইল যে কোনো স্থানে হানা দিতে পারে, একথা সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহের অধিবাসীদের মনে রাখতে হবে।
ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বিদ্বেষ ছড়ানো, ইসলামের অপব্যাখ্যা, ইতিহাস বিকৃতি, প্রতারণা ইত্যাদির জন্য ইহুদিরা ইতিহাস খ্যাত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইহুদিদের অসংখ্য ষড়যন্ত্র ছিল ইসলামকে অংকুরে ধ্বংস করার জন্য। তারা খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হত্যা করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিল তাঁর ওফাতের পর তার রওজা মোবারকে হানা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র দেহ গায়েব করার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রে তারাই লিপ্ত হয়েছিল বলে একটি বর্ণনা রয়েছে। তাদের মোনাফেকি চরিত্র ও অসদাচরণের কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে মদীনা হতে চিরকালের জন্য বিতাড়িত করেছিলেন। তাদের অন্তরে এ আক্ষেপ অনুতাপ কেবল বিদ্যমান নয়, জাগ্রত থাকাই স্বাভাবিক এবং তার প্রমাণও অনেক। তারা ইসলামকে ঘায়েল করার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে দুর্নাম ও হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ইসলামকে বিকৃত ও অপব্যাখ্যার যে জাল বিস্তার করেছে বিগত দশকগুলোতে তার ভয়ানক রূপ প্রকাশ পেয়েছে। পবিত্র কোরআন বিকৃত করার চক্রান্তসহ ইসলামবিরোধী অসংখ্য ভলিউম প্রচারণা-প্রকাশনা তাদের ঘৃণ্য তৎপরতার জ্বলন্ত স্বাক্ষর।
ওআইসি সম্পর্কে আরো একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, এটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির একমাত্র বৃহত্তর সংস্থা। বয়সের দিক থেকেও প্রাচীনের কোঠায় পদার্পণ করেছে। সেপ্টেম্বর ওআইসির প্রতিষ্ঠা মাস, কিন্তু কজনের জানা আছে এ সংস্থার প্রতিষ্ঠা তারিখ এবং কী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে একই পটভূমিকায় এটি গঠিত হয়েছিল। ওআইসির প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপিত হয় কি? যদি প্রতিবছর এ সংস্থার অন্তত প্রতিষ্ঠা দিবসটি নিয়মিত পালন করা হতো তাহলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জনগণও এ সংস্থার পরিচয় লাভ করতে পারতেন এবং এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সঠিক হালহকিকত অবগত হতে পারতেন এবং এ প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনের মাধ্যমে ওআইসি নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারত। অপরদিকে জাতিসংঘের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ্বমানবের এ আন্তর্জাতিক সংস্থা ঘোষিত কয়েক ডজন দিবস পালন করা হয়। সে তুলনায় কয়েকটি ধর্মীয় দিবস ছাড়া ওআইসি মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে একটি বিশেষ দিবসও কি ঘোষণা করেছে? ওআইসির নীতিনির্ধারকগণ এরূপ বিশেষ দিবস উদযাপন অপ্রয়োজনীয় মনে করলেও বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশে মুসলমানদের স্বীকয়তা ও স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণœ রাখার স্বার্থে বিষয়টি নতুন করে বিবেচ্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এবং বিশেষভাবে ওআইসির সক্রিয় সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন অধিকার তথা তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বদা জোরালো সমর্থন জানিয়ে আসছে এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বর ও অকথ্য নির্যাতনের কঠোর নিন্দা ও সমালোচনা জানিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশ ভুলতে পারে না। এ বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি সাম্প্রতিক এক মন্তব্যে। গত ১৯ আগস্ট ওআইসি মহাসচিব ইয়াদ বিন আমিন মাদানী ঢাকা সফরকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয় নেতা পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা করেন এবং একপর্যায়ে মানবাধিকারের বিষয়টিও তাদের আলোচনায় উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে বলেন, ফিলিস্তিনে ইসরাইলিরা নিরীহ নিরপরাধ নারী-শিশু হত্যা করলেও অতীতে দেখা গেছে, কোনো মানবাধিকার সংস্থাই এ নিয়ে কথা বলেনি।
এ ব্যাপারে ওআইসি মহাসচিবের কোনো মন্তব্য জানা যায়নি। তবে ঢাকা সফর শেষে বিদায়কালে তিনি বলেছেন, ইসলামের অপব্যাখ্যা রুখতে ‘মেসেজিং সেন্টার’ চালু করা হবে। মেসেজিং সেন্টারটি আগামী অক্টোবর মাসে উদ্বোধন করা হবে বলে জানালেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। কিন্তু ইসলামের অপব্যাখ্যা, অপপ্রচার, বিকৃতি ইত্যাদি অপতৎপরতায় ইসরাইলের কোনো জুড়ি নেই, একশ্রেণির মুসলিম তরুণ-তরুণীও তাতে বিভ্রান্ত ও বিপদগামী হচ্ছে।
ফিলিস্তিনে ইসলাইলের অবৈধ ইহুদি বসতি নির্মাণ দ্রুত বৃদ্ধি করার উদ্বেগজনক ঘটনাবলি ফিলিস্তিন সমস্যাকে নতুন করে সঙ্গিন করে তুলছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যকলাপে সৃষ্ট বিরাজমান নাজুক পরিস্থিতির সুযোগে আগ্রাসী ইসরাইল তড়িঘড়ি করে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি নির্মাণ কার্যক্রম যেভাবে বাড়াচ্ছে মনে করা অসঙ্গত নয় যে, অচিরেই হয়তো ফিলিস্তিন ইহুদি জনপদে পরিণত হয়ে যাবে, বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ইসরাইল নীরবে সেখানে তার আগ্রাসী থাবার বিস্তার করে চলেছে। অথচ তথাকথিত সন্ত্রাসী- জঙ্গিদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কোনো খবর নেই। এ সন্ত্রাসীরা ইসলামের নামে জিহাদ আরম্ভ করে নিরীহ মুসলমানদের খুন করছে, হতাহত করছে ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে অনেককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে এবং এ সন্ত্রাসীরা আত্মহননের মাধ্যমে দ্রুত জান্নাত লাভের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অনড়, কিন্তু এ শাহাদাত প্রত্যাশী জঙ্গিদের ফিলিস্তিনে গিয়ে আগ্রাসী ইসরাইলকে বাধা দিতে দেখা যায় না। এ বিপথগামী জঙ্গি সন্ত্রাসীরা মধ্যপ্রাচ্যের নানা স্থানে অপতৎপরতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে যে অরাজক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে, তাতে তারাও ধ্বংস হচ্ছে এবং তাদের পরিণতিও হচ্ছে অত্যন্ত করুণ ও শোচনীয়। তাদের এসব অপরাধ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যে অস্থিতিশীলতা ও আতঙ্ক-উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, তাতে ইসরাইলই লাভবান হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন