মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মুহাররাম মাসে করণীয় ও বর্জনীয়

প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শেখ মোহাম্মদ মেহেদী হাসান
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হিজরতের স্মৃতি বিজড়িত হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররম। এই মুহাররম মাসে হযরত আদম (সা.) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত আম্বিয়া কেরামদের অনেক বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এ মাসের ১০ তারিখ অনেক বরকত ও ফযীলতপূর্ণ যাকে ‘আশুরার দিন’ বলা হয়।
মুহাররম ‘আরবী শব্দ। এর মূল ধাতু হুরম বা হারাম। এ দুয়ের অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, সম্মানিত বা নিষিদ্ধ। মর্যাদাপূর্ণ এ কারণে যে, এই মাসে মহান আল্লাহ্তা‘আলা এমন কতিপয় কর্মকা- সাধিত করেছেন যা অন্যান্য মাসের তুলনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ। আর হারাম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ এই মাসে কোন ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করা নিষিদ্ধ। যেহেতু এই মাসে নিষিদ্ধ কর্মকা-সমূহ হারাম করা হয়েছে তাই এই মাসকে মুহাররম মাস বলা হয়।
পবিত্র কুর’আন মাজীদে আল্লাহ্তা‘আলা জিলক্বদ, জিলহাজ্জ, মুহাররম ও রজব এ চারটি মাসকে পরম সম্মানিত ও পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা জেনে রেখ এই চারটি মাস বড় ফযীলত ও বরকতপূর্ণ, তোমরা এই মাসগুলোতে পাপাচার করে নিজেদের উপর জুলুম করোনা।’ [সূরা আত-তাওবাহ: ৩৬] উল্লেখিত চার মাসের মধ্যে অন্যতম পবিত্র মাস হলো মুহাররম। হাদীস শরীফে আছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেছেন, রমজানের পর রোজার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মাস হল মুহাররম এবং ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামাজ তাহাজ্জুদের নামাজ।[সহীহ মুসলিম:২৮১২] হযরত আলী (রা.)-কে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমজানের পর এমন কোন মাস আছে যাতে আমাকে রোজা রাখার আদেশ দেবেন? তিনি বলেন, আমার উপস্থিতিতে জনৈক ব্যক্তি ঠিক একই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর খেদমাতে পেশ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রতি উত্তরে বলেন, মাহে রমজানের পর যদি রোজা রাখতে চাও, তাহলে মুহাররম মাসে রোজা রেখো। কেননা, এটি আল্লাহ্র মাস। এ মাসে একটি দিন আছে, যে দিন আল্লাহ্ তা‘আলা একটি জাতির তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও সেই দিনে অন্যান্য জাতির তাওবা কবুল করবেন। হযরত ক্বাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, আশুরা বা ১০ই মুহাররমের রোযা আমি আশাকরি আল্লাহ্র নিকটে বান্দার এক বছরের (ছগীরা) গোনাহের কাফফারা হিসেবে গণ্য হবে। [সহীহ মুসলিম : ২৮০৪, মিশকাত: ২০৪৪]
করণীয় : মুহাররম মাসের সুন্নাত আমাল হল আশুরার সিয়াম পালন করা। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ১০ই মুহাররাম রোযা রেখেছেন। ইয়াহুদী ও নাসারারা শুধুমাত্র ১০ই মুহাররাম একদিন রোযা রাখতো। তাই রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাদের বিরোধিতা করার জন্য ঐ দিন সহ তার পূর্বের অথবা পরের দিন রোযা পালন করেছেন। অতএব সুন্নাত আমল হলোÑ ৯ ও ১০ই মুহাররম অথবা ১০ ও ১১ই মুহাররাম রোযা পালন করা। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে মদীনাতে হিজরত করেন, তখন মদীনার ইয়াহুদীদেরকে আশুরার রোযা রাখতে দেখে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা আশুরার রোযা কেন রাখ? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটি অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত, কেননা এই দিনে আল্লাহ্ তা‘আলা বনী ইসরাইলদেরকে তাদের শত্রু ফির‘আউন হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা রোযার মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সব সময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, হযরত মূসা (আ.)-এর বিজয় দিবসের প্রশংসায় রোযা পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশি অধিকারী। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) নিজে রোযা রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। [ সহীহ বুখারী:১৮৬৫]
মু‘আবিয়া ইব্ন সুফইয়ান (রা.) মদীনার মসজীদে নববীতে খুৎবা দানকালে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, আজ আশুরার দিন। এদিনের রোযা তোমাদের উপর ফরয করা হয়নি। তবে আমি রোযা রেখেছি। অতএব তোমাদের মধ্যে যার ইচ্ছা এ রোযা পালন কর, যার ইচ্ছা এ রোযা পরিত্যাগ কর। [সহীহ বুখারী:২০০৩ ও সহীহ মুসলিম: ১১২৯] হযরত ‘আয়েশা (রা.) বলেন, জাহেলী যুগে কুরাইশগণ আশুরার রোযা পালন করতো। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও তা পালন করতেন। মদীনায় হিজরতের পরেও তিনি পালন করেছেন এবং লোকদেরকে তা পালন করতে বলেছেন। কিন্তু (২য় হিজরী সনে) যখন রমজান মাসের রোযা ফরয হলো, তখন তিনি বললেন, যার ইচ্ছা আশুরার রোযা পালন করতে পার এবং যার ইচ্ছা তা পরিত্যাগ করতে পার। [সহীহ বুখারী: ২০০২]
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা আশুরার দিন রোযা রাখ এবং ইয়াহুদীদের বিপরিত কর। তোমরা ‘আশুরার সাথে তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন রোযা পালন কর। [ সুনানুত তিরমিযী : ২১৫৪] উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, চারটি আমল রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কখনো ত্যাগ করেননি। ১) আশুরার দিন রোযা রাখা ২) জিলহজ্বের ১০ দিনের রোযা রাখা ৩) প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখা ৪) ফযরের দুই রাকা‘আত সুন্নাত নামায আদায় করা।
বর্জনীয়
আশুরার দিন আমাদের দেশে শোকের মাস হিসেবে পালিত হয়। সিয়া, সুন্নি সকলে মিলে অগণিত শিরক্ ও বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর নামে ভুয়া কবর তৈরি করে রাস্তায় তা‘যিয়া বা শোক মিছিল বের করা হয়। ঐ ভুয়া কবরে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর রূহ উপস্থিত হয় ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়, তার সামনে মাথা ঝুকানো হয়। সেখানে সিজদা করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য প্রার্থণা করা হয়। মিথ্যা শোক প্রদর্শন করে বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। ‘হায় হোসেন’ বলে মাতম করা হয়। রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রং-বেরং সাজে সাজানো হয়। লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেয়া হয়। হুসাইন (রা.)-এর নামে কেক ও পাউরুটি বানিয়ে ‘বরকতের পিঠা’ বলে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। হুসাইনের নামে ‘মোরগ’ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ঐ ‘বরকতের মোরগ’ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোশাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করা হয় ইত্যাদি। এমনকি অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিবাহ-শাদী করা অন্যায় মনে করে থাকে। ঐদিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুর দুধ পান করানোকেও অন্যায় মনে করে।
অপরদিকে উগ্র সিয়ারা কোন কোন ইমাম বারা’তে হযরত আয়েশা (রা.)-এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয়া মনে করে উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা হযরত আয়েশা (রা.)-এর পরামর্শক্রমেই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অসুখের সময় আবু বকর (রা.) জামা‘আতের ইমামতি করেছিলেন ও পরে খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে কারণে আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি (না‘ঊযু বিল্লাহ্ )। হযরত ওমর (রা.), হযরত উসমান (রা.) হযরত মু‘আবিয়া (রা.) ও মুগীরা ইব্ন শো‘বা (রা.) প্রমুখ সাহাবীকে এ সময় বিভিন্নভাবে গালি দেয়া হয়। এছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ কথা বুঝাতে চেষ্টা করা হয় যে, আশুরার মূল বিষয় হলো শাহাদাতে হুসাইন (রা.) বা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা।
আশুরা উপলক্ষ্যে প্রচলিত বিদ‘আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব এবং অশুদ্ধ আকীদা সমূহের কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তা‘যীয়ার নামে ভুয়া অনেক অনুষ্ঠানও তেমনি মূর্তিপূজার সদৃশ। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি লাশ ছাড়াই ভুয়া কবর যেয়ারাত করল, সে যেন মূর্তি পূজা করল। [বায়হাকী]
তাছাড়া কোনরূপ শোকগাথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোক মিছিল ইসলামী শরী‘আতের পরিপন্থি। অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কাবীরা গোনাহ হল সাহাবায়ে কেরামদের গালি দেয়া। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করো, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ অর্থাৎ সিকি সা‘ বা তার অর্ধেক পরিমাণ (যব খরচ)-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। [ মিশকাত: ৫৯৯৮]
শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি শোকে নিজ মুখে মারে, কাপড় ছিঁড়ে ও জাহেলী যুগের ন্যায় মাতম করে। (সহীহ বুখারী : ১২৯৭ ও মিশকাত: ১৭২৫] অন্য হাদীসে এসেছে, আমি ঐ ব্যক্তি হতে দায়িত্বমুক্ত, যে ব্যক্তি শোকে মাথা মুন্ডন করে, উচ্চস্বরে কাঁদে ও কাপড় ছিঁড়ে। [মিশকাত : ১৭২৬]
তাছাড়া ঐ সব শোক সভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য মিটিয়ে দিয়ে হুসাইন (রা.)-এর কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে শিরক। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সবাইকে সর্বপ্রকার শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।
লেখক : প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Kamal ৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:১৬ এএম says : 0
Thanks for the article. Islamic scholars should guide the people in the right way. We all should study Quran, Hadis and Islamic books to gather knowledge in various aspects of human life.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন