বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী বৃটেন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং তখন এর নাম ছিল বার্মা। আর ১৯৬২ সাল থেকেই সেখানে সেনাবাহিনীর শাসন চলছে। সময়ে সময়ে গনতন্ত্র এলেও তা স্থায়ী হয়নি । বাংলাদেশ সীমান্তের পাশ্ববর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে তারা সেখানে বসবাস করছে। প্রায় হাজার বছর আগে রাখিয়াং নামে এক জাতি ইসলাম গ্রহন করে রোহিঙ্গা নাম নিয়ে মিয়ানমারে বসতি স্থাপন করে। সেই থেকেই রোহিঙ্গা বলে পরিচিত এই জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। অথচ মিয়ানমার সরকার এখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করছে, যার কোন প্রমান মিয়ানমারের হাতে নেই । ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এই রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারত এবং তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশটির সংসদে পাঠাত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর ‘বার্মিজ সিটিজেনশীপ ল’ নামে একটি আইন পাশ করে এবং এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। তখন থেকেই রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী। ২০১৪ সালের আদম শুমারিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য মতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। ফলে রোহিঙ্গারা এখন একটি রাষ্ট্রীয় অধিকার বঞ্চিত এক জনগোষ্ঠীতে পরিনত হয়েছে। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের হাতে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হবার কারনে ইতিমধ্যেই অর্ধেকের বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসাবে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাস করার পরও ২০১৭ সালের আগষ্টের শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া নতুন করে নির্যাতনে আরো প্রায় আট লক্ষ রোহিংগা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে । এভাবে বাংলাদেশে প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হিসাবে বসবাস করছে । কক্সবাজার জেলার উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে এবং ভাসান চরে এসব রোহিঙ্গা বসবাস করছে এবং তারা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। রোহিঙ্গাদের ঘরে এখন প্রতিদিনই নতুন নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করছে। ফলে আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে এবং সমস্যাও বাড়ছে। অতিদ্রুত এ সংকটের সমাধান করতে হবে ।
প্রত্যেক মানুষেরই কতকগুলো মৌলিক অধিকার থাকে, যা যে কোন দেশের,যে কোন ধর্মের এবং যে কোন নাগরিকের বেলায় সমভাবে প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাপী মানুষের এই মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারন পরিষদ সার্বজনীন মানবাধিকারের নীতিমালা গ্রহন করে। সেই থেকে ১০ ডিসেম্বর প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকে নিশ্চিত করাই এর মুল লক্ষ্য। জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষনাপত্রে বিভিন্ন উপধারা সহ মোট ৩০ (ত্রিশ)টি মুলধারা সংযুক্ত করা হয়। এই ঘোষনাপত্রে -আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার ,জাতীয়তা লাভের অধিকার, চিন্তা -বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার,স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, সভা সমাবেশ করার অধিকার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশে সরকারে অংশ গ্রহনের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অধিকার, সকলের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং সর্বোপরি শাসনতন্ত্র বা আইন কর্তৃক প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে বিচার বা আদালতের মাধ্যমে তার কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের এইসব মুলনীতি বিশ্বের দেশ সমুহ গ্রহন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বসবাসরত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এবং প্রতিটি নাগরিকেরই স্বাধীন ভাবে বেচেঁ থাকার, মত প্রকাশের এবং রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। একজন মানুষ হিসাবে স্বাধীনভাবে বেঁেচ থাকার সকল অধিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরও রয়েছে। এখানে ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্রীয়ভাবে কাউকে চিহ্নিত করে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। যদি করা হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের সুষ্পষ্ট লংঘন ।
ইতিমধ্যে এই সংকটের চার বছর পুর্ণ হয়েছে , কিন্তু এর কোন সমাধান হয়নি। ফলে দিন দিন সমস্যাটা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে এবং এটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে একটি সমস্যা সৃষ্টি করেছে । মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গার জীবনচিত্র সরজমিনে দেখার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব , বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, রেডক্রস প্রধান, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারসহ বিভিন্ন দেশের পদস্থ কর্মকর্তাসহ অনেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে সর্বাত্বক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এখনো এই সংকটের কোন স্থায়ী সমাধান হয়নি। বিদেশী রাষ্ট্র এবং আর্ন্তজাতিক দাতা সংস্থা গুলো রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সাহায্য দিলেও, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়াটাই বেশি জরুরি। আর এটাই একমাত্র এবং স্থায়ী সমাধান। এসব রোহিঙ্গগা উদ্বাস্তুর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য আমরা দাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞ । কিন্তু আমরা চাই এসব উদ্বাস্তুর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে সহযোগিতা। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের উন্নত বাসস্থানের জন্য ভাসানচরে আবাসিক ভবন তৈরী করেছে এবং সেখানে ইতিমধ্যেই অনেক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর ও করা হয়েছে। আর এটা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের বসবাসের পরিবেশটা উন্নত করতে সরকারের মহানুভবতা। কিন্তু স্থায়ী সমাধান হচ্ছে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। ইতিমধ্যে মিয়ানমারে সরকার ও পরিবর্তন হয়েছে। আমরা মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলছি, আপনারা এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করুন।
এই সংকটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া এবং তাদের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজ বসতবাড়িতে বসবাসের সুযোগ দেয়া। মোট কথা, রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক করতে হবে। একই সাথে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের মুল জনগোষ্টীর অবিচ্ছেদ্য অংশ করতে হবে। নিজ দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করাটা যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র এবং সরকারের নৈতিক দায়িত্ব, সেখানে মিয়ানমারের সরকার আজ সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে এবং জাতিগত ভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে আশ্রয় দেবার মত শক্তি সামর্থ্য আমাদের নাই এ কথা নিরেট সত্য। কিন্তু এর পরও শুধুমাত্র প্রাণে বাঁচানোর জন্য, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দিয়েছে। কারণ, এটা একটা মানবিক বিষয়। এখানে ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্র বিবেচনার বিষয় নয়।এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশাল উদারতা, মানবিকতা এবং দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে। একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ যেভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা অতুলনীয়। বিশ্ববাসীর উচিত বাংলাদেশকে সর্বাত্বক সাহায্য সহযোগিতা করা । কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দশ লক্ষ মানুষকে আশ্রয় দেয়া এবং এতগুলো মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা বাংলাদেশের জন্য বিরাট কঠিন একটি বিষয়। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে কাজ করতে হবে। আমরা জাতিসংঘসহ সকল আর্ন্তজাতিক সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারতসহ সকল বৃহৎ রাষ্ট্রের প্রতি মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করার এবং এই সংকটের একটি স্থায়ী এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান করার জন্য অনুরোধ জানাই। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন কর্তৃক প্রনীত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করলেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক ।
email : omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন