মুজিবুর রহমান মুজিব
মুঘল সম্রাট বাবর তার দরবারে একজন রাজ কর্মচারীর চোখের ভাষা, বাক চাতুর্য ও বুদ্ধিমত্তা দেখে তার প্রধান উজির নিজাম উদ্দিন খলিফাকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘শেরখানের উপর চোখ রাখবেন। লোকটি খুব চালাক। তার চোখে-মুখে রাজকীয় অভিব্যক্তি। আমি বহু আফগান অভিজাতকে দেখেছি। কিন্তু তার মত কাউকে দেখিনি। তাদের কেউ আমার উপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাকে দেখামাত্র আমার মনে হল তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত। কেননা আমি তার মধ্যে মহত্ত্ব ও বিশালত্বের ছায়া দেখেছি।’ মুঘল স¤্রাট বাবরের কৃপাদৃষ্টি নয়, রোষানলে পতিত হয়ে পাঠান শেরখান মুঘল দরবারের চাকরি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যান। এই শেরখানই সাসারামের সামান্য জায়গীরদারপুত্র ফরিদ খান। বাল্যকাল থেকেই শক্তিশালী ও সাহসী ফরিদ খান বিহারের জঙ্গলে একাই একটি ব্যাঘ্র হত্যা করে শেরখান হিসাবে স্বীকৃতি ও খ্যাতি অর্জন করেন। দুঃসাহসী কার্যকলাপে পৈতৃক নাম ফরিদ খান হারিয়ে যায়। তিনি শেরখান হিসাবেই খ্যাত ও পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। এই শেরখানই পরবর্তীকালে স¤্রাট বাবরের পুত্র নাসিরুদ্দীন মোহাম্মদ হুমায়ূনকে পরপর দুই যুদ্ধে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। শেরশাহ সূরী উপাধি ধারণ করে দিল্লির সিংহাসন আরোহণ করেন। ভারতে সাময়িকভাবে মুঘল সা¤্রাজ্যের অবসান ঘটে। ভারত বিজেতা স¤্রাট বাবর পাঠান শেরখানকে দেখে যে অভিমত ও আশংকা প্রকাশ করেছিলেন তাই বাস্তবে পরিণত হয়। স¤্রাট বাবরের পুত্র দ্বিতীয় মুঘল স¤্রাট হুমায়ূন শেরখানের সৈন্য বাহিনীর তাড়া খেয়ে প্রাণ নিয়ে ইরানে পালিয়ে যান। ইরানের সাফাভী বংশীয় শাসকের আশ্রয়ে সুদীর্ঘ পনেরো বছর পলাতক জীবন কাটিয়ে বিশ্বের একমাত্র দীর্ঘমেয়াদী শরণার্থী স¤্রাট হিসাবে খ্যাত হন। ইরানের শাহের সাহায্য, মুঘল সেনাপতি বীর বৈরাম বেগের রণনৈপুণ্যে হুমায়ূন দিল্লি দখল করে মুঘল স¤্রাট হিসাবে অভিসিক্ত হয়। তার এই অভিষেক হয় শেরশাহ সূরীর ইন্তেকালের পর।
ভারত স¤্রাট শেরশাহ ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তার কর্মজীবন বর্ণাঢ্য, বর্ণিল। তারা আদিতে বিহার কিংবা ভারতীয় ছিলেন না, ছিলেন আফগান। ‘তারিখই জাহান লোদী’- গ্রন্থ মতে, ভারতের হিসার ফিরোজ জেলায় শেরশাহের জন্ম। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার মতে, শেরশাহের জন্ম বিহারের রোটাস জেলাধীন সাসারামে। তার পিতার নাম মিয়া হাসান খান সূরী এবং দাদা ইব্রাহিম খান সূরী। শেরশাহের পূর্ব পূরুষগণ আফগানিস্তানের সোলায়মানিয়া পার্বত্য অঞ্চলে গোমাল নদীর তীরে বসবাস করতেন। পরিবারটি ছিল দরিদ্র, বিত্তবেসাতহীন। ভারতবর্ষের ধনসম্পদ ও প্রাকৃতিক নিসর্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দিল্লির লোদী বংশীয় স¤্রাট বাহালুল খান লোদীর শাসনামলে পরিবারটি জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ভারতে আগমন করে। শেরশাহের পিতা মিয়া হাসান খান পাঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে বসতি স্থাপন করে জমিদার রায় মলের অধীনে চাকরি নেন। পরে তিনি হিসার ফিরোজার জামাল খান সারাং খানের অধীনে চাকরি নেন। এখানেই শেরশাহের জন্ম। অপরূপ প্রাকৃতিক নিসর্গম-িত সোনিনদীর তীরে সাসারামে তার কৈশোর-শৈশব অতিবাহিত হয়। তিনি ছিলেন মিয়া হাসান খানের প্রথম পুত্র। তার চার স্ত্রী ও আট পুত্র ছাড়াও অমুসলিম কয়েকজন পতœীও ছিলেন। শেরশাহের অমুসলিম সৎ মাতাগণ তার প্রতি শুধু অসৌজন্যমূলক আচরণই নয়, নির্যাতন করতেন। বাল্যকালে তার পারিবারিক জীবন সুখকর ছিল না বরং ছিল জ্বালা-যন্ত্রণাময়। এদিকে ধনসম্পদ, বিত্তবেসাতের লোভে বেপরোয়া হয়ে মিয়া হাসান খান বিভিন্ন তদবির ও উপঢৌকনের মাধ্যমে দিল্লির লোদী বংশীয় স¤্রাট সিকান্দার লোদীর কাছ থেকে তাড়া, সাসারাম ও হাজিপুর এই তিনটি ক্ষুদ্র গ্রামের জায়গীর লাভ করেন।
মিয়া হাসান খান শেরশাহের খোঁজখবর নিতেন না বরং সৎ মায়েদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে নালিশ করলে নাখোশ-নারাজ হতেন, সৎ মায়েদের পক্ষাবলম্বন করতেন। পিতামাতার অনাদর-অবহেলা এবং সৎ মায়েদের নির্যাতনই ভাগ্য খুলে দিল তার। অবহেলা ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি অজানার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হন। লক্ষ্য, নতুন কর্ম ও উন্নত জীবন। বাল্যকাল থেকেই মেধাবী ও সুঠাম শরীরের অধিকারী শেরশাহ ছিলেন একজন সুদর্শন-আকর্ষণীয় ব্যক্তি। পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করে কানপুর হয়ে আগ্রা রওয়ানা হন তিনি। তখন দৌলত খান ছিলেন বারো হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের সেনাপতি এবং দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম খান লোদীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শেরশাহ দৌলত খানের অধীনে সৈনিকের চাকরি নিয়ে কর্তব্য, নিষ্ঠা ও সেবাযতেœ সহজেই তার মন জয় করে নেন। তিনি সেনাপতি দৌলত খানকে তার পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও বেছে নেন। সুদক্ষ সেনাপতি দৌলত খান তার সেবাযতœ ও দায়িত্ব পালনে সন্তুষ্ট ও বিমুগ্ধ হন। অতঃপর শেরশাহ জৈনপুরের গভর্নর জামাল খান সারাং খানের অধীনে চাকরি নেন। ইতিমধ্যে তার পিতা মিয়া হাসান খান মৃত্যুবরণ করলে পুত্র সোলায়মান খান তার পাগড়ি দখল করে নিজেকে জায়গীরদার বলে ঘোষণা করেন। পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে স্বীয় কর্মস্থল থেকে দ্রুত সাসারাম ছুটে আসেন শেরশাহ। দেখা করেন দৌলত খানের সঙ্গে। দৌলত খান দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে শেরশাহের পিতৃ জায়গীর মঞ্জুরের জন্য সুপারিশ করলে ইব্রাহিম লোদী শেরশাহকে পিতৃ জায়গীর প্রদান করেন। একদা গৃহত্যাগী এবং নবীন জায়গীরদার শেরশাহ সসম্মানে জন্মভূমি সাসারাম ফিরে এলে তাকে সৈনিক ও জনতা সাদর সম্ভাষণ জানায়। সৎ ভাই সোলায়মান খান বিদ্রোহ ও বিরোধিতা করতে চাইলে জনরোষে তা ব্যর্থ হয়। জায়গীরপ্রাপ্ত হয়ে তিনি শক্তি সঞ্চয়ে আত্মনিয়োগ করেন। এই লক্ষ্যে তিনি বিহারের আফগান গভর্নর বাহার খান লোহানীর অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। তার সঙ্গে শিকারে গিয়ে শেরশাহ একাই নিজ তরবারি দ্বারা একটি বিশাল বাঘ হত্যা করে বাহার খান লোহানীকে তাক লাগিয়ে দেন। তার সাহসিকতা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে শেরখান খেতাব প্রদান করেন। একই সঙ্গে বিহারের ডেপুটি গভর্নর হিসাবে নিয়োগ প্রদান করেন, তার পুত্র জালাল খানের গৃহশিক্ষক হিসাবেও নিয়োগ দেন।
এই সময় থেকেই দুঃসাহসী শেরশাহকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, জোর কদমে এগিয়ে গেছেন তিনি সামনের দিকে। বিহারের গভর্নর হিসাবে তার কৃতিত্ব হল তাজ খানের বিধবা পতœী লাড মালিকাকে বিবাহ এবং এই সূত্রে বিখ্যাত চুনার দুর্গ দখল। এই দুর্গ বিহারে সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। শেরশাহের শক্তি সঞ্চয় ও বৃদ্ধিতে বঙ্গদেশের শাসক সম্প্রদায়ও শংকিত-আতংকিত হন। শেরশাহের শক্তি বৃদ্ধিতে আতংকিত হয়ে জালাল খান বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের সাহায্য প্রার্থনা করলে মাহমুদ শাহ ইব্রাহিম খানের অধীনে শেরশাহকে শায়েস্তা করার জন্য এক বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠান। শক্তিমান শেরশাহ ১৫৩৪ সালে সূর্যগড় যুদ্ধে ইব্রাহিম খানের বাহিনীকে পরাজিত করে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেন। এই যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে শেরশাহ এই অঞ্চলে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেন। সূর্যগড় যুদ্ধ শেষে শেরশাহ ১৫৩৮ সালে বঙ্গদেশে অভিযান চালিয়ে সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ঐ সালেই তিনি রুটাশ দুর্গও দখল করেন। বাংলা- বিহারে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে এবার শেরশাহ দিল্লি ও আগ্রার দিকে নজর দেন। দিল্লিতে তখন হুমায়ূন ক্ষমতাসীন। দ্বিতীয় মুঘল স¤্রাট হুমায়ূন ভ্রাতৃ কলহ-কোন্দল এবং আফগান-পাঠানদের দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন। হুমায়ূনের ভ্রাতাত্রয় কামরান মির্জা, আসকারি মির্জা এবং হিন্দাল মির্জা ছিলেন অকর্মন্য ও মদ্যপ। তারা দিল্লির সিংহাসনকে কেন্দ্র করে মুঘলদের জাতশত্রু আফগানদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেন। এই সুযোগটি গ্রহণ করেন বুদ্ধিমান শেরশাহ। তিনি দিল্লির ক্ষমতা দখল এবং মুঘল-পাঠানের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। স¤্রাট হুমায়ূনের সঙ্গে ১৫৩৯ সালে চৌসা এবং ১৫৪০ সালে কনৌজের যুদ্ধে মুখোমুখি হন শেরশাহ। দুই যুদ্ধেই জয়লাভ করেন তিনি। চৌসার যুদ্ধে হুমায়ূনের পরাজয়ে ঐতিহ্যবাহী ও শক্তিশালী মুঘলদের মানমর্যাদাহানি বিবেচনায় হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য হুমায়ূন ১৫৪০ সালের ১৭ মে দুই লাখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে নিজেই সেনাধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করে রাজধানী ত্যাগ করেন। ২৪০ কিমি পূর্ব দিকে কনৌজে শেরশাহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে যা ভারতের ইতিহাসে বিলগ্রাম-যুদ্ধ নামেও অভিহিত। করুণভাবে পরাজিত হন স¤্রাট হুমায়ূন। বিপুলসংখ্যক মুঘল সৈন্য নিহত হয়। স্বয়ং স¤্রাট কোন মতে প্রাণে রক্ষা পান। প্রিয়তমা পতœী হামিদা বানু এবং কয়েকজন অনুচরসহ হুমায়ূন রাজ্য-সিংহাসন ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান। পিছু হটতে হটতে তিনি লাহোর এসে জানতে পারেন শেরশাহ তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। এ সময় স¤্রাট হুমায়ূন শেরশাহের কাছে এক বার্তা পাঠান: ‘আমি আপনার কাছে পাঞ্জাবের পূর্বদিকে গোটা হিন্দস্তান ছেড়ে দিচ্ছি। আমাকে লাহোর ছেড়ে দিন। আপনার ও আমার রাজ্যের মধ্যে সিরহিন্দকে সীমান্ত হিসাবে মেনে নিন।’ শেরশাহ বিনয়ের সঙ্গে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানান, তিনি শীঘ্র লাহোর বিজয়ের জন্য এগিয়ে আসছেন। নিরুপায় হয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ূন অতঃপর ভারত ত্যাগকরে ইরানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
শেরশাহের মাত্র পাঁচ বছরের ভারত শাসন ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কোন ঐতিহ্যবাহী রাজবংশের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার তার ছিল না। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ অভিবাসী আফগান, একজন গৃহহীন সামান্য সৈনিক, অতঃপর সাসারামের এক সামান্য গ্রামীণ জায়গীরদার। সেই গ-গ্রাম সাসারাম থেকে উঠে এসে ক্ষমতা ও প্রাপ্তির শীর্ষবিন্দুতে আরোহণ করেন তিনি। সারা জীবন তিনি অবিরাম মাঠে-ময়দানে লড়াই করেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সের মধ্যে মাত্র পাঁচ বছর তিনি রাজ্য পরিচালনা করেন। এই পাঁচ বছরে তিনি প্রজাদের সার্বিক কল্যাণে বিভিন্ন গণমুখী কর্মকা- গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। শেরশাহকে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ সংস্কারকও বলা হয়ে থাকে। তিনি বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে উভয় ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়ন করেন। দেড় লাখ অশ্বারোহী, ২৫ হাজার পদাতিক এবং ৫ হাজার হস্তি বাহিনী নিয়ে শেরশাহ এক বিশাল স্থায়ী সৈন্য বাহিনী গঠন করেন। তার অস্ত্রভা-ারে ছিল বিপুলসংখ্যক কামান। সৈন্যদের বেতন নগদে প্রদান করা হত। পদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে দেয়া হত জায়গীর। তিনি মুদ্রায় ত্রিমাতৃক ধাতু ব্যবহারের প্রচলন করেন। শেরশাহী-রুপিয়া আধুনিক রুপির পূর্বসূরী। স¤্রাট শেরশাহ রুপি চালু করা ছাড়াও ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করেন। শেরশাহ ঘোড়ার ডাক চালু করেন। তিনি হিংসুক বা জেদী ছিলেন না। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী স¤্রাট হুমায়ূন প্রতিষ্ঠিত দীন-পানাহ শহরের প্রভুত উন্নতি সাধন করে নতুন নামকরণ করেন শেরগড়। শেরশাহ পাটনা হিসাবে পরিচিত প্রাচীন শহর পাটলিপুত্রকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
শেরশাহের শাসনামলের ঐতিহাসিক অবদান গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড সংস্কার ও সম্প্রসারণ। ১৫৪৫ সালের ২২ মে কালিঞ্জর দুর্গ অভিযানকালে গোলা বিস্ফোরণে শেরশাহের আকস্মিক মৃত্যু হলেও অদ্যাবধি এই জনহিতকর কর্মের জন্য অমর হয়ে আছেন তিনি। এই গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সড়ক। এই মহাসড়ক বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা হয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে গিয়ে পৌঁছেছে। উত্তর পথ নামে পরিচিত এই মহাসড়কের পূর্ব নাম শাহ-রাহ-ই-আজম, সাদাকই আজম ও বাদশাহী সড়ক। বৃটিশ শাসনামলে এই মহাসড়কের নামকরণ করা হয়- গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য আড়াই হাজার কিলোমিটার। তৃতীয় শতাব্দীতে ভারতের মৌর্য স¤্রাটদের শাসনামলে এই সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল মাত্র। মৌর্য বংশের সমুদ্র গুপ্ত মৌর্য ও চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য প্রমুখ বিখ্যাত শাসক থাকলেও তখন অর্থ, প্রযুক্তি ও লোকবলের অভাবে তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। মৌর্য শাসকগণ যা শুরু করেছিলেন শেরশাহ তা এগিয়ে নেন ও সংস্কার করেন। প্রজাহিতৈশী শাসক শেরশাহ প্রজাসাধনের সুবিধার জন্য এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সরাইখানা করেন এবং পথিকদের সুবিধার্থে রাস্তার উভয় পাশে ছায়াবহুল বিপুল বৃক্ষরাজি লাগান। এই শতাব্দীতে এসে বৃক্ষরোপণ একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ লাভ করেছে। স¤্রাট শেরশাহ শত শত বছর পূর্বে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পেরেছিলেন। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ যোগাযোগ প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করছেন, Development of a country Depends on her well Developed transport and communication System| । একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে সে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। শেরশাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিহীন সেই সময়েই এই গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শেরশাহ পশ্চিমে মুলতান এবং পূর্ব দিকে বঙ্গদেশের রাজধানী সোনারগাঁ পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত উন্নত করেন। শেরশাহ এই মহাসড়কের পুনর্নির্মাণ শেষ করে যেতে পারেননি। দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন। ভারতবর্ষে পুনরায় শুরু মুঘল শাসন আমলে শেরশাহের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত হয়।
শেরশাহ তার সমগ্র সা¤্রাজ্যকে ৪৭টি সরকার বা জেলায় ভাগ করে ৪৭ জন ‘শিকদার’ কিংবা শিকদারান-এর কাছে দায়িত্ব অর্পণ করেন। শিকদার নামে অভিহিত স্থানীয় সরকার প্রধানগণ সরাসরি কেন্দ্রের কাছে দায়ী থাকতেন। কাজি ফজিলতের অধীনে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীও থাকত। বঙ্গদেশের প্রতি স্বতন্ত্র নজর ও দৃষ্টি ছিল শেরশাহের। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য তিনি বঙ্গদেশকে সুবাহ বা সরকারে বিভক্ত করেন। বিচারক হিসাবেও শেরশাহ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। শাসক হিসাবে প্রশ্নাতীতভাবে ছিলেন দক্ষ। তার শাসনামলে রাত্রিবেলা কোন বৃদ্ধ মহিলাও স্বর্ণের ঝুড়ি বহন করলে তাকে চোর-ডাকাতের কবলে পড়তে হত না।
লেখক: সিনিয়র আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন