শাহরিয়ার ইসলাম শায়লা : যে কোনো দেশের ইতিহাসে এমন এক সময় আসে যখনকার ঘটনাবলী অন্যান্য ঘটনাকে মøান করে দেয়। এমন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে যিনি জাতির চলার পথে গতি সঞ্চার করেন, নতুন দিক-নির্দেশনা দেন, উদ্বুদ্ধ করেন আত্ম-অনুসন্ধানে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী জিয়াউর রহমান বগুড়ার গাবতলী থানার বাগবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি।
জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তার ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন ভিশনারি, এক স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্তভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দিতে চেয়েছিলেন জাতিকে সম্মান আর গৌরব।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম, পরিশ্রমপ্রিয়তা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলী এ দেশের গণমানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্যে তা জোটেনি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জনগণ যখন চরম ভীতি ও হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল তেমন এক কঠিন সময়ে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জিয়াউর রহমান ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও আশান্বিত করে তুলেছিলেন। তিনি শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি। একইসাথে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের নেতৃত্বও দিয়েছেন। অবশেষে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছিলাম স্বাধীনতা। পেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
শহীদ জিয়ার সবচেয়ে বড় সৃষ্টি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের রাজনীতি, বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি) গঠন করা। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’। দেশপ্রেম সবার ঊর্ধ্বে, তার হৃদয়ে সারাক্ষণ বাজত সেই সুর ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’ স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে ৩০ মে ১৯৮১ শাহাদত বরণ পর্যন্ত মাত্র ১০ বছর তাঁর কর্মময় জীবনে উৎপাদন, উন্নয়নে জাদুর পরশ লেগে আছে।
জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি ’৭১’র মতো একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয়-সংকটে আক্রান্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা জাতিকে তার সত্যিকারের পরিচয় এবং তার আপন স্বাধীন স্বকীয়তার পরিচিতি তিনি উন্মোচন করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সংমিশ্রণে হাজার বছরের যে রসায়ন, তারই আবিষ্কার তিনি করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।
দেশের বিরাজমান প্রেক্ষাপটে শহীদ জিয়া বড় বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। জিয়া জীবিত থাকলে হয়তো বাংলাদেশের অবস্থা এরকম হতো না, হতে পারত না। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন যদি আসে তাহলে তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে কার্যত শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে বন্ধ্যাত্ব শুরু হয়েছিল জিয়াই তা থেকে জাতিকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনিই প্রথম বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শাসকরা যেখানে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে জিয়াউর রহমান উৎপাদনমুখী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পতাকাতলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। প্রকৃত বিবেচনায় জিয়াউর রহমানের সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সহনশীলতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা দেশ বিনির্মাণে যে পথের দিশা দেখিয়েছিল তা যদি অনুসরিত হতো বা হতে পারত অথবা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যেত তাহলে বিজয়ের ৪৪ বছরে মূলত হতাশার পরিবর্তে আশার কথাই বেশি শোনা যেত।
আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এসে আগের মতো সব জায়গা থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলেছে। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জিয়া উদ্যান, জিয়া আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার সার কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় জিয়া ও খালেদা জিয়ার নাম মুছে ফেলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার ব্যস্ত। ১৩ নভেম্বর ২০১০ শহীদ জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ৩৮ বছরের ক্যান্টনমেন্টের মইনুল হোসেন রোডের বাড়ি থেকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বের করে দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ জীবিত জিয়ার চেয়ে মৃত জিয়াকে বেশি ভয় পায়। কারণ, জিয়ার কর্ম অমøান। বর্তমানে গণতান্ত্রিক সরকারের আড়ালে যে যথেচ্ছাচারী শাসন চলছে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য শহীদ জিয়ার আদর্শে উজ্জীবিত হতে হবে। হতাশাগ্রস্ত জাতির মুক্তির পথ হতে পারে শহীদ জিয়ার আদর্শ।
লেখক: আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, জাসাস
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন