শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

আশুরা ও কারবালার চেতনা

প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আশুরা ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনার স্মারক। এ ঘটনায় ইরাকের কারবালা প্রান্তরে যিনি অসম যুদ্ধে অসহায়ভাবে প্রাণ হারান তিনি ছিলেন রাসূল (সা.)-এর অত্যন্ত ¯েœহের নাতি, হযরত আলী ও মা ফাতেমার আদরের দুলাল ইমাম হোসাইন। এই মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হওয়ার মূলে রয়েছে ইমাম হোসাইনকে শাহাদতের নজরানা পেশ করতে হয়েছিল তার নানাজানের আদর্শ রক্ষার জন্যে আর যারা তাকে নির্মমভাবে শহীদ করেছে তারা ছিল তার নানার আদর্শের দাবিদার মুসলমান।
নবীজির ইন্তিকালের মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তাঁর নাতি মজলুমভাবে শহীদ হওয়া মানুষের বিবেক কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এ কারণে যুগে যুগে কারবালা মানব হৃদয়ে শোকের মাতম তুলেছে আর সেসব হৃদয়কে এখনো কাঁদায়, যারা প্রত্যেক নামাযের শেষ বৈঠকে দরূদ পড়ে আলে মুহাম্মদ বা আহলে বাইতের প্রতি দরূদ ও সালাম জানায়।
হিজরতের পর নবী করিম (সা.) ১০ বছর মদীনা কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার পর ১০ম হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। এরপর খোলাফায়ে রাশেদীনের চারজন সত্যনিষ্ট খলিফা দীর্ঘ ৩০ বছর আল্লাহ ও তার রাসূলের সঠিক নীতি আদর্শের উপর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা) বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদত বরণ করলে তার রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার দাবিতে সিরিয়ার গভর্ণর আমীর মুয়াবিয়া (রা.) চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-র সাথে বিরোধ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। হযরত আলী (রা.) খারেজী আততায়ীর হাতে শাহাদত বরণের পর তার ছেলে ইমাম হাসানকে খলিফার পদে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু তিনি আমীর মুয়াবিয়া (রা.)-এর সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা ও মুসলিম উম্মাহর অব্যাহত অনৈক্যের কথা চিন্তা করে খেলাফতের দাবি ত্যাগ করেন। এরপর ৬০ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বছর আমীর মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামী জাহান শাসন করেন। ৫৫ হিজরীতে পূর্ববর্তী খলিফাদের নিয়ম ভেঙে স্বীয় পুত্র এজিদকে তিনি খলিফা মনোনীত ও জনগণের বায়আত আদায় করেন।
পিতার ইন্তিকালের পর ৬০ হিজরিতে এজিদ দামেস্ক কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফার পদে বসে। এরপরই মদীনার গভর্ণরের কাছে পত্র লিখে, যাতে তার পক্ষে হোসাইন (রা.)- এর বাইয়াত আদায় করা হয়। রাসূলে খোদার নাতি হয়ে হোসাইন (রা.)-একজন অপদার্থ ও ইসলামী শরীয়তের রীতিনীতির প্রতি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণকারী খলিফার হাতে বায়আত বা আনুগত্যের শপথ নিতে পারেন না। তাই রাতের অন্ধকারে তিনি মদীনা থেকে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন হিজরি ৬০ সালের রজব মাসে।
এজিদের প্রতি বিদ্রোহী ছিল কুফার জনগণের মন। কুফা বর্তমান ইরাকের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) যখন মদীনায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সপরিবারে কুফায় চলে যান। কারণ, কুফার লোকেরা ছিল হযরত আলী (রা.)-এর সমর্থক ও অনুরক্ত। ইমাম হাসান (রা.) খেলাফতের দাবি ত্যাগ ও পরে বিষপ্রয়োগে শাহাদত বরণ করলে ইমাম হোসাইন (রা.) আহলে বায়তের সদস্যদের নিয়ে মদীনায় চলে আসেন। কাজেই কুফার লোকেরা ইমাম হোসাইনের (রা.)-এর পূর্ব পরিচিত ছিল এবং কুফাবাসীও হোসাইন (রা.) কে ভালোভাবে চিনত। এজিদ দামেস্কে খেলাফতের মসনদে বসার পর হোসাইন (রা.) মক্কায় চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে কুফার গণ্যমান্য লোকেরা একের পর এক চিঠি পাঠাতে থাকে হোসাইনের কাছে। সবার বক্তব্য ছিল, আমরা কিছুতেই এজিদের মতো অপদার্থের হাতে বায়আত নেব না। আপনি আমাদের মাঝে চলে আসুন আমরা আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করে প্রয়োজনে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।
রজব, শাবান, রমযান, শাওয়াল, জিলকদ এই পাঁচ মাস হোসাইন (রা.) বিষয়টি নিয়ে চিন্তা, ভাবনা করেন, সবার সাথে পরামর্শ করেন। অধিকাংশ লোকের পরামর্শ ছিল কুফার লোকেরা বিশ^াসঘাতক, কাজেই আপনি যাবেন না। তিনি দেখেন যে, এজিদ নাছোড়বান্দা। প্রয়োজনে মক্কা আক্রমণ করবে। তখন কাবাঘর ও মক্কা নগরীর পবিত্রতা লুণ্ঠিত হবে। ‘আমার কারণে মক্কার অমর্যাদা হোক’ তা হোসাইন সহ্য করতে পারেন না। তাই সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন কুফায় যাবেন। তিনি মাহে রমযান ও হজের মওসুমে মানুষকে ইসলামী খেলাফত বিপথগামী হওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। ওদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম ইবনে আকীল রিপোর্ট দেন, এ পর্যন্ত কুফার ১৮ হাজার মানুষ আপনার পক্ষে আমার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারেন।
ইসলামী খেলাফতের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রার যে দিনটি নির্ধারণ করেন তা ছিল ৮ই যিলহজ¦, যেদিন হাজীরা ইহরাম পরে মক্কা থেকে মিনা ও আরাফাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ঐদিনই তিনি মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে জানতে পারেন কুফাবাসী বিশ^াসঘাতকতা করেছে। নতুন গভর্ণর ইবনে যিয়াদের ষড়যন্ত্রের শরীক হয়ে মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যা করেছে। এ সংবাদে যার পর নাই মর্মাহত হয়ে একবার মক্কায় ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু সফরসঙ্গী মুসলিম ইবনে আকীলের ছেলেরা পিতার রক্তের দাদ নেয়ার যে সংকল্প দেখায় তাতে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই হুর ইবনে এজিদের নেতৃত্বে কুফার গভর্ণরের প্রেরিত বাহিনী অন্য কোথাও যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় এবং কারবালা প্রান্তরে উপনীত হতে বাধ্য করে। ইতিহাসের বিম্ময়কর তথ্য হল, পথিমধ্যে নামাযের সময় হলে পথরোধকারীরাও ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ইমামতিতে নামায পড়ে। নামায শেষ হলে আবার তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এভাবে কুফার সামরিক অধিনায়ক হুর ইবনে এজিদ হিজরি নববর্ষ ৬১ সালের মহররম মাসে ইমাম ও তার পরিবারকে কারবালায় গিয়ে শিবির স্থাপনে বাধ্য করে।
কুফার গভর্ণর দামেস্ক অধিপতি এজিদের নির্দেশে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ২২ হাজার বা ৩০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে। সে বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে মুহাম্মদ ইবনে সাদকে। তিনি ছিলেন কাদেসিয়া বিজয়ী হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ছেলে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে রেই অঞ্চলের শাসকের পদ প্রদানের লোভ দেখিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠায়। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের লোভে তিনি এতবড় ঝুঁকি মাথায় নেন। শেষ পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে শান্তি স্থাপনের জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইমাম শিবিরের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। চরম মুহূর্তে সেনাপতি হুর ইবনে এজিদ ইমামের শিবিরে পালিয়ে আসে এবং পরে ইমামের পক্ষ নিয়ে বীর-বিক্রমে লড়াই করে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন। যা প্রমাণ করে ইমাম ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আর এজিদ ও ইবনে যিয়াদের বাহিনী যুদ্ধ করেছিল মিথ্যার পক্ষে।
আশুরা এলে আমরা বলি ‘ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সেই ন্যায় ও সত্য কি ছিল তা পরিষ্কার হয়ে গেছে, যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। বস্তুত সে সত্য ও ন্যায় ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী নেতৃত্ব। ইসলামী খেলাফতের আসনে এজিদের মতো পাপিষ্ঠকে কোন মুসলমান মেনে নিতে বা সমর্থন করতে পারে নাÑইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত ধর্ম ও রাজনীতি ইসলামের দুটি হাত বা পা। একটি অচল হলে অপরটি অকেজো হয়ে যায়। কাজেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কোনো পাপাচারীর হাতে তুলে দিয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে বুযর্গ হয়ে বসে থাকার সুযোগ আল্লাহর রাসূলের নাতি উম্মতের জন্য রাখেন নি।
একশ্রেণীর কলুষিত মনের লোক মানুষকে বোকা বানানোর জন্য বলে, ইমাম হোসাইন (রা.) পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। তার মানে কারবালার ঘটনা একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু আমরা যখন দেখব, এজিদের হাতে বাইয়াত এড়ানোর জন্যে ইমাম হোসাইন (রা.) মদীনার বাড়িঘর ত্যাগ করে মক্কায় চলে এসেছেন। রাসূলের নাতি হিসাবে মক্কায় সর্বোচ্চ ধর্মীয় মর্যাদার মধ্যে দীর্ঘ পাঁচ মাস সলা-পরামর্শ করেছেন। আমরা দেখি যে, সবাই হজের উদ্দেশ্যে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার দিনটি তিনি কুফা যাত্রার জন্য বেছে নিয়েছেন। এর আগে পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য মুসলিম ইবনে আকীলকে কুফায় প্রেরণ করেছেন। পথিমধ্যে শত্রুবাহিনীর সাথে বহুবার বৈঠক ও মতবিনিময় করে শান্তি স্থাপন ও যুদ্ধ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আশুরার আগের রাতে সঙ্গীদের ডেকে অন্ধকারের ঢাল ব্যবহার করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ মৃত্যু আসন্ন জেনেও ইমামকে ছেড়ে যেতে তারা কেউ রাজি হয়নি। আশুরার দিন তিনি সেনাপতির ন্যায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধের ব্যুহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সাথী যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসূলে পাকের আদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বুঝা যাবে, ইমাম হোসাইন (রা.) অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
বিদ্বেষী শ্রেণীটি ইবনে যিয়াদের উপর দোষ চাপিয়ে এজিদকে ভারমুক্ত করার জন্যও এক ধরনের প্রচারণা চালায়। অথচ ইতিহাস সম্পর্কে যাদের সামান্য লেখাপড়া আছে তারাও জানে যে, এজিদ ক্ষমতায় আরোহণের পর প্রথম বছর কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটায়। দ্বিতীয় বছর মদীনা আক্রমণ করে তিনদিন পর্যন্ত মসজিদে নববীকে যোদ্ধাদের ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে। আর তৃতীয় বছর যখন কাবা ঘরে আশ্রিত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.)-কে হত্যার জন্য সিরীয় সৈন্যরা কাবাঘর লক্ষ করে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছিল তখনই দামেস্ক থেকে এজিদের মৃত্যুর সংবাদ আসে এবং তারা ফিরে যায়। কাজেই এমন পাপাচারীর পক্ষ নেয়ার সুযোগ কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের নেই।
ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে অসহায়ভাবে শহীদ হয়েছিলেন আর দৃশ্যত এজিদ বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ইমাম হোসাইন (রা.) সেদিন বিজয়ী হয়েছিলেন। যার কারণে বিশে^র ঘরে ঘরে আজ হাসান ও হোসাইন নামের এত আদর ও কদর। পক্ষান্তরে কোনো মানুষই নিজের সন্তানের নাম এজিদ রাখতে রাজি নয়। ইতিহাস বলে, কুফাবাসী তাদের বিশ^াসঘাতকতার চরম প্রায়শ্চিত্ব ভোগ করেছিল পরবর্তী মুখতারের আন্দোলনে। কারাবালায় অংশগ্রহণকারীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল।
রাসূলের নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এতবড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়। ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন