শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

সন্ত্রাস-বিদ্রোহ-অরাজকতা প্রতিরোধে

প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলাউদ্দীন খিলজির কৌশল
কে. এস. সিদ্দিকী : দুনিয়ার সর্বত্র প্রতিনিয়ত অবিশ্বাস্য-বিস্ময়কর বহু রকমের ঘটনা ঘটে থাকে তার খবর কেউ রাখে, কেউ রাখে না। ইতিহাসে এরূপ ভূরি ভূরি ঘটনার প্রমাণ রয়েছে। মৃত ব্যক্তির জীবিত হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল হলেও মৃত ভেবে জীবিত ব্যক্তিকে ফেলে দেওয়ার বা দাফন করার ঘটনা অহরহ ঘটছে যা সাধারণত হাসপাতালগুলোতেই অধিকাংশ দেখা যায়। তবে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের ক্ষেত্রে এরূপ দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। আম্বিয়ায়ে কেরামের মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনাবলির কথা ভিন্ন। হজরত ঈসা (আ.)-এর মোজেজা ছিল, তিনি কোনো মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কুম বিইজনিল্লাহ (আল্লাহর হুকুমে জীবিত হয়ে যাও) বলার সাথে সাথে মৃত লোক জীবিত হয়ে আবার মৃত্যুবরণ করত। সূরা বাকারার শানে নুজুলে হজরত মূসা (আ.)-এর সময়ের ‘আমিল’ নামক এক ব্যক্তিকে তার ভাতিজা সম্পত্তির লোভে হত্যা করার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে হত্যাকারী অজ্ঞাত থাকায়। হত্যাকারী শনাক্ত করার জন্য আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) নিহত আমিলের বিচার প্রার্থীদের একটি গরু (গাভী) জবাই করার কথা বলেন এবং সেই গরুর দেহের অংশবিশেষ নিহত ব্যক্তির কবরে রাখা হলে নিহত ব্যক্তি জীবিত হয়ে হত্যাকারী তার আপন ভাতিজা এ তথ্য জানিয়ে আবার মৃত্যুবরণ করে। সেই গরু সন্ধানের ব্যাপারে মূসা (আ.)-এর সাথে বিচারপ্রার্থীদের সওয়াল জবাবের বিবরণ কোরআনেই রয়েছে। কিন্তু সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি একটি ঘটনায় প্রতিপক্ষের হাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। নির্বোধ প্রতিপক্ষ ভেবেছিল, সুলতানের মৃত্যু ঘটেছে। তাই কথিত লাশ ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে সেখান থেকে প্রস্থান করে এবং সুলতানের নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর সুলতানের প্রাণের সঞ্চার দেখে লোকেরা তাকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। কিছু দিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। অতঃপর তিনি সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অরাজকতা এবং বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দমনে এমন কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করেন, যার ফলে সন্ত্রাস-অরাজকতা দীর্ঘ সময়ের জন্য একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
আলাউদ্দীন খিলজি ভারতবর্ষের মুসলমান সুলতানগণের মধ্যে ছিলেন অন্যতম, যিনি ইসলামী সা¤্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, বড় বড় যুদ্ধ করেন হিন্দু রাজন্যবর্গকে পরাজিত করেন এবং তাদের এলাকাগুলো অধিকার করে মুসলিম সা¤্রাজ্যের অনুর্ভূক্ত করেন। তিনি খিলজি বংশের ছিলেন বলে তাকে খিলজি বলা হয়। কোনো ইতিহাসে তাকে তুর্কি বলা হয়েছে এ বংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম জালালউদ্দীন ফিরূজ শাহ (১২৯০-১২৯৬)।
জালাল উদ্দীনের ভাতিজা ছিলেন আলাউদ্দীন। ১২৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম আলী। খিলজি বংশের তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সুলতান। তার পিতার নাম শাহাবুদ্দীন মাসউদ। আলাউদ্দীনের অপর একভাই ছিল, নাম আলমাস বেগ। জালাল উদ্দীন তার এ দুই ভ্রাতৃষ্পুত্রকে লালন-পালন করেন নিজের পুত্রের মতো। তাদের রাজপুত্রের ন্যায় বড় করেন এবং বাল্যকালেই তাদের যুদ্ধশাস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি তাদের দরবারের আমিরদের অন্তর্ভুক্ত করেন। জালাল উদ্দীনের দুই কন্যার মধ্যে একজনের বিয়ে দেন আলাউদ্দীনের সাথে এবং অপরজনের বিয়ে দেন আলমাস বেগের সাথে। এভাবে দুই ভ্রাতৃষ্পুত্রকে জামাতা করে নেন। আলাউদ্দীনকে তিনি গুলুগ খান উপাধিতে ভূষিত করেন (বীরত্ব ও অসীম সাহসিকতার জন্য মোগল ও তুর্কিদের জন্য এ উপাধি প্রদান করা হতো)।
আলাউদ্দীন সুলতানের নিকট ছিলেন অতিপ্রিয় এবং তার যোগ্যতা, বীরত্ব, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শিতা দেখে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। বিভিন্ন এলাকা জয় করার পর বিপুল পরিমাণের গণিমতের মাল, মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদি সুলতানের সামনে পেশ করেন। সুলতানের ¯েœহধন্য এবং আস্থাভাজন হয়েও তার মধ্যে ক্রমে সুলতান অর্থাৎ বাদশা হওয়ার প্রেরণা জন্মলাভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে জালাল উদ্দীনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রও পাকানো হয়।
১২৯৬ সালের ২ জুন জালাল উদ্দীন ফিরাজশাহ নিহত হন। আলাউদ্দীন সুকৌশলে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এ খুন করান। অতঃপর ১২৯৬ সালের ৩ অক্টোবর আবুল মোজাফ্ফর সুলতান আলাউদ্দীনিয়া অদ্দীন মোহাম্মদ শাহ খিলজি উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতান বলবনের লাল মহলে রাজমুকুট পরিধান করেন। কোনো কোনো বর্ণনামতে, সুলতান জালাল উদ্দীনকে ১২৯৫ সালের ১৯ জুলাই হত্যা করা হয়। ওই দিন তিনি রোজা পালন ও কোরআন তেলাওয়াতরত ছিলেন। আলাউদ্দীন সিংহাসন লাভ করার পর জালাল উদ্দীনের পরিবার-পরিজনকে ধ্বংস করেন এবং তাদের ধনসম্পদ অধিকার করেন।
আলাউদ্দীন ক্ষমতা লাভের পর সা¤্রাজ্য পরিচালনা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ও অভাবনীয় পরিবর্তন ও এক অনন্য শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে তিনি সকল বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করেন। তার এ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় অন্তত শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাও তার সরকারের প্রথম বছরগুলোতে তাতারীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে পাঁচবার হামলা চালায় এবং প্রতিবারই আলাউদ্দীনের সৈন্যরা মোগল তাতারী হামলাসমূহ প্রতিহত করে। দুবার জাফর খানের নিকট তারা পরাজিত হয় এবং তাতারীরা পালিয়ে যায়। জাফর খান তাদেরকে ধাওয়া করার সময় নিহত হন। কয়েকটি যুদ্ধে বিজয়ের পর আলাউদ্দীন তার ভ্রাতুষ্পুত্র সুলায়মান কর্তৃক কয়েকবার হামলার শিকার হন। একবার সুলায়মান তীর বর্ষণ আরম্ভ করলে আলাউদ্দীন তা প্রতিহত করতে থাকেন। অতঃপর আহত হয়ে ভূমিতে পতিত হন। মনে হয় মৃত্যুবরণ করেছেন। সুলায়মান চাইছিল মস্তক বিচ্ছিন্ন করে সত্য নিশ্চিত করবে কিন্তু আলাউদ্দীনের সাথে যারা ছিল তারা বলল, বাদশা যখন মারাই গিয়েছেন তখন তার শিরকর্তন করে লাভ কী? একথা শুনে সুলায়মান আলাউদ্দীনকে মৃত মনে করে সেখানে রেখে চলে যায়। সে তার সৈন্যদের নিকট খবর ছড়িয়ে দেয় যে, আলাউদ্দীনের মৃত্যু হয়েছে। এ কথা বলেই সে নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা প্রচার করে। দরবারের আমির-ওমারা ও জনগণ তাকে বাদশাহ হিসেবে মেনে নেয় এবং বিধান অনুযায়ী চতুর্দিক থেকে নতুন বাদশাহের প্রতি নজর মানত ও মোবারকবাদের অব্যাহত ধারা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সুলায়মান ছিল অনভিজ্ঞ এবং অস্থির, সে তখনই আলাউদ্দীনের হেরমে প্রবেশের চেষ্টা করে। আলাউদ্দীনের মহলে দরজায় পাহরাদার ছিল মালিক কাফুর। সুলায়মানকে সে বাধা দেয় এবং বলে যে, যতক্ষণ না আলাউদ্দীনের মস্তক দেখাবে আমি তোমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেব না।
অপরদিকে তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আলাউদ্দীন জমি থেকে উঠে নিজের জখমগুলোতে পট্টি দিতে থাকেন এবং ইচ্ছা করেন যে, তার যে পঞ্চশ-ষাট হাজার সৈন্য সেসময় তার সঙ্গে ছিল, তাদেরকে নিয়ে আলমাস বেগের কাছে যাবেন। আলাউদ্দীনের ধারণা ছিল যে, সুলায়মানদের তার উপর যে হামলা চালিয়েছে তা আমিরদের কোনো দলের ষড়যন্ত্র হতে পারে। তাই তারা সেনানিবাস পর্যন্ত অধিকার করে নিতে পারে। আলাউদ্দীন এ অবস্থায় সেখানে গমন করলে তা হত্যা করা হতে পারে। এ আশঙ্কা তার মধ্যে কাজ করেছিল। কিন্তু আলাউদ্দীনের হিতাকাক্সক্ষী পরামর্শদাতাগণ বললেন যে, এখনো সুলায়মানের রং জমে বসেনি। অতএব, সৈন্যদেরকে যদি বুঝানো যায় যে, আলাউদ্দীন জীবিত নিরাপদে আছেন, তাহলে দ্রুত তারা তার সঙ্গে হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সুলায়মান স্থির হয়ে বসে যায় তাহলে তাকে প্রতিহত করা কঠিন হবে। অবস্থা ছিল এই যে, আলাউদ্দীন থেকে চলে গেলে সুলায়মানের জন্য ময়দান খালি পড়ে থাকত। পক্ষান্তরে আলাউদ্দীনের সৈন্যরা সম্মুখে আসার ফলে বিশ্বাস ছিল যে, সৈন্যরা সুলায়মানের সঙ্গ ত্যাগ করবে।
অতঃপর আলাউদ্দীনকে ঘোড়ায় আরোহণ করিয়ে তার মহলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখানে যখন পৌঁছেন তখন সৈন্য সংখ্যা হয় পাঁচশ। সেনানিবাসের কাছাকাছি একটি টিলায় আলাউদ্দীনকে বসানো হয় এবং তার মস্তকে শাহী শামিয়ানা রাখা হয়। সৈন্যরা এ দৃশ্য দেখে দৌড়ে তার নিকট আসতে থাকে আর সুলায়মানের দরবার হয়ে যায় শূন্য। সুলায়মান এ দৃশ্য দেখে পালিয়ে যায়। আলাউদ্দীন সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেন সুলায়মানকে ধাওয়া করতে। সৈন্যরা সুলায়মানকে পাকড়াও করে নিয়ে আসে। আলাউদ্দীন সুলায়মানের সকল আত্মীয়স্বজন ও উপদেষ্টাকে হত্যা করান। তার আগেই সুলায়মানের মস্তক আলাউদ্দীনের সামনে উপস্থিত করা হয়। আলাউদ্দীনের ওপর হামলা করে সুলায়মানের এ কাহিনী একটি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা।
মৃত আলাউদ্দীনের জীবিত হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের এ ঘটনা সুলায়মানের লোকজনের জন্য আশ্বস্তের কারণ হওয়া স্বাভাবিক। আলাউদ্দীনের ভ্রাষ্পুত্রদের বিদ্রোহ আলাউদ্দীনের জন্য নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এসব বিদ্রোহ, সন্ত্রাস, অরাজকতা বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি আলাউদ্দীন কীভাবে দমন ও নির্মূল করেন তা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সম্পর্কে নি¤েœাক্ত ঐতিহাসকি বিবরণ জেনে রাখার মতো। সেকালের সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা কীভাবে সফল হয়েছিল তা বর্তমানের আলোকে বিশ্লেষণযোগ্য। সাথে সাথে সুলতান আলাউদ্দীনে বাজার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি আলোচনায় এসে যায়। আলাউদ্দীন খিলজি কীভাবে এসব সংকটের সমাধান করেছিলেন তা দেখা যাক। আলাউদ্দীনের বিরুদ্ধে নানা স্থানে বিদ্রোহ, সন্ত্রাস এবং অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি মাথাচাড়া দিয়ে দেখা দিলে তিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন। একটা বিদ্রাহ দমন করলে আরেকটি দেখা দেয়। শান্তিপূর্ণ উপায় তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও পদে পদে তাকে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয়। ভাতিজার হাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে যাওয়ার পর সুস্থ হতে তার যথেষ্ট সময় লাগে। তার বিরুদ্ধে যেখানে সেখানে যেসব বিদ্রোহ অরাজকতা দেখা দেয়, তার মূলে দরবারের আমির-প্রশাসকদের কারসাজি সক্রিয় বলে আলাউদ্দীনের দৃঢ় বিশ্বাস। যদিও তিনি অনেকটা নির্মূল করেছিলেন এবং এসব বিদ্রোহের নেপথ্য নায়কদের খতম করেছিলেন, তথাপি ভবিষ্যতে আরো বিদ্রোহের আশঙ্কায় তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করেছিল। তার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এ নাজুক পরিস্থিতি হতে স্থায়ী পরিত্রাণের উপায় কি? এ আশঙ্কা তার মনে দানাবেঁধে ওঠার কারণে তিনি দরবারের বিশ্বস্ত ও তার প্রতি আস্থাভাজন আমিরদের তলব করেন এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, উদ্ধৃত এ পরিস্থিতি হতে উত্তরণের উপায় তোমরা কী মনে কর? বিদ্রোহের দ্বার চিরকালের জন্য কীভাবে বন্ধ করা যায়? (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন