বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

দৌলতগঞ্জ প্রত্মঢিবি

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফাহিম ফিরোজ
স্বপ্ন যখন সত্য হয় তখন মানুষের মন ও মেজাজ থাকে বসন্ত ঋতুর মতো আনন্দময়। কথাটা লিখতে হলো এ কারণে যে, একটানা কয়েক মাস ধরে চুয়াডাঙ্গা জেলার দৌলতগঞ্জ প্রতœঢিবি নিয়ে ক্রমাগত ইনকিলাবে লিখতে লিখতে শেষ পর্যন্ত প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের টনক নড়ে এবং ঢিবি রক্ষায় প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে। এটা জাতির জন্য নিঃসন্দেহে একটি সুখবর। সুখবর এ জন্যই, অতি প্রাচীন এই ঢিবি এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। এখন তা আলোয় উদ্ভাসিত। এ জন্যই মনটা আনন্দপূর্ণ। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের একটি সূত্রমতে, সিন্ধু সভ্যতা গড়ে ওঠার পর এর বিস্তার ঘটে পূর্বদিকে এবং এর ভূমি কাঠামো দেখে আঞ্চলিক জরিপ দলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ গোলাম ফেরদৌসের ভাষায় ‘এটি সেন আমলের হতে পারে।’ এ খবরও বিভিন্ন মিডিয়ায় উঠে আসে। এর কিছু দিন পর ওই এলাকার প্রাচীন অধিবাসীদের কাছ থেকে জানা যায়, সত্যি সত্যি এক সময় ঢিবিতে সেনরা বাস করত। তবে ৫০/৬০ বছরের বেশি তারা এখানে থাকেনি। পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা বিজয়ী তুর্কিদের ভয়ে এবং কৌলিন্য রক্ষার্থে এরা আরও পূর্বদিকে সরে যায়। পাঠকদের বলে রাখা ভালো, দৌলতগঞ্জ থেকে ভারতের নদীয়া আনুমানিক ৪০/৪৫ কিলোমিটার, মুর্শিদাবাদও তাই। ১২০৪-১২০৬ খৃস্টাব্দের মধ্যে তুর্কি বীর বখতিয়ার যখন নদীয়া দখল করেন তখন লক্ষণ সেন পালিয়ে পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। যে জলপথ দিয়ে তিনি পালিয়েছিলেন, স্থানীয়দের মতে তা ছিল দৌলতগঞ্জের একেবারেই কাছাকাছি। বৌদ্ধ বিদ্বেষী রাজা শশাংকের রাজধানী লক্ষণাবতী ছিল মুর্শিদাবাদের রাঙামাটি। এসব বিবেচনায় আনলে দৌলতগঞ্জ ঢিবি বহু প্রাচীন হওয়াই সম্ভব। সম্প্রতি স্থানীয় একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, ডিবিতে বসবাসকারী এক ব্যক্তির গৃহে এক সময় মূল্যবান ধাতু নির্মিত সাপ এবং হরিণের মাথা দেখা যেত। এখন আর তা নেই। এই সাপের সূত্র খুঁজতে গিয়ে এলাকার আদি অধিবাসীদের কাছ থেকে জানা যায়, ঢিবিতে এক সময় মনসা মন্দির ছিল। বৌদ্ধ রাজা গোপালের সময় (মৃত্যু : ৭৯০-৭৯৫) এই মনসা মন্দিরকে মঠে পরিণত করা হয়। তার পুত্র মহারাজা ধর্মপালের রাজত্বকালে (৭৭০-৮১৫) ভিন্নমালের তেজস্বী হিন্দু রাজা নাগভট ধর্মপালের বিজয় যাত্রা মেনে নিতে পারেননি এবং তিনি ধর্মপালের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এ তথ্য যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিক্রমপুর ইতিহাস গ্রন্থেও আছে। তার সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজারাও নাকি যোগ দেন। এ সময় নাগভট নাকি দৌলতগঞ্জের বৌদ্ধ মঠে হামলা করে এবং কিছু বৌদ্ধকে পুড়িয়ে মারে। বাকিরা পালিয়ে যায়। লালমাই পাহাড় থেকে আনুমানিক ১৩০ জন বৌদ্ধ এই মঠে ছিল। কাছেই আর একটি মন্দির-মঠ ছিল। একটু আগে যে মনসা মন্দিরের কথা বলা হয়েছে সম্ভবত এটা গুপ্ত যুগের। গুপ্ত রাজারা সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। রাজা গোপাল বাংলার সিংহাসনে আসীন হলে মনসা মন্দিরটি মঠে পরিণত করা হয়। জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, বর্তমান ঢিবির ১২/১৫ গজ পূর্বদিকে ভৈরব নদীর তীর ঘেঁষে গুপ্ত যুগের বৃহৎ আকৃতির ইটের ছোট একাধিক কক্ষ ছিল, যা অনেকের চোখে পড়েছে ২০/২৫ বছর আগেও। এলাকার কিছু মানুষ এগুলোর গুরুত্ব না বুঝে ভেঙে ফেলে এবং তারা সুরকি বানিয়ে ভবন নির্মাণের কাজে ব্যবহার করে। কাছাকাছি দোয়ার পাড়ায় আরও একটি ছোট মন্দির (পরবর্তীতে মঠ) ছিল। স্থানীয় সুনু মোল্লা এ বিষয়ে বলেন, বৃহৎ ইট তিনি এলাকায় দেখেছেন। এসব দিক বিবেচনা করলে বলা যায়. দৌলতগঞ্জ প্রতœঢিবি আনুমানিক দুই হাজার বছরের প্রাচীন হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের মতামতই চূড়ান্ত। যতটুকু জানা যায়, এই ঢিবিতে শুধু হিন্দু-বৌদ্ধরাই বসবাস করেনি। সুলতানী-মোগল-ব্রিটিশ আমলের কর্মকর্তারাও এখানে বসবাস ও বাণিজ্য করে গেছেন। তপন কুমারের ‘মঠ ও মন্দির’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মঠ-মন্দির যেখানে থাকবে অবশ্যই সেখানে খাল-দীঘি থাকবে। কারণ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আদিকালে ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠত। এই সূত্রে বলা যায়, দৌলতগঞ্জ প্রতœঢিবিতে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে আসছে সেই গুপ্ত যুগ থেকে। জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, পরবর্র্তীতে বাংলার স্বাধীনতা হরণকারী লর্ড ফ্লাইভ এই ঢিবিতে বৃহৎ আকৃতির স্বর্ণ ও বস্ত্রের ব্যবসা খুলেছিলেন অল্প দিনের জন্য। আনুমানিক ১৭০৬ খৃস্টাব্দে ‘শাহরিয়ার’ নামে এক ব্যক্তি ঢিবিতে মণিমুক্তার ব্যবসা করে বেশ লাভবান হয়েছিলেন। এই ব্যক্তি ঢিবির পশ্চিম দিকে প্রথম কাঁচাবাজার বসান, যা আদিগঞ্জের বাজার নামে খ্যাত ছিল। এর আগে নাকি বাজার বসত ঢিবির কাছাকাছি কোথাও। তবে মূল্যবান সদাইপাতি কিনতে হতো দূরবর্তী বাজার থেকে।
১৭১১ খৃস্টাব্দে দৌলত খাঁ নামের এক মোগল কমান্ডারের ক্যাম্প ও বাসস্থান ছিল এই প্রতœঢিবিতে। সুতরাং নানা কারণে দৌলতগঞ্জের এই ঢিবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছুই এর মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা বিচিত্র নয়। দেরিতে হলেও প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ঢিবি রক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছে। ডিজি মহোদয়ের একনিষ্ঠ সততা, আন্তরিকতা এবং দেশপ্রেম এক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তা না হলে লুটেরাদের হাতে ঢিবির ভাগ্য নির্ধারণ হতো। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক জরিপ দলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ গোলাম ফেরদৌসের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চলতি বছরের শেষের দিকে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের প্রেস রিলিজের অনুলিপি যখন আমার হাতে এসে পৌঁছে, তারপর থেকেই দৌলতগঞ্জ প্রতœঢিবি নিয়ে যাতে কেউ কোনো ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করতে না পারে এ জন্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বারবার সরকারি সকল গোয়েন্দা ইউনিটকে ওই এলাকায় সজাগ থাকতে বলেছি। জানা যায়, একটি চক্র কয়েক মাস আগে ঢিবি নিজেরাই কিনে নেয়ার একটা নোংরা উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু অধিদফতর এবং দেশপ্রেমী কিছু তরুণের বাধার কারণে তাদের সেই স্বপ্ন অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হলেই দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না। তা হলে মীরজাফরই বড় দেশপ্রেমিক হতে পারতেন। কে কত বড় মানুষ তা প্রমাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার দেশপ্রেম। এ জন্য প্রয়োজন সততা, নিষ্ঠা ও সাহস। ঢিবি খননের অপেক্ষায় এলাকার মানুষ এখন প্রহর গুনছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন