সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

হাত ধোয়া অভ্যাসে পরিণত করতে হবে

প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা মানুষের স্বভাবজাত। মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে এবং চারপাশের পরিবেশ ও লোকজনকেও পরিচ্ছন্ন দেখতে ভালোবাসে। পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার রাখা চাই, মূল্যবান হওয়া অপরিহার্য নয়। ইসলামী শরিয়তে এবং রাসূল (সা.)-এর পবিত্র হাদিসে পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের একটি অঙ্গ (মুসলিম)’। জীবনের অন্যান্য বহু প্রসঙ্গের মতো পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও ইসলামে অনেক ব্যাপক ও গভীর। নিয়মিত মেসওয়াক করা, হাত-পায়ের নখ কাটা, শরীরের অবাঞ্ছিত চুল পরিষ্কার করা ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যদি উম্মতের কষ্টের ভয় না হতো তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক নামাজের সময় মেসওয়াক করার আদেশ করতাম।’ মেসওয়াক মুখের রোগ-জীবাণু ধ্বংসের প্রধান হাতিয়ার। শুধু মেসওয়াকের মাধ্যমে মানুষের ৭০টি কল্যাণ রয়েছে। মুখের ভেতর দিয়ে খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় দেহে প্রবেশ করে। সে জন্য মুখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই জরুরি। মুখের ভেতর কোনো সংক্রমণ হলে তা খাদ্যনালিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করে।
১৫ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। একশটির অধিক দেশের প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মানুষ বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস পালন করে থাকে। এ দিবসের সূচনা খুব বেশি দিন আগের নয়। ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ফর হ্যান্ডওয়াশিং’ নামক সংস্থার উদ্যোগে সুইডেনের স্টকহোমে সর্বপ্রথম ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর হাত ধোয়া দিবস পালিত হয়। প্রথমে স্কুলবয়সী বাচ্চারাই এ ক্যাম্পেইনের মূল টার্গেট ছিল, অল্প কিছু দিনের মধ্যে বিশ্বজুড়ে সব বয়সী মানুষের মধ্যে প্রতিদিন সঠিক নিয়মে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনাই এই ক্যাম্পেইনের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
দৈনন্দিন জীবনে মুসলমানদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পূর্বশর্ত অজু করা। দৈনিক পাঁচবার অজু করার জন্য ১৫ বার হাত, পা, নাক, মুখ ও চোখ পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করেন। দিনে-রাতে কেউ পাঁচবার অজু করলে তার দেহ অবশ্যই পরিচ্ছন্ন থাকবে। আর দেহ পরিচ্ছন্ন থাকলে মনও প্রফুল্ল থাকবে। হাত দিয়েই আমরা আহার করি, চোখ-মুখ মুছি এবং প্রয়োজনবোধে মুখগহ্বরে হাত দেই। আবার হাত দ্বারাই আমরা ময়লা-আবর্জনা দূর করে থাকি। তাই হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠে তিনবার হাত না ধুয়ে যেন কোনো পাত্রে হাত না ঢোকায়।’
এই আধুনিক যুগেও কোনো কোনো সভ্যতার দাবিদাররা টয়লেট থেকে ফিরে হাত ধোয় না। এদের জন্য ‘হাত ধোয়া’ দিবস, আর যারা শ্রমিকদের অধিকার দেয় না, বরং তাদের ওপর বুলডোজার চালিয়েছে, গুলি করেছে, তাদের জন্য ‘মে দিবস’। ইসলামে প্রায় ১৫শ’ বছর পূর্বেই পবিত্রতা, শ্রমিকের মজুরি, চুক্তি, অধিকার এবং শ্রমঘণ্টা ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার মজুরি দিয়ে দেয়ার নির্দেশ। আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এই যুগে বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করছে মহানবী (সা.) আজ থেকে প্রায় ১৫শ’ বছর পূর্বেই তা বলে গেছেন। এখন ‘বিশ্ব বাবা দিবস’, ‘মা দিবস’ পালন করা হয়। এ দিনে সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে মা-বাবাকে ফুল দিয়ে আসে, খাবার দিয়ে আসে। অথচ রাসূল (সা.) বলেছেন, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। অন্যত্র বলেছেন, ‘...যে মা-বাবা কাউকে পেল অথচ জান্নাত কামাই করে নিল না সে ধ্বংস হোক’।
জীবনযাপন করতে গেলে পানাহার করতে হয়। ইসলাম আমাদেরকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পানাহারের শিষ্টাচার ও শিক্ষা দেয়। নবী করিম (সা.) তাঁর সাহাবিদের পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা নিজে করে দেখিয়েছেন। খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার তাগিদ দিয়েছেন। খোলা পানীয় ও খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রাসূলুল্লাহ (সা.) খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় ঢেকে রাখতে বলেছেন (বুখারি)।
হাত ধোয়া নিছক কোনো আড়ম্বরতা নয় বরং প্রাত্যহিক অভ্যাসের ব্যাপার। গবেষণায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার মতো সামান্য এ অভ্যাসটি রপ্ত করতে পারলে সর্দি, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি ভ্যাকসিনের সমান কার্যকারিতা অর্জন করা সম্ভব এবং সে ক্ষেত্রে এই রোগগুলো প্রতিরোধের জন্য ব্যয়কৃত বিপুল অর্থেরও সাশ্রয় হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সামান্য বা মামুলি অভ্যাসটি রপ্ত না করায় প্রতিবছর বিশ্বে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াজনিত রোগের কারণে ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন শিশু মারা যায়। শুধুমাত্র হাত ধোয়ার অভ্যাসের মাধ্যমে শিশুদের ডায়রিয়াজনিত কারণে মৃত্যুহার কমানো যায় প্রায় ৫০ শতাংশ এবং শ্বাসকষ্টজনিত সংক্রমণে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব প্রায় ২৫ শতাংশ।
আমরা যেসব খাদ্য খাই তা হতে শরীরের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং অপবিত্র পদার্থগুলো প্র¯্রাব-পায়খানার মাধ্যমে বের হয়ে আসে। পায়খানার সময় যে মল বের হয় তাতে কোটি কোটি রোগ-জীবাণু লেগে থাকে। তা কোনোভাবে আমাদের শরীরে লেগে থাকলে রোগাক্রান্ত হতে হবে। আর এর হাত থেকে রক্ষার জন্য ঢিলা, কুলুখ বা টয়লেট পেপার ব্যবহার করেন।
কুলুখ হিসেবে টয়লেট পেপার বেশি গুরুত্বপূর্ণ না মাটি? মাটির চেয়ে টয়লেট টিস্যু ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। টয়লেট পেপার তৈরির সময় বেশ কিছু কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়। যেসব কেমিক্যাল মানুষের শরীরে একজিমা তৈরিতে সহায়তা করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, একাধারে বেশি দিন টয়লেট পেপার ব্যবহার করলে যৌনাঙ্গে চুলকানি এবং মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। তবে টয়লেট পেপার ব্যবহারের পর যদি উত্তমরূপে পানি ব্যবহার করা হয় তাহলে এর ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ অনেকাংশে সম্ভব। মাটি ব্যবহারে শহরের টয়লেটগুলো নোংরা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। অবশ্য সচেতনতা দ্বারা এটি দূর করা সম্ভব। মাটি ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ মাটিতে এমোনিয়াম ক্লোরাইডসহ অনেক উচ্চশক্তিসম্পন্ন জীবাণুনাশক ও রোগ প্রতিরোধক রয়েছে। ফলে টয়লেট করার সময় মলের সাথে যে জীবাণুগুলো আসে তা সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। শরীরের নরম ‘রেকটাম’ মাটির কুলুখ ব্যবহার করলে ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকে না। রোগজীবাণুও ঢুকতে পারে না। যারা রেকটাম আক্রান্ত, পায়খানার সময় রক্ত পড়ে তার ঔষধ মাটি। এ জন্য অনেক সময়েই দেখা গেছে, মাটি গরম করে সেক দিলে ব্যথা কমে যায় এবং রক্ত পড়া বন্ধ হয়। মাটির ঢিলা দ্বারা রেকটাম পরিষ্কার করলে সে কোনো দিন অর্শরোগে আক্রান্ত হয় না। তাছাড়া আমরা জানি, মাটি উত্তম জীবাণুনাশক। মাটিকে বলা হয় প্রকৃতির শোধনাগার। আর এ জন্যই হয়তো আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) পায়খানার পর কুলুখ ব্যবহার করতে বলেছেন। তিনি পাথর নয়তো মাটি ব্যবহার করতে বলেছেন।
‘উন্নয়ন’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা দেশের প্রতিটি জেলার অশিক্ষিত, কমশিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিতদের ওপর জরিপ করে এক তথ্য প্রকাশ করেছে, খাওয়ার পূর্বে বা টয়লেট থেকে ফিরে হাত ধোয়ার অভ্যাস ১৫ শতাংশ লোকের। আবার শুকনো খাবার গ্রহণের আগে কেউ এ নিয়ম মানছে না। তা কেবল গ্রাম পর্যায়ে নয়, শহরেও। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অলসতা, অবহেলা, অজ্ঞতা বা অসচেতনতার কারণে এসব পরিবারে সাবানের ব্যবহার অভ্যাসে পরিণত হয়নি। সুস্থ থাকার প্রাথমিক কাজই হলো খাবার গ্রহণের আগে ভালোভাবে সাবান বা অন্য যে কোনো এন্টিসেপটিক ব্যবহার করে হাত ধোয়া। হাত ধোয়ার উপকারিতা জানলেও বাস্তবে অনুসরণ করেন কম। আবার কেউ কেউ হয়তো এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন।
বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস যা শুধু একটি দিনের প্রচারণা নয়, জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে হাত ধোয়ার ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করা হয়। হাত ধোয়া নিছক কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রাত্যহিক অভ্যাসের ব্যাপার। এর পরেও হাত ধোয়া দিবস এত ঢাকঢোল পিটিয়ে আয়োজন করার প্রয়োজনীয়তা ঠিক কোথায়? আমরা হাত ধোয়ার গুরুত্ব এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। কারণ বাংলাদেশের মতো একটি দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় প্রায়ই কৃমিনাশক সপ্তাহ পালিত হয়। যেখানে স্কুলের বাচ্চাদের কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো হয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বেশ কিছু স্কুলে গবেষণা করে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ বাচ্চা কৃমিতে আক্রান্ত। যার অন্যতম বড় কারণ হলো নিয়মানুযায়ী হাত ধোয়ার ব্যাপারে অসচেতনতা। হাত ধোয়া তেমন কোনো খরচের ব্যাপার নয়। নিতান্ত মানসিকতার ব্যাপার।
ব্যক্তিগত জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মানুষকে অনেক রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা আমাদের হাত দিয়ে অসংখ্য কাজ করে থাকি। কাজ করতে গিয়ে আমাদের হাত অসংখ্য জীবাণুর সংস্পর্শে আসে, যার ফলে অনেক রোগ হয়। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, কৃমি, রক্ত আমাশা, পরজীবীজনিত আন্ত্রিক রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রা একদিকে যেমন নিম্নমানের, তেমনি অস্বাস্থ্যকর বটে। প্রতি বছর এসব নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করে পানি দূষণ রোধের কৌশল, ভ্যাকসিন, চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ খাবারের আগে-পরে শৌচকর্মের পরে সামান্য সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে তা শুধু বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন বাঁচাতেই সাহায্য করবে না, অধিকন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। গবেষণায় দেখা গেছে শুধু নিয়মিত হাত ধুলে, খাদ্যবাহিত প্রায় ৫০% ও সর্দিজনিত ২৫% সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব। শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলে বাহ্যিকভাবে পরিষ্কার হয় সত্যি, কিন্তু জীবাণুমুক্ত হয় না। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর হচ্ছে সাবান, লিকুইড সোপ ও হ্যান্ডবার। প্রথমে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে এরপর সাবান বা লিকুইড সোপ হাতের কব্জি পর্যন্ত মাখানো উচিত। এরপর হাতের উভয় পাশে, আঙুলের ফাঁকে, নখের চারপাশে ও ভেতরে অন্তত ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ড ঘষা উচিত। এরপর পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা উচিত। আমাদের সবার উচিত প্রতিদিন সঠিক নিয়মে রাসূলে পাক (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী হাত ধোয়া ও অন্যদেরও হাত ধোয়ায় উৎসাহিত করা। এতে করে অনেক বড় ধরনের স্বাস্থ্য বিপর্যয় থেকে আমরা খুব সহজেই মুক্তি পেতে পারি।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন