শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কুমিল্লায় দুর্গাপূজার একটি মন্ডপে মূর্তির পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন রাখা নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ৪ জনের মতো নিহত হয়। রংপুরসহ হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দেশের আলেম-ওলামাসহ সচেতন মানুষ প্রতিবাদ ও সোচ্চার হয়ে উঠে। অন্যদিকে, এ ঘটনা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও ভারতের বিজেপি সরকারের কোনো কোনো নেতা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। পশ্চিমবঙ্গের এক বিজেপি নেতা তো নরেন্দ্র মোদিকে পত্র লিখে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। ভারতে যে উগ্র ও ধর্মান্ধ হিন্দুদের দ্বারা মুসলমানরা প্রতিনিয়ত খুন, নিপীড়ন, নির্যাতন, উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে এবং মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, এ নিয়ে তাদের কোনো ধরনের প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। এমনকি খেলার মধ্যেও তারা সাম্প্রদায়িকতাকে টেনে এনেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে ভারতের ১০ উইকেটে হারার কারণ হিসেবে উগ্র হিন্দু সমর্থকরা দলের মুসলমান সদস্য পেস বোলার মোহাম্মদ শামিকে দায়ী করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ন্যাক্কারজনকভাবে আক্রমণ করে পোস্ট দিয়েছে। অথচ ঐ খেলায় ভারতীয় দলের বিশ্বমানের বোলার ভুমরা, ভুবেনেশ্বরের মতো পেস বোলার রয়েছে। তারাও কোনো উইকেট পায়নি। উগ্র ও ধর্মান্ধ হিন্দু সমর্থকরা তাদের দিকে আঙ্গুল না তুলে একমাত্র মোহাম্মদ শামিকে হারের জন্য দায়ী করেছে। এ ঘটনায় বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরা হতবাক। সাবেক বিশ্বসেরা ক্রিকেট তারকারা এ নিয়ে সমালোচনাও করেছেন। তারা বলেছেন, ক্রিকেট ১১ জনের খেলা। দল পরাজিত হলে তার দায় পুরো দলের। এক্ষেত্রে একজনকে দায়ী করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। একজন ক্রিকেটার একদিন খারাপ খেলতেই পারে, তার মানে এই নয়, হারের জন্য তাকে দায়ী করতে হবে। মোহাম্মদ শামির ক্ষেত্রে যেভাবে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করা হয়েছে, তা করা হয়েছে কেবল মুসলমান বিদ্বেষ থেকে। অথচ এই শামি উইকেট নিয়ে ভারতকে অনেক ম্যাচ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শামি চ্যাম্পিয়ন বলার হওয়ার কারণেই তো দলে জায়গা পেয়েছে। সে তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। একদিন খারাপ করায় এবং দল পরাজিত হওয়ায় পুরো দায় তার উপর চাপিয়ে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করার কারণ, সে মুসলমান। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভারতের অধিনায়ক, কোচ ও ক্রিকেট বোর্ডকে শামির পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে। এ ম্যাচে বাংলাদেশের হারার অন্যতম কারণ হিসেবে লিটন দাসের দুটি সহজ ক্যাচ ড্রপ করাকে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা দায়ী করলেও তার পক্ষে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিমের মতো দলের সিনিয়র ক্রিকেটার এবং ক্রিকেট বোর্ড লিটনের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এ নিয়ে আফসোস থাকলেও লিটনকে নিয়ে কোনো ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য বা সাম্প্রদায়িক আচরণ করেনি। তারা এটিকে খেলার অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছে। এই ঘটনা থেকে ভারতীয় উগ্র হিন্দু সমর্থকদের শেখার রয়েছে। খেলার ভুল-ত্রæটিকে কিভাবে খেলার অংশ হিসেবে মনে করতে হয়, তা বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেখিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, ভারতে উগ্র হিন্দুদের দ্বারা মুসলমান হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের বিষয়টি দেশটির আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বাংলাদেশ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে কোনো মন্তব্য বা বক্তব্য-বিবৃতি দেয় না। এক্ষেত্রেও ভারতের উগ্রবাদী রাজনীতিক ও নেতাদের বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখার রয়েছে।

দুই.
বাংলাদেশ তো এমন দেশ যেখানে হাজার বছর ধরে সকল ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে আসছে। পারস্পরিক দুঃখ-কষ্টে এবং আনন্দ- বেদনায় শামিল হয়ে আসছে। যেখানে কে কোন ধর্মের তা বিবেচনা করেনি। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে ঘটেনি বা ঘটছে না, তা নয়। মানুষের বৈশিষ্ট্যই তো এই তারা একসাথে চলতে চলতে অনেক সময় ঝগড়া-ঝাটিতে লিপ্ত হয়। তার মানে এই নয়, তারা চির বৈরী হয়ে যায়। ঝগড়া শেষে আবার একত্রে বসবাস শুরু করে। সব ধর্মের মানুষ নিয়ে বাংলাদেশের চিরায়ত সামাজিক বৈশিষ্ট্য এটাই। মাঝে মাঝে দেশের কোনো কোনো এলাকায় হিন্দুদের ওপর হামলার যে অভিযোগ ওঠে, তা অনেক সময় স্থানীয় কিছু দুষ্টু চক্রের কাজ। তবে তা সামাজিক এবং প্রশাসনিক সহায়তায় সাথে সাথেই দমন করা হয়। এমন হয় না যে, বছরের পর বছর ধরে তা চলে। সরকারের তরফ থেকেও এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান রয়েছে। ভারতে কি এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন চরিত্র রয়েছে? এই যে প্রতিদিন মুসলমানদের ওপর হত্যা, হামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন চলছেÑএক্ষেত্রে ভারত সরকার কি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে? নিচ্ছে না। বরং প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে এবং দেশ থেকে মুসলমানদের বিতাড়ন করার লক্ষ্য নিয়ে হিন্দুস্তান বানানোর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। অথচ ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবীদার কংগ্রেস সরকারের আমলে মুসলমানদের উপর নির্যাতন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। দেশটির মুসলমানরা এতটাই অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছিল যে, তারা মনে করেছিল কংগ্রেস সরকার বিদায় না হলে তাদের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতন কোনোভাবেই সহনীয় পর্যায়ে আসবে না। ফলে নির্বাচনের সময় উগ্র হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদীর মিষ্টি মিষ্টি কথায় আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, মোদী ক্ষমতায় এলে তার চরিত্রে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুত্ববাদের যে অপবাদ লেগে আছে, তা দূর করতে চেষ্টা করবে। তার বদনাম ঘুচাতে হলেও উগ্রবাদ পরিহার করবে। তাদের এই ধারণা থেকেই মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসকে হটিয়ে বিজেপি বিপুল বিজয় অর্জন করে। মোদী ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, সেখানের মুসলমানদের ধারণা একেবারেই ভুল ছিল। মোদী তার স্বরূপে ফিরে আসেন। প্রকাশ পেতে শুরু করে তার উগ্রতা এবং মুসলমান বিদ্বেষ। এই মোদী ২০০২ সালে যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, তার পেছনে তার হাত ছিল বলে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে। ঐ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি অযোধ্যা থেকে ট্রেনে করে একদল হিন্দু সন্যাসি গোধরায় আসছিল। সেখানে ট্রেনটিতে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিলে ৫৮ জন সন্যাসির মৃত্যু হয়। রটিয়ে দেয়া হয় ট্রেনে আগুন দিয়েছে মুসলমানরা। মুহূর্তে গুজরাট জুড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যায়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের হত্যার লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়ে। যেখানেই মুসলমান পায় কুপিয়ে, পুড়িয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেতলে হত্যা করে। এমনকি গর্ভবতী মহিলার পেট কেটে বাচ্চা বের করে হত্যা করে। মুসলমানদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। প্রায় দুই হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। তদন্তে বলা হয়, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয় শুধু মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিজেপি ও তার উগ্রবাদী সংগঠন কতটা মুসলমান বিদ্বেষী। যে কোনো উসিলায় তারা মুসলমান হত্যা করার উগ্র বাসনা পোষণ করে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদী গুজরাট দাঙ্গার অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করেন। তবে তার এই শাসনামলে যে মুসলমানরা নিরাপদ নয়, তা এখন দেখা যাচ্ছে। মুসলমানদের উপর ক্রামগত নিপীড়ন-নির্যাতন এবং হিন্দু বানানোর চেষ্টা চলছে।

তিন.
মুসলমানদের সাথে ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুদের আচরণে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তাদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে গরু বা পশুর জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। তাই পশুর জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মানুষ হত্যা করাকেই তারা শ্রেয় মনে করছে। এই আচরণ কি মানবিক? হিন্দু ধর্ম কি বলেছে, গরু বাঁচাতে গিয়ে অন্য ধর্মের মানুষ হত্যা করতে হবে? ভারতের নীতি যদি ধর্মনিরপেক্ষতা হয়ে থাকে, তাহলে এক ধর্মের মানুষ যা বিশ্বাস করে, তাতে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন? এটা কি তার নীতির খেলাপ নয়? হিন্দুরা যদি গরুকে মায়ের সমান মনে করে থাকে তাহলে তো তাদের গরুর চামড়ার তৈরি কোনো জিনিসই ব্যবহার করা উচিত নয়। এমনকি গরুর চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাও পরা ঠিক নয়। এতে কি গরুকে অসম্মান করা হচ্ছে না? বরং গরু মারা গেলে তার চামড়া না ছিলে মাটি চাপা দিয়ে দেয়াই উচিত। তা না করে গরুর চামড়া ছিলে রপ্তানি করছে কেন? আর সীমান্তপথে সারাবছর এবং কোরবানির সময় চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশেই বা কেন গরু পাচার করছে? ভারতে মুসলমানরা গরু কোরবানি দিলেই দোষ, আর বিশ্বের অন্যদেশে গরু জবাই করলে কোনো দোষ হয় না-এমন উদ্ভট চিন্তা নিয়ে ভারতের একশ্রেণীর উগ্রবাদী হিন্দু অন্ধের মতো ছুটে চলেছে। তাদের উদ্দেশ্য যে, গরু জবাইয়ের উসিলা দিয়ে মুসলমান নির্মূল করা, তা তাদের জয় শ্রীরাম, জয় হনুমান শ্লোগান থেকেই বোঝা যায়। তারা চাচ্ছে, ভারত কেবল হিন্দুদেরই রাষ্ট্র হবে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এই বাসনাকেই প্রকারন্তরে মোদী সরকার প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। মুখে ‘এটা উচিত হচ্ছে না’, ‘অহিংসার পথে চলতে হবে’-এসব কথার কথা বলে দায় সারতে চাচ্ছে। যারা মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-আচরণে বাধা দিচ্ছে এবং মৌলিক অধিকার হরণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভারত সরকার কেবল বলছে, কারো কোনো ভুল হয়ে থাকলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারোই আইন তুলে নেয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ যেসব উগ্রবাদী মুসলমানদের নিপীড়ন-নির্যাতন করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো কথা বলছে না। এতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে আরও প্রশ্রয় পাচ্ছে, তা ভারত সরকার বুঝেও না বোঝার ভান করছে। মূল সমস্যা সৃষ্টিকারীদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার-আচরণের অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন করছেন না। বরং পশুর উপর নিষ্ঠুরতা ঠেকানোর নাম করে পুরোপুরি ইসলামবিদ্বেষকে উস্কে দিচ্ছে। অথচ বিজেপির ক্ষমতায় আরোহনের ক্ষেত্রে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বিপুল সমর্থন ছিল। অথচ যে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের নিপীড়ন-নির্যাতন করছে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে। এর অর্থ এই, সরকার চাচ্ছে ভারতকে এই উগ্রবাদীরা হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করুক। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ভারত থেকে মুসলমানদের বের করে দেয়া হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা তো বটেই সরকারেরও কেউ কখনো হিন্দুদের এদেশ থেকে বিতাড়ন করে দেয়া কিংবা ভারত থেকে যেসব মুসলমান বাংলাদেশে এসেছে তাদের বের করে দেয়ার চিন্তা করে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে অনেক হিন্দু স্বেচ্ছায় ভারত গিয়েছে এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বিশ্বে বিরল। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ হয়েও অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে শান্তিতে বসবাস করে এই উপমহাদেশ তো বটেই অন্য কোনো দেশে তা দেখা যায় না। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে একটি শ্রেণী যে অসাম্প্রদায়িকতার জিকির তুলেছে, তারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যই ধরতে পারেনি। তাদের এই জিকির তোলার শত শত বছর আগে থেকেই যে এদেশের মুসলমানরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে সহবস্থান নিয়ে বসবাস করছে তা তারা বুঝতে পারছে না। যদি তা না হতো তাহলে বাংলাদেশে ভারতের মতো সংখ্যালঘুদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ত। অসাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান দেয়া এসব অজ্ঞ কিংবা ধান্ধাবাজ তাদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সেন্টিমেন্টের বাইরে গিয়ে কথা বলছে।

চার.
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের মতো এত আরাম-আয়েশে পৃথিবীর আর কোনো দেশের সংখ্যালঘুরা বসবাস করে-এমন নজির নেই বললেই চলে। সমান সুযোগ-সুবিধা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধাই তারা ভোগ করছে। এখানে কোনো কোটা প্রথা নেই, বৈষম্য নেই। যদি থাকত তাহলে প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি সকল স্তরের চাকরিতে ৩০ ভাগ হিন্দু সুযোগ পেত না। এই যে ৩০ ভাগ হিন্দু গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদসহ বিভিন্ন পদে সরকারি চাকরি করছে তাদেরকে কোনো জাত-পাত বা ধর্মের ভিত্তিতে চাকরি পেতে হয়নি। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রার্থীদের সাথে সমান সুযোগ পেয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকরি পেয়েছে। যদি কোটা থাকত, তাহলে তারা অবাধে এ সুযোগ পেত না। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শুধু সরকারি চাকরি নয়, বেসরকারি চাকরিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে একইভাবে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা সমান সুযোগ পাচ্ছে। কাজেই এমন উদার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বিশ্বে কি আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে? যে ভারত নিজেকে অসাম্প্রদায়িক ভাবে, সেখানে কি সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘু মুসলমান বাংলাদেশের হিন্দুদের মতো এত সুযোগ-সুবিধা পায়? কিংবা প্রথম শ্রেণীর নাগরিকত্বের মর্যাদা পায়? বাস্তবতা তো এই, ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণী বা তার নিচে বিবেচনা করা হয়। তাদের নাটক-সিনেমাগুলোয় মুসলমান চরিত্রগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, সেখানে মুসলমানদের কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। হয় নিচু স্তরের কর্মচারি, না হয় সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানো হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর রাজনৈতিক বিচ্ছিন্ন ঘটনার কারণে কদাচ হামলা হলে তাদের পাশে যেভাবে নাগরিক সমাজ ও সচেতন শ্রেণী দাঁড়ায়, তা কি ভারতে দেখা যায়? সেখানে যে ধারাবাহিকভাবে মুসলমানদের ওপর হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, জোর করে হিন্দু বানানোর অপচেষ্টা করা হয়, তার বিরুদ্ধে কি সেখানের নাগরিক সমাজ ও সচেতন নাগরিকরা দাঁড়াচ্ছে বা প্রতিবাদ করছে?

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন