শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

আঞ্চলিক স্বার্থেই সার্ককে কার্যকর রাখতে হবে

প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবি সিদ্দিক
পাক-ভারত যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে গেছে। আগামী ৯ ও ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বিকাশ সরূপ ২৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার তার কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, এ বছর ভারত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে না। বিষয়টি ভারতের সরকারী ওয়েবসাইটে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হয়। কিছুদিন আগে কাশ্মীরের উরিতে অবস্থিত সেনাঘাঁটিতে হামলার জের হিসেবে ভারত পাকিস্তানে সম্মেলনে যোগ দিতে অপারগতা প্রদর্শন করে। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশসহ অধিকাংশ সদস্য দেশ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার ঘোষণা দেয়। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে সার্কের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। তার উপর ভারত-পাকিস্তানে অব্যাহত অশান্তি দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে সার্ক। সার্কে পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তেমন কোন ঐক্য কখনোই লক্ষ্য করা যায়নি।
দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নিজেদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠিত হয়। উন্নয়নে আঞ্চলিক কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সার্ক স্থাপিত। এটি মূলত একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতার আঞ্চলিক সংগঠন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমে পূর্ণতা প্রদানই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এই দর্শনকে সামনে রেখেই ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেন। ১৯৮০ সালের মে মাসে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এ মর্মে বাংলাদেশের একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করেন। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন, এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে অর্থনীতি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কারিগরি, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহজ ও স্বাভাবিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হোক। দক্ষিণ এশীয় সাতটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা এ প্রস্তাবে প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সাড়া দেন। ১৯৮১ সালের ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল কলম্বোতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রথম পররাষ্ট্র সচিব সম্মেলনে কাক্সিক্ষত সংগঠন গঠনের ব্যাপারে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। এরপরই ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে এ অঞ্চলের সাতটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দিল্লিতে তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে মন্ত্রীবর্গ একীভূত বা যৌথ কর্মসূচি বা Integrated Programme of Action (IPA) নামে একটি প্রোগ্রাম গ্রহণ করেন। এ কর্মসূচির আওতায় সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য নয়টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়। অতঃপর ১৯৮৫ সালের ৭-৮ ডিসেম্বর ঢাকা সম্মেলনের মাধ্যমে সার্কের (SAARC- South Asian Association for Regional Co-operation) বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদিত হয় এবং তার যাত্রা শুরু হয়। সার্ক ৭টি রাষ্ট্র নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৮।
সার্কের কিছু সাফল্য তো আছেই। যেমন- সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রায়ই আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিন্ন নীতি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বা সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্কের আওতায় কৃষি তথ্যকেন্দ্র (Agricultural Information Centre), খাদ্য সুরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের কমিশন গঠন সার্কের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সাফ গেমস সার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক বিষয়। সার্ক দেশগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে UNCTAD-এর সঙ্গে সার্কের একটি সমঝোতা স্মারক, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ESCAP ও UNDP-এর সঙ্গে এগ্রিমেন্ট, অর্থনেতিক উন্নয়নের জন্য জাপানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক, শিশুদের অধিকার নিশ্চিতকরণ ও উন্নয়নের জন্য ইউনিসেফের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
SAFTA চুক্তি সম্পাদন সার্কের একটি বড় ধরনের সাফল্য। সার্কভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংযুক্তিকরণ এবং দক্ষিণ এশীয় বাণিজ্যে পারস্পরিক পক্ষপাতমূলক কাঠামো রচনার আলোকে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৯৩ সালে SAFTA স্বাক্ষরিত হয় যা ১৯৯৫ সালে কার্যকর হয়। SAFTA-এর আওতায় প্রতিটি পণ্যের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা যাচাই করে শুল্কহার কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। চাহিদাভিত্তিক একটি উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনার স্বার্থে একাধিক দেশের উৎপাদনের উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিকাশের একটি নতুন পরিবেশ তৈরি এবং একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠার গুরুত্বকে সার্ক স্বীকৃতি দিয়েছে। SAFTA-এর একটি উদ্দেশ্য হলো, ক্রমান্বয়ে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের উদারীকরণ, যার মাধ্যমে SAFTA (South Asian Free Trade Area) বা মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তোলার একটি স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। ১৯৯৭ সালের ১২ থেকে ১৪ মে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত নবম শীর্ষ সম্মেলনে ২০০১ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াকে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল এবং একটি অর্থনৈতিক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। SAFTA এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সম্পদ, সেবা, বিনিয়োগ এবং জনগণের মুক্ত যাতায়াত নিশ্চিত করবে। অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে SAFTA-এর আওতায় ২২৬ পণ্য এবং দ্বিতীয় দফায় ২০০ পণ্যের ১০% থেকে ৫০% শুল্ক কমানো হয়। এসব দিক বিবেচনায় রেখেই সার্ককে শক্তিশালী ও কার্যকর করা জরুরি। কোনো অজুহাতেই সংস্থাটি ভেঙে দেয়া কিংবা অকার্যকর করে ফেলা উচিত হবে না।
লেখক : সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন