শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
বিগত কিছুদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছে তার চেয়েও বেশি মানুষ। অভিযোগ করা হচ্ছে, আমাদের সড়ক নিরাপত্তায় পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলেই, দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, রাস্তাঘাটে গাড়ি চাপায় কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় কিংবা বলা যায় অদক্ষ চালকদের খামখেয়ালিপনার জন্য সড়ক দুর্ঘটনা শুধু বেড়েই চলেছে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তাঘাটে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অপমৃত্যুর এই মিছিল কবে থামবে, কেউ জানে না। সম্প্রতি বাস ও মাইক্রো’র সংঘর্ষে একই পরিবারের আটজন নিহত হয়েছে। কেউ বলছে, তারা ঢাকায় যাচ্ছিলেন কন্যা দেখার জন্য আবার অন্যদের ভাষ্য হচ্ছে, বিবাহের জন্যই বরযাত্রী নিয়ে তারা যাচ্ছিলেন ঢাকায়। একটি পরিবারের আটজন মানুষ যখন সড়ক দুর্ঘটনায় কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় নিহত হয়, তখন সেই পরিবারের শোক কতোটা গভীর থেকে গভীরতর হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এমন মৃত্যু যখন রাস্তাঘাটে ঘটে তখন আমরা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝে নিতে পারি, আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা কতোটা অনিরাপদ। যে পরিবারের আটজন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তাদের জন্য মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে আমরা সবাই শুধু শোকই প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু এরকম ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, তার কোন পথ খুঁজে বের করতে পারি না কিংবা করার সদিচ্ছা খুব একটা দেখাই না। বিয়ে বাড়িতে যেখানে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা, মৌলভীবাজারের সব হারানো সেই বিয়ে বাড়িতে (যে বাড়ির আটজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন) আজ শুধু বেঁচে থাকা মানুষের ক্রন্দন শোনা যায়। অভিযোগ করা হচ্ছে, শুধুমাত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে রাস্তাঘাটে এসব সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেন এসব সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার করার ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সারাদেশের মানুষ এখন সোচ্চার। মানুষ চোখের সামনে দেখছে কিভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় তাদের স্বজনরা মারা যাচ্ছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে যেমন চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায় তেমনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতিও এর জন্য দায়ী। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মনির সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আরও বেশি সোচ্চার হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে। আমাদের নাগরিক সমাজের কেউ কেউ সে সময় যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জে অলিপুর গেইটে কত যে দুর্ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেছে তার হিসাব নেই। সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, এখানে রাস্তাটির স্থানে স্থানে ভেঙে যাওয়ায় তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই সেখানে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অলিপুর স্থানটিকে মানুষ মৃত্যুকূপ বলেই অভিহিত করে থাকে। রাস্তাটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নেই। বলা হচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে রাস্তাঘাট মেরামত করার ব্যাপারে তেমন কিছুই করছে না। এক পরিসংখ্যান মতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি চালু হওয়ার পর থেকেই এই অলিপুর গেইটে ছোট বড় কয়েকশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশ সদস্যসহ প্রায় ত্রিশজন নিহত হয়েছে। প্রায় দুই হাজার মানুষ আহত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অলিপুর গেইটে সড়ক দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে পাঁচশ’রও বেশি মানুষ। জানা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি নির্মাণের সময় শায়েস্তাগঞ্জে অলিপুর বাসস্ট্যান্ডে একটি গোল চত্বর ও অলিপুর রেলস্টেশনের উপর একটি ওভারব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। গোলচত্বর নির্মাণের জন্য সরকারিভাবে জমিও অধিগ্রহণ করা হয়। অথচ রাস্তাটি নির্মাণের সময় রহস্যজনক কারণেই হোক কিংবা অন্য যে কোন কারণেই হোক, নির্মাণকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না জিও কোম্পানি মূল নকশা থেকে গোলচত্বর ও ওভারব্রিজটি বাদ দিয়ে মহাসড়কটি নির্মাণ করে। এখন সবাই বলাবলি করছে, বৃহত্তর সিলেট বিভাগের ঢাকাগামী কিংবা বিভিন্ন গন্তব্যগামী যাত্রীদের জন্য জায়গাটি বিপদজনক হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, মহাসড়কটির নির্মাণের পর থেকে অলিপুর রেললাইনের উভয় পাশে রাস্তা সবসময় ভাঙা থাকে। বর্তমান অবস্থায় রাস্তার পাথর উঠে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পাথর এমনভাবে উঠেছে যে, পাথরের নীচে যে রড থাকে সেগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্রে এ ব্যাপারে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও স্থানীয় সরকার ও জনপথ বিভাগ ভেঙে যাওয়া রাস্তা মেরামতের ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এলাকাবাসী অলিপুর গেইটে গোলচত্বর নির্মাণের দাবি প্রথম থেকেই করে আসছে। অথচ যথাযথ কর্তৃপক্ষ এলাকাবাসীর দাবি কানে তুলছে না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, কর্তাব্যক্তিরা এই রাস্তাটি মেরামত করছেন না। এলাকাবাসী এখন প্রশ্ন তুলছে, আর কতজন মানুষ মারা গেলে তাদের টনক নড়বে? আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা সভা-সেমিনারে শুধু মুখে মুখে অনেক কথা বলেন জনগণকে তারা অনেক কিছু দিয়ে দেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জনগণ অনেক কিছুই পায় না। বৃহত্তর সিলেটের এমনকি দেশের জনগণের কথা মাথায় রেখে আশা করা যায় এবার সরকার কিছু একটা করবে। সরকারের অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি বৃহত্তর সিলেট বিভাগে। বলতে গেলে আমাদের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রীর বাড়ির কাছাকাছি অলিপুর গেইটের অবস্থান। এছাড়া বৃহত্তর সিলেট বিভাগের আরও অনেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি আছেন বা সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। তাদের কি দায়িত্ব নয় এ বিষয়ে একটা পদক্ষেপ নেয়া? ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্তাগঞ্জ-অলিপুর গেইটের রাস্তা মেরামতের ব্যাপারে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবে, এলাকাবাসী সেটাই আশা করে। অপমৃত্যু কারো কাম্য হতে পারে না।
পরিশেষে বলতে চাই, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে শুধু একপক্ষকে দোষারোপ করলে চলবে না। গাড়ির চালকদের সাথে সাথে যাত্রী সাধারণকেও নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। আর যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে। কথাটা যদি সকল পক্ষ মনে রাখে, তাহলে আমরা সবাই লাভবান হবো।
লেখক : কবি, গল্পকার ও আইনজীবী
কালী বাড়ি রোড, হবিগঞ্জ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন