শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ডাক্তারদের আরও সেবামনস্ক হতে হবে

প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো: খোরশেদ আলম দুলাল
কিছু দিন থেকে ডাক্তারদের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে জীবিত শিশুকে যেভাবে মৃত ঘোষণা করার ঘটনা ঘটছে তাতে শঙ্কিত না হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। আমরা যারা পাঠক বা শ্রোতা তাদের অবস্থা বা দুশ্চিন্তার যে পরিধি তা না হয় ক’দিন পরে ভুলে যাবো, কিন্তু যাদের পরিবারে বা যে মায়ের জীবনে এ ঘটনা ঘটেছে তারা কিভাবে তা মেনে নেবেন। মানুষ জন্মালে মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই আমরা কবে মৃত্যু হবে তার জন্য বসে না থেকে সংসার জীবন সুন্দর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাই যে যার অবস্থান থেকে। এক বুক আশা নিয়ে তারা কি চিকিৎসকের কাছে যাননি সন্তানকে বাঁচানোর জন্য? কিন্তু বিনিময়ে কি পেলেন? পেলেন শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর অবহেলার যন্ত্রণা। অসহায় রোগীদের নিষ্ফল আকুতি বা নীরব প্রতিবাদ ছাড়া করার কিছুই থাকল না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের যে হারে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছে তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। সরকারি হাসপাতালগুলোও আগের মতো নেই। অবকাঠামোর উন্নতি এবং যন্ত্রপাতিও (চিকিৎসাসংক্রান্ত) যেভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে তাও আগের তুলনায় অনেক। সরকার কেন দিচ্ছে? দিচ্ছে সাধারণ জনগণ যাতে সর্বোচ্চ সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার সমাজের কোথায় তার অবস্থান নিশ্চয়ই তিনিসহ আমরা সবাই বুঝতে পারি। কী পরিমাণ সমীহ একজন ডাক্তারকে মানুষ প্রদর্শন করে তা বলাই বাহুল্য। অথচ বিনিময়ে আমরা কি পাচ্ছি? এখানে বলে রাখা ভালো, সব ডাক্তারকে একই দোষে দোষী করা যায় না। কিছুসংখ্যক অর্থলোভী চিকিৎসকের কারণে পুরো চিকিৎসক সমাজ বিব্রত হচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসক সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর সেবা দিয়ে থাকেন। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। এখানে সরকারি বেতন-ভাতা বৃদ্ধিকে ঈর্ষণীয় বলার কারণ হচ্ছে চিকিৎসকদের সরকারি চাকরি করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত চেম্বার এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসাসেবা দিয়ে আয়- রোজগার করার সুযোগ আছে, যা অন্য অনেক পেশার লোকদের নেই। যদিও তা একান্তই চিকিৎসকদের উচ্চ মেধার কারণেই সম্ভব হচ্ছে, এবং যা অতিরিক্ত পরিশ্রমেরও ফসল। একজন মানুষের মন সবচেয়ে বেশি দুর্বল থাকে যখন তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। মুমূর্ষু একজন রোগী এবং তার স্বজনদের কাছে একজন চিকিৎসক ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। ঐ মুহূর্তে রোগী এবং স্বজনরা ডাক্তারের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো বিকল্প চিন্তা করতে পারেন না, যা আর্থিক বা অন্য কোনো বিষয় হলেও। অথচ সেই ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত চিকিৎসকই মুক্ত অর্থনীতির দোহাই দিয়ে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। যেমন দেখা যায় ইদানীং চিকিৎসকরা বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার নামে অনেক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা- নিরীক্ষার কথাও লিখে দেন। কেননা তারা নির্দিষ্ট করা ল্যাবসমূহ থেকে পরীক্ষা করার ফি বাবদ নেয়া অর্থ থেকে একটা অংশ পেয়ে থাকেন। সোজা কথায় বললে বলা যায়, বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ল্যাব থেকে তারা রোগী পাঠানোর বিনিময়ে কমিশন নিয়ে থাকেন। যদি তা না হয় তাহলে তারা তাদের কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের দেয়া পরীক্ষাপত্রে কিভাবে লিখে দেন ৩০% বা ৪০% টাকা কম নেয়ার জন্য। বিষয়টা কতটা নৈতিক বা অনৈতিক একটু ভেবে দেখা দরকার। পাশাপাশি মুক্ত অর্থনীতির দোহাই দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে হারে প্রতিযোগিতা করে ডাক্তারদের বিভিন্ন উপহারসামগ্রী প্রদান করছেন তা কতটা শোভনীয়? আগে জানতাম, নতুন কোনো ওষুধ এলে তা ডাক্তারদের কাছে পরিচিত করার জন্য সেই কোম্পানির পক্ষ থেকে নমুনা হিসেবে দেয়া হতো, যা একজন চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ করে তা রোগীদের ব্যবহার করার পরামর্শ দিতেন। অথচ বর্তমানে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এমন কোনো গৃহস্থালি সামগ্রী নেই যা ডাক্তারদের দিচ্ছে না। ডাক্তাররাও তার কোনো বাছ-বিচার না করে সেই উপঢৌকনগুলো নিয়ে তাদের দেয়া নির্দিষ্ট ওষুধগুলোর গুণাগুন বিচার না করে রোগীদের ওপর প্রয়োগ করছেন। বিষয়টা কি হালকাভাবে নেয়া যায়? কেননা অন্য অনেক পেশার লোকদের চেয়ে ডাক্তারদের আমরা অনেক বেশি মানবিক বলে মনে করি সামাজিক কারণেই। দেশের অনেক প্রথিতযশা চিকিৎসককে বলতে শুনেছি, রোগীরা কেন উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যান? ভারতের চিকিৎসকদের চেয়ে দেশের চিকিৎসকদের মান কোনো অংশেই কম নয়। এ কথাটা দেশবাসীও এখন বুঝতে পেরেছে যে, দেশের চিকিৎসকরা বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় চিকিৎসকদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কম বা অভাব হচ্ছে উন্নত মানসিকতার। স্বচ্ছ মন-মানসিকতা থাকলে এই চিকিৎসক সমাজের মাধ্যমেও দেশের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো। বছরে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া রোগীদের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, কত শত কোটি টাকা ভারতে চলে হচ্ছে। একমাত্র কারণ, সেই দেশের চিকিৎসকদের সেবামূলক মনোভাব। খবর নিয়ে জানা গেছে, সেই দেশের চিকিৎসকরা সরকার নির্ধারিত ফি এবং প্যাথলজিক্যাল ল্যাবগুলো থেকে কোনো ধরনের অনৈতিক অতিরিক্ত টাকা নেন না। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও চিকিৎসকদের অতিরিক্ত কোনো ঔপঢৌকন দেয়ার মাধ্যমে ব্যবসা প্রসার করার প্রতিযোগিতায় শামিল হয় না। সম্পূর্ণ সেবামূলক মনোভাবের কারণেই তাদের ভাবমর্যাদা আমাদের দেশে এত উজ্জ্বল হয়েছে। অথচ আমাদের দেশের ডাক্তাররা একটু মানবিক ও একটু সহনশীল মানসিকতার মাধ্যমে সেই দেশের চিকিৎসকদের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বলতর হতে পারতেন। আমরা যদি সবাই সবসময় সরকারের সমালোচনা করতে থাকি তাহলে সব সমস্যার সমাধান করা সরকারের একক প্রচেষ্টায় সম্ভব হবে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এবার বাংলাদেশের মানুষ অনেকদিন পর তাদের প্রিয় মাছ ইলিশ অনেক কম বা যৌক্তিক দামে বাজার থেকে ক্রয় করতে পেরেছে। এই ইলিশের স্বাদ নেয়ার পেছনে কিন্তু সরকারি নির্দেশনার পাশাপাশি জেলে সম্প্রদায় তথা নদী-সমুদ্রে মাছ শিকারিদের অবদান অনেক বেশি। পেশায় জেলে হলেও তারা মানবিক দিক বিবেচনায় অনেকদূর এগিয়ে আছে। সঠিক সময়ে যদি তারা অর্থের লোভে জাটকা শিকার বন্ধ না করত তাহলে দেশবাসী সাশ্রয়ী মূল্যে প্রিয় ইলিশের স্বাদ নিতে পারত না। এবার এমন ইলিশ উৎপাদন হওয়ার কারণে অনেকে তা রফতানি করারও চিন্তাভাবনা করছেন। এখানে চিকিৎসকদের জেলে সম্প্রদায়ের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার কারণ ডাক্তারদের উচিৎ জেলেদের মোতো ইচ্ছাশক্তিকে প্রাধান্য দেয়া। একটু ত্যাগ করতে পারলেই অনেক কিছু সম্ভব। ইদানীং আমরা দেখছি বিভিন্ন অনিয়মের কারণে বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে। দেশীয় আইনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণও বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা এবং প্রতিবাদের মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। কিন্তু কোনো চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে বা অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তথা আইনের আশ্রয় নিলেই দেখা যায়, ডাক্তার সমাজ বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়ে জনগণকে জিম্মি করে রাখেন। অতীতে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সময় পরিবহনের ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের ঝামেলা হলেই পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘটের মাধ্যমে গাড়ি না চালিয়ে জনগণকে জিম্মি করে রাখতে। তাদেরকে না হয় বলা যায় কম শিক্ষিত হওয়ার কারণে তারা তা করে থাকে। কিন্তু চিকিৎসকরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং উচ্চশিক্ষার অধিকারী। তারা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্ভবোধ করেন, তারা কেন ধর্মঘটের মাধ্যমে রোগীসেবা বন্ধ করে দেবেন? তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার কি সাধারণ জনগণের নেই? দেখা যায়, আইনের আশ্রয় নিলেই চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ তথা তাদের রক্ষাকারী অন্যান্য সংগঠন সোচ্চার হয়ে ওঠে। কিন্তু একজন শিশু বা মুমূর্ষু রোগী যখন প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন তখন তারা কেন কোনো ভূমিকা রাখেন না? সবসময় যদি পোস্টিং বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তাহলে কি একটি সংগঠনের মানমর্যাদা থাকে? ডাক্তারদের অনেক সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন দেশবাসী আশা করে। তারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে চিকিৎসক সমাজকে উজ্জীবিত করার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এতে করে সরকারের সুশাসন এবং জনগণের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ অনেকাংশেই বৃদ্ধি পাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও একবার ব্যাংককের বামরুদগ্রাদ হাসপাতালে গিয়ে তাদের ঘোষিত বিভিন্ন প্যাকেজের মধ্যে একটিতে নিজের নাম লিখিয়ে এক ধরনের অতৃপ্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি যে ক্যাটাগরিতে নাম লিপিবদ্ধ করি সেখানে দেখা যায় রক্তের গ্রুপ, শারীরিক ওজন এবং রক্তের চাপ নির্ণয় ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। অথচ এগুলো আমাদের দেশের অনেক ডাক্তার বিনাপয়সায় করে দেন। ইদানীং ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন এমন কয়েকজন রোগীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, বিশেষ করে কলকাতায় নাকি ডাক্তাররা রোগীদের সাথে চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসা করাচ্ছেন। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে রোগীর পুরো চিকিৎসা সমাপ্ত করে দেবেন। এটা কি সম্ভব ? একজন রোগীর যখন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তখন তার চিকিৎসা কতদূর বা কী কী পর্যন্ত করা হবে তা নির্দিষ্ট করে কি বলা সম্ভব? অনেক শারীরিক জটিলতার কারণে একজন রোগীর চিকিৎসার সময় এবং আর্থিক ব্যয় অনেক কম- বেশি হতে পারে। সুতরাং এখানে নির্দিষ্ট চুক্তির বিনিময়ে কিভাবে সম্ভব চিকিৎসা করা? অথচ অনেকেই তা করছেন। শুধুমাত্র আমাদের দেশের চিকিৎসকদের ওপর বিরূপ মনোভাবের কারণে। ওপরের দু’টি বিষয় উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে দেশের চিকিৎসক সমাজ যেন রোগীদের আস্থা বাড়াতে একটু সহনশীল হয়ে রোগীসেবা করে। এতে করে বিদেশনির্ভর চিকিৎসাসেবা থেকে দেশ বাঁচবে। বাঁচবে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা। বৃদ্ধি পাবে দেশীয় চিকিৎসকদের গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা। মুক্ত অর্থনীতি তথা বিশ্বায়নের কারণে সারা বছরই তো কোনো না কোনো দিবস পালন করা হয়। এবার না হয় ‘রোগী দিবস’ পালনের মাধ্যমে শুরু করা যাক রোগীসেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধের আন্দোলন। গত ১৪ অক্টোবর বিশ্ব ডিম দিবস পালিত হয়েছে রোগী দিবস নিশ্চয়ই ডিম দিবসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন