এস এম সাখাওয়াত হুসাইন
ইসলামের ইতিহাসে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের ঘটনা যখন পড়ি তখন গা শিহরে উঠে, মনে হয় মানুষ এতো নিচে নামতে পারে! এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করত না। খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যভিচার, লুটপাট, কন্যা সন্তান জীবন্ত কবর দেয়া ছিল তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তারা নারীদের ভোগের সামগ্রী হিসেবে মনে করত। মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিল তারা। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগ মূর্খের যুগ। যাদের অধিকাংশের মধ্যে কোন সঠিক জ্ঞান ছিল না। হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর দ্বীনে হানিফের অনুসারীদের সংখ্যা ছিল খুবই নগন্য। আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন দেখি আমাদের দেশের অবস্থা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগকেও হার মানায়, তখন নিজেদের শিক্ষিত জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। আমাদের দেশে নুনের চেয়েও খুন সস্তা হয়ে গেছে। সামান্য কারণেও একজন আরেক জনকে খুন করতে দ্বিধা করে না, এমনকি পিতা-মাতাকে হত্যা করার ঘটনাও বিরল নয়। আর চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যভিচার, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, চাঁদাবাজি যেন কোনো ব্যাপারই না।
শিশুর প্রতি সহিংসতার খবরে আঁতকে উঠতে হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১০৮৫ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে ৯৭৬ জন। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ১৬১.৮১ শতাংশ, অপহরণ বেড়েছে ১৬.২৭ শতাংশ। গত বছরের ৮ জুলাই চুরির অপবাদে চার ঘণ্টা নির্যাতন করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় শিশু রাজনকে। নির্যাতনের ওই ভিডিও ধারণ করে সেটি ফেসবুকে আপলোডও করে দেয় খুনিরা। ৩ আগস্ট খুলনায় শিশু রাকিবকে মলদ্বারে কমপ্রেসারের বাতাস দিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় পরিত্যক্ত স্যুটকেস থেকে এক শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে কমপক্ষে ৫৭টি ছেঁকার দাগ ছিল। এর আগে ১৩ এপ্রিল রাজধানীর খিলক্ষেতে শিশু নাজিমকে হত্যা করে নির্যাতনের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭২৭টি, গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ১৪৪টি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৭৮টি ও ২০১৩ সালে ছিল ১ হাজার ৫১০টি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে ৮৭ শিশু। এরমধ্যে খুন ২৯, ধর্ষণ ৩৩, ধর্ষণের চেষ্টা ৮ ও অপহরণের শিকার হয়েছে ১৭ শিশু। অপহৃত ১৭ জনের মধ্যে চারজনের লাশ উদ্ধার, সাতজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এর বাইরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৩৫ শিশু। আরো ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৯ মাসে হত্যাকা-ের শিকার ১ হাজার ৮৫ ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৬ শিশু। এরমধ্যে ২০১৫ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৮৮১ শিশু। যার মধ্যে খুন ২৯২, ধর্ষণ ৫২১ ও অপহরণের শিকার ২৪৩ শিশু। ২০১৪ সালে শিশু খুন হয়েছে ৩৬৬, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯ শিশু। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ১৬১ দশমিক ৮১ শতাংশ, অপহরণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে অপহরণের পর উদ্ধারের হার বেড়েছে ৮১ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০১৫ সালে হত্যাকা-ের শিকার ২৯২ শিশুর মধ্যে ৪০ জনকে অপহরণের পর হত্যা, ৬৭ শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর লাশ উদ্ধার, ৪০ শিশুকে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা, ৩০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা ও ২৫ শিশু নিহত হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায়।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে, অথচ এই মানুষ যখন মনুষ্যত্বের পর্যায় থেকে নেমে পশুত্বের পর্যায়ে নেমে যায় তখন তাকে আর মানুষ বলা যায় না। তাকে পশু বলা হয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু এর সাহায্যে তারা চিন্তা-ভাবনা করে না। তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখে না। তাদের শ্রবণশক্তি রয়েছে কিন্তু তা দ্বারা তারা শুনতে পায় না। তারা আসলে চতুষ্পদ জন্তু তার চেয়েও নিকৃষ্ট।” সূরা আ‘রাফ : ১৭৯।
এ বছরের আলোচিত ঘটনা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকা-, দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার রিশা হত্যাকা- ও সর্বশেষ সিলেটের কলেজ ছাত্রী খাদিজার উপর ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমের নির্মম ও পৈশাচিক হামলা মধ্যযুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। এর আগেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে ছাত্র হত্যা, রাজধানীতে বিশ্বজিৎ নামের দোকানিকে প্রকাশ্য রাজপথে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মত ন্যক্কারজনক হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এসব হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে দেশের নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং কমন একটা বক্তব্য দেয়, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বলতে আমরা কি বুঝি। দৃষ্টান্তমূলক শব্দের অর্থ উদাহরণ, নজির, নিদর্শন। আমরা বলতে পারি দেখার মতো, মনে রাখার মতো। অপরাধীকে তার অপরাধের শাস্তি এমনভাবে দিতে হবে, যা দেখে অন্যরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
আসলে প্রচলিত আইনে কি অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব? এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, তনু হত্যার ঘটনা একটি আধুনিক অপরাধ। পুরনো ফৌজদারি আইন দিয়ে এর সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার সম্ভব নয়। এ ঘটনার তদন্ত করতে হবে নতুন ডিজিটালাইজইড পন্থায়। যতোই আমরা মিছিল করি না কেন, পুরনো আইন দিয়ে তা সম্ভব না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের মিল নেই। একে ঢেলে সাজাতে হবে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি আইন দিয়ে তনু হত্যার বিচার করা যাবে না।
ব্যক্তি ও সমাজকে অপরাধ মুক্ত রাখার জন্য যুগে যুগে ও দেশে দেশে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা নানা পন্থা ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। অপরাধের বিরুদ্ধে জনমতকে সচেতন করা অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া, অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রণয়ন করাÑ এমনকি অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের জন্যেও নানা রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে সমাজকে অপরাধমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না; বরং অপরাধ দমনের জন্য যত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সমাজে অপরাধীর সংখ্যা ততই বাড়ছে। এই ব্যর্থতা শুধু তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোই বরণ করছে না বরং পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
ইসলাম আল্লাহর দেয়া একমাত্র কল্যাণময় বিধান হিসেবে অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনের এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রোগের চিকিৎসার চেয়ে তার প্রতিষেধকই হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। তাই ইসলামী সমাজ অপরাধ সংঘটনের পরই কেবল তার প্রতিকারের জন্যে পদক্ষেপ নেয় না, বরং অপরাধের সুযোগ ও সম্ভবনাকে সে আগে ভাগেই বন্ধ করে দেয়। এই উদ্দেশ্যে ইসলাম মানুষের জৈবিক, প্রাকৃতিক ও মানবিক চাহিদাগুলো যেমন পূর্ণ করে, তেমনি ব্যাপক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পরিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে অপরাধের বিরুদ্ধে তাদের সচেতন করে তোলে। এরপরও কেউ অপরাধে লিপ্ত হয়ে সমাজের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করতে চাইলে ইসলাম তার বিরুদ্ধে কঠোরতর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণেও দ্বিধাবোধ করে না।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন