শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

জাতিসংঘ : সংকটে সক্রিয় ভূমিকার প্রত্যাশা

প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
বর্বর জাতি মধ্যযুগে বিভিন্ন জনপদ আক্রমণ করে সেখানকার মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচারে জর্জরিত করত আর সুযোগ পেলে তাদের যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিত। তাদের একমাত্র নীতি ছিল- জোর যার মুল্লুক তার। আজকের শিক্ষিত দুনিয়া এ বর্বর জাতির কার্যকলাপকে অসভ্যতার চরম নিদর্শন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্বর জাতি কবেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হয়, তাদের মূল বৈশিষ্ট্য-বর্বরতা যেন পরবর্তীকালের মানুষের রক্তে মিশে আছে। যুগে যুগে তাই দেখা গেছে, যখনই কিছু মানুষ তার বিকৃত স^ার্থ চরিতার্থ করতে বাধা পেয়েছে, তখনই সে তার প্রবৃত্তিতে পরিণত হওয়া বর্বরতার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছে। আমাদের আশে পাশে মাঝে মাঝেই যেমন ছোটখাটো বর্বরকে দেখতে পাই, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও মস্ত সব বর্বরকে আমরা সময়ে সময়ে দেখেছি। চেঙ্গিস খাঁ-কে দেখেছি, হিটলার-মুসোলিনীকেও দেখেছি। প্রায় অর্ধশতক ধরে বিশ্ববাসী এমন এক মহাশক্তিকে দেখে আসছে যে হায়নার মতো বিশ্বের নিরীহ শান্তিকামী ছোটখাটো দেশের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হামলার মাধ্যমে জোর করে তাদের মিত্রদের সহযোগিতায় সেসব জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চালিয়েছে। সে শক্তির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে ইরাকের উপর হামলা করে নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা করে উল্লাস করেছে, ইরাক সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। একই কাজ করেছে আফগানিস্তানেও। অসংখ্য নারীকে করেছে বিধবা, পুত্র কন্যাকে করেছে পিতৃমাতৃহারা। মা-বাবা-ভাই-বোনদের সামনে যুবকদের বুকে গুলি করে হত্যা করেছে। ইসরাইলকে দিয়ে প্যালেস্টাইনকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। লেবানন আক্রমণ করিয়ে সে দেশের নিরীহ মানুষদেরকে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রত্যক্ষ মদদে লিবিয়াকে ধ্বংস করে গাদ্দাফীকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ নীরব। এ নীরবতার কারণ কি তার জবাব কি জাতিসংঘ দেবে? ভাব দেখে মনে হয় জাতিসংঘ মার্কিন প্রভূদের কাছে যেন অসহায় শিশুর মতোই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরিত্রের কুৎসিত রূপ-বর্বরতা সম্ভবত প্রথমবার স্পষ্টরূপে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। লাখ লাখ জাপানির জীবন ও স¤পদ নিয়ে সেদিন ছেলেখেলা করেছিল। তারপর থেকেই অন্যের সর্বনাশের বিনিময়ে নিজে অস্বাভাবিক ধনতান্ত্রিক স্বার্থের খাতিরে দেশে দেশে গায়ের জোর প্রয়োগ করে চরম অসভ্যতা প্রকাশ করে এসেছে। পূর্ব এশিয়া, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও আফ্রিকার অসংখ্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সে নাক গলিয়ে সেখানকার জনজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। এভাবেই সে তার পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের যথেষ্ট প্রয়োগ করে হাজার হাজার শিশু ও বৃদ্ধসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের চিরপঙ্গু করেছে এবং স^াভাবিক জীবনধারাকে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্থ করেছে। নৈতিকতার কোনও প্রশ্ন তার বিকৃত বাসনা তৃপ্ত করতে তাকে অসভ্য আচরণে বাধা দিতে পারেনি। ১৯৬৩ সালে কেনেডি প্রশাসনের উপদেষ্টা ডিন অ্যাচেসন বলেছিলেন, আমেরিকার অবস্থান, সম্মান ও প্রভুত্বের প্রতি যে কোনও হুমকি মোকাবিলার প্রশ্নে আমাদের কাছে নৈতিকতার কোনও মূল্য নেই। সারা বিশ্বের উপর প্রভুত্ব স্থাপন করার কথাটাই আসলে তার কাছে মূল প্রশ্ন। এ ব্যাপারে সামান্য বাধা তাকে হিংস্র করে তোলে।
জাতিসংঘ আজ এক কাকতাড়ুয়ায় অবনমিত। দুর্বল দেশগুলোই তাকে মান্য করে। এ সংস্থাটির প্রাধান্য বজায় রাখতে মরিয়া (?) কোফি আন্নানের পর বান কি মুন-এর করুণ প্রয়াস নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রের গর্জন বলে প্রতিভাত হচ্ছে। আমাদের মনে আছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে লিগ অব নেশনস গঠিত হয়েছিল (১৯২০)। কিন্তু এর দুর্বল নেতৃত্বের পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা পৃথিবীকে গ্রাস করেছিল। পুনরায় আতঙ্কিত মানুষ জাতিসংঘ গঠন করলো, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বাত্মক ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। কিন্তু আজ তার অস্তিত্বেরই সংকট দেখা দিয়েছে। বলিষ্ঠভাবে এর টিকে থাকার এখন একটাই প্রাথমিক শর্ত- আমেরিকার প্রচ- চাপের কাছে নতি স^ীকার না করে দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় মানব জাতির একমাত্র বাসস্থান আমাদের এ পৃথিবী এক অরাজকতাময় স্থানে রূপান্তরিত হয়ে পড়তে বাধ্য। দেশে দেশে জাতি-দাঙ্গা হয়ে উঠবে রোজকার ঘটনা। এদিকে, পৃথিবী দুটো যুযুধান গোষ্ঠীতে বিভক্ত হতে যাচ্ছে যা বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাবস্থা। মনে হচ্ছে, খুব দ্রুত পৃথিবী তার আদিম যুগে ফিরে যাবে।
কিন্তু সভ্যতা শুরুর পূর্বের আদিমতা আর আজকের আদিমতায় রাতদিনের ফারাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পারমাণবিক, রাসায়নিক, জৈবিক ইত্যাদি হাতিয়ারে বলীয়ান আধুনিক আদিমতা সৌরম-লের এ গ্রহটিকে এক লহমায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর ‘মানুষের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে?’ শীর্ষক গ্রন্থে সম্ভাব্য এ ধ্বংসলীলার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গেছেন। তাছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার নিরোধক চুক্তির হয়ত আর কোনও মূল্যই থাকবে না। যার যেমন খুশি অস্ত্র বানিয়ে যাবে আর তার ব্যবহারও করবে।
ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়া যুদ্ধে মজুত অস্ত্র ব্যবহার করে বুশ সাহেব দেশের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গুদাম অনেকটা হালকা করে দিয়েছিলেন। এখন ওবামা প্রশাসন নব উদ্যমে নবতম কৌশলযুক্ত করে মারণাস্ত্র তৈরি করতে মনোনিবেশ করেছেন। সব দেখে মনে হয়, পৃথিবী আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এবং মারণাস্ত্র প্রয়োগের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। এ সম্ভাব্য যুদ্ধ শেষে আর কারও কিছু বলার হয়ত থাকবে না। এ গ্রহে তখন বিরাজ করবে শুধু শূন্যতা ও নিস্তব্ধতা। তাই ধারণা হয়, পৃথিবী আজ সত্যিই বড় বিপন্ন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন