মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী : মুসলিম সাংবাদিকতার অগ্রদূত

প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এসএম সাখাওয়াত হুসাইন
গত ২৪ অক্টোবর ছিলভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ৬৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ১৮৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের বোরবার চট্টগ্রাম জেলার বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার বরমা-আড়ালিয়ার চর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুন্সি মতিউল্লাহ প-িত। মাতার নাম রহিমা বিবি। চট্টগ্রামের আরেক নাম ইসলামাবাদ। সেই হিসেবে মাওলানা তার নামের সাথে ইসলামাবাদী গ্রহণ করেন। শৈশবে কোরআন শিক্ষা ও বাল্য শিক্ষা পাঠের মাধ্যমে তার প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। তার পিতা ছিলেন ফার্সি ভাষায় সুপ-িত। তিনিও ঘরোয়া পরিবেশে ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। লেখা পড়ায় তার অদম্য আগ্রহের কারণে তার পিতা তাকে কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি হুগলী সরকারি মাদ্রাসায় ভার্তি হন। ১৮৯৫ খিস্ট্রাব্দে হুগলী মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল স্যার ডেলিনন রস ও অধ্যাপক এ এইচ হালী তার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও নিজ চেষ্টায় বাংলা শেখেন। তাছাড়া আরবী, উর্দূতেও যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। মাওলানা ইসলামাবাদী উচ্চশিক্ষা শেষে প্রথমে রংপুর হারাগাছা মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। সে সময় বাংলা- আসামে বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা স্থাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কলকাতা থাকাকালীন সময়ে মাওলানা জৈনপুরীর আদর্শে ইসলাম প্রচার, স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের আদর্শে মুসলিম জাগরণ, নওয়াব আব্দুল লতিফের আদর্শে শিক্ষা বিস্তার ও জামাল উদ্দিন আফগানীর আদর্শে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধে অনুপ্রাণিত হন এবং তার আলোকে কর্ম জীবন শুরু করেন। পরে তিনি চট্টগ্রামের সীতাকু- মাদরাসার প্রধান হিসেবে কিছুকাল চাকরি করেন। সেই সময় মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত পত্রিকা মিসরের আল মিনার, আল-ইহরাম, আল-বিলাদে আরবি ভাষায় তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় নিয়মিতভাবে। বহু উর্দু ও ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকায়ও ইসলামাবাদীর মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। অর্থভাবে সোলতান পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গলা, ইসলাম মিশন, খাদেমুল ইনসান সমিতি, কৃষক-প্রজা সমিতি, শিক্ষক সমিতি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপনসহ সমাজ সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তিনি আরব বিশ্বের বিখ্যাত ফার্সি ভাষার পত্রিকা দৈনিক হাবলুল মতিন’-এর বাংলা সংস্করণ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে মাসিক ইসলামাবাদ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯০৩ খিস্টাব্দে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে নিয়ে কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক সুলতান পত্রিকা প্রকাশ করেন। অনেক চড়াই উৎরাই এর পর ১৯২৬ খিস্টাব্দে সাপ্তাহিক সুলতান দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইসলামাবাদী ও অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় আঞ্জুমানে উলামায়ে বাংলা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি ছিলেন তার যুগ্ম সম্পাদক। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম কন্ফারেন্সের আয়োজন করেন। ১৯০৬ খিস্টাব্দে তার প্রচেষ্টায় মুসলিম সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১২ খিস্টাব্দে তিনি হাবলুল মতিন পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯১৫ খিস্টাব্দে আল ইসলাম পত্রিকা প্রকাশে মুখ্য ভূমিকা রাখেন এবং সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মাওলানা রাজনৈতিকভাবে প্রথমদিকে কংগ্রেসের সাথে জড়িত থাকলেও পরবর্তীতে ১৯২১ খিস্টাব্দে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৯ খিস্টাব্দে দৈনিক আমির পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২৯ সালে মাদরাসা ছাত্রদের দাবি আদায়ের লক্ষে আসাম-বেঙ্গল জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ খিস্টাব্দে কৃষক প্রজা পার্টির মনোনয়নে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য আইন সভা থেকে প্রাপ্ত ভাতা তিনি কবি- সাহিত্যিকদের কল্যাণার্থে বিতরণ করেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের কদম মোবারক সংলগ্ন এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লক্ষে ১৯৪২ সালে বাংলা- আসামের মুসলমানদের সহায়তায় তিনি গোপন বিপ্লবী দল প্রতিষ্ঠা করেন। ন্যায়নীতি ও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য মাওলানা ইসলামাবাদী ভারতীয় বিখ্যাত নেতা মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে দিল্লির লাল কেল্লায় বন্দি ছিলেন ১৯৪৪ সালে বৃটিশরা তাকে বাংলা থেকে বহিষ্কার করে লাহোর কারাগারে আটকে রাখে। ১৯৪৫ সালে তিনি মুক্তি পান।
চট্টগ্রামের কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা, কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা স্কুল তারই প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের দক্ষিণ মহকুমার কর্ণফুলীর তীরবর্তী দেয়াং পাহাড়ে জাতীয় আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তার আজীবন। ১৯১৫ সালে তিনি সেই লক্ষ্যে সরকার থেকে ৬০০ বিঘা জমি ও ওই এলাকার জমিদার আলী খান থেকে ৫০০ কানি ভূমি রেজিস্ট্রিমূলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গ্রহণ করেছিলেন। বিখ্যাত নেতা ও শিক্ষাবিদ শেরেহিন্দ মাওলানা শওকত আলী এ আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন। জঙ্গে জিহাদ শাহ বদিউল আলম শাহ জুলফিকার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবল সমর্থক হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার লক্ষ্যে ঐ সময় চট্টগ্রামে থাকতে রাজি হন। দেয়াং পাহাড়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ স্থান পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হন ভারতীয় সেরা রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আকরাম খাঁ, মুন্সী রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী। মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য এবং তাদের মধ্যে আত্মসচেতনাবোধ সৃষ্টির মানসে তিনি ব্যাপক লেখালেখি শুরু করেন। জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমায় তিনি ৪২ টির মত গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ১. ভারতে মুসলিম সভ্যতা ২. সমাজ সংস্কার ৩. ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান ৪. ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান ৫. ভারতে ইসলাম প্রচার ৬. সুদ সমস্যা ৭. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান (৩ খ-ে) ৮. ইসলামী শিক্ষা ৯. কোরআন ও বিজ্ঞান ১০. আত্মজীবনী ইত্যাদি উল্লেযোগ্য। মুসলমানদের হাত থেকে ভারতবর্ষের ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার পর মুসলমানেরা ইংরেজদের চরম দমন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অভ্যুত্থান স্থবির হয়ে পড়ে। সে সময় মুসলিম সমাজ এক দুর্বিষহ অবস্থায় নিপতিত হয়। জাতির সেই দুর্দিনে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের সাথে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এগিয়ে আসেন। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ইংরেজদের উগ্র মনোভাব কিছুটা স্থিমিত হয়ে আসে। প্রকৃতপক্ষে মাওলানা ছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের জাগরন, স্বাধীনতা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অন্যতম শীর্ষ নেতা। তার সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে তিনি মুসলিম জাতিকে সচেতন করতে সচেষ্ট হন। মুসলিম জাগরনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ মাওলানার কর্মজীবন ছিল ঘটনাবহুল ও বৈচিত্রময়। তিনি একাধারে রাজনীতিক, ইসলাম প্রচারক, লেখক, সাংবাদিক, সমাজসেবক, বিশিষ্ট বাগ্মী ও সমাজ সংস্কারক। তিনি ছিলেন মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ও মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতার অন্যতম পথ প্রর্দশক। তিনি ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।
লেখক : সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন