শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

সালাত দর্শন : একটি তাত্ত্বিক সমীক্ষা

সত্যালোকের সন্ধানে

প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইসলামে নামাযের মর্তবা :
ইসলামপূর্ব যুগে দুনিয়ার বুকে এমন কোন মাযহাবের উদ্ভব ঘটেনি, যেখানে নামাযকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু যেহেতু সেই মাযহাবগুলো ছিল নির্দিষ্ট কওম, গোত্র এবং সময়ের সাথে সম্পৃক্ত, এজন্য তাদের মাঝে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব জারী ছিল। সুতরাং ইসলামের পূর্বে দুনিয়ার কোন মাযহাবের নামাযে প্রাণশক্তি অর্থাৎ আল্লাহর সামনে আনুগত্যের স্বীকৃতি এবং তাঁর হামদ ও সানাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধারার নিয়ম ছিল না। তাছাড়া কোরআনুল কারীমের বর্ণনা অনুসারে জানা যায় যে, দুনিয়াতে এমন কোন নবীর আগমন ঘটেনি, যাকে নামাযের হুকুম দেয়া হয়নি এবং তিনি স্বীয় উম্মতকে নামাযের জন্য তাকিদ করেননি। কিন্তু তাদের বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যে, একমাত্র ইসলাম ছাড়া নামাযের সত্যিকার বিন্যাস ও আদায়ের প্রকৃতি কারো মাঝে অবশিষ্ট ছিল না। একারণেই হযরত মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) খাতেমুল আম্বিয়া এবং খাতেমুল কুতুব হয়ে দুনিয়ায় আগমন করেছেন। তাই নামাযের ফরজিয়াতকে পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলামে এমন সুন্দর, সুষ্ঠু ও সুবিন্যস্ত আকারে সমুজ্জ্বল করা হয়েছে, যেন তার রোজ কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে দায়েম ও কায়েম থাকে।
নামায ইসলামের এমন একটি ফরজ কাজ যা কোনও বিবেকবান সচেতন মুসলমান কখনো বিস্মৃত হতে পারে না। কোরআনলু কারীমের একশতেরও অধিক স্থানে নামাযের সংজ্ঞা এবং তা আদায় করার নির্দেশ তাকিদসহ প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং তা আদায় করার মাঝে শৈথিল্য ও কাহিলী প্রদর্শন করা মোনাফেকীর আলামত এবং তা বর্জন করা কুফুরীর পর্যায়ভুক্ত বলে বলা হয়েছে। যখন তারা নামাযের জন্য উঠে, তখন কাহিল ও অলস হয়ে উঠে। (সূরা নিসা)। অনুতাপ ঐ নামাযীদের জন্য যারা স্বীয় নামাযে গাফলতী করে।” (সূরা মাউন)। তাছাড়া নামাযের ফরজিয়াত ইসলামের প্রারম্ভেই আরোপিত হয়েছিল এবং এর পরিপূর্ণতা সেই রাতের অনুষ্ঠানে হয়েছিল যাকে মি’রাজ বলা হয়। কাফেরদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, “তোমরা কেন দোযখে এসেছ? তারা উত্তর করবে, “আমরা নামায আদায়কারী ছিলাম না।”(সূরা মুদ্দাসসির)
ইসলামের প্রথম ফরজ হচ্ছে ঈমান ও এর উপকরণাদি। এরপর দ্বিতীয় ফরজ হচ্ছে নামায। সূরা রুম : রুকু-১৪-এর মাঝে সর্বপ্রথম হুকুম দেয়া হয়েছে, “স্বীয় মুখম-ল সকল দিক হতে ফিরিয়ে নিয়ে দ্বীনে তাওহীদের উপর স্থির রাখ, এটাই আল্লাহর বিধান, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” তারপর এরই সংশ্লিষ্ট দ্বিতীয় হুকুম হচ্ছে, “এই নামাযকে কায়েম রাখ এবং অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” এই আয়াতে কারীমার দ্বারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিস প্রতিপন্ন হয় তাহলো নামায পরিহার করা দ্বারা কুফুর ও শেরেকের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আন্তরিক অবস্থাকে বাহ্যিক কর্মকা-ের দ্বারা পরিবর্তিত করতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত সেই অবস্থার অপসারণ হওয়ার আশংকা ও ভয় লেগেই থাকবে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাযের গুরুত্বের উপর সর্বদাই নির্দিষ্টভাবে জোর দিতেন এবং বর্জনকারীর উপর শেরেক ও কুফরের ভয় প্রদর্শন করতেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ নামায দ্বীনের স্তম্ভ”। স্তম্ভ ধসে পড়লে যেমন ইমারত ধসে পড়ে, তদ্রুপ নাময ছেড়ে দিলেও আন্তরিক দ্বীনদারী বিদায় হয়ে যায়। তায়েফের প্রতিনিধিদল মদীনায় আগমন করে যখন আপোস মীমাংসার কথাবার্তা শুরু করলো তখন তারা নামায, জিহাদ এবং দান-খয়রাতকে বাদ দিতে চাইলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) জিহাদ এবং দান-খয়রাত হতে তাদেরকে মুক্তি দিলেন, কিন্তু নামায সম্পর্কে বললেন, “যে দ্বীনে আল্লাহর সম্মুখে মস্তক অবনত হওয়া নেই, তার মাঝে কোন কল্যাণও নেই।” তিনি আরো বলেন, “নামায হচ্ছে অন্তরের আলো।” নিজের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, “নামায হচ্ছে আমার চোখের শান্তি।” একটি উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন, “মানুষ আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু নামায দ্বারা সে আগুন নিভে যায়।” এ হচ্ছে চিরন্তন বন্ধুর বিরহ-বিচ্ছেদের আগুন এবং নামায হচ্ছে ঠা-া পানি, যা আগুনকেও ঠা-া করে দেয়। তিনি অন্যত্র বলেছেন, “ কুফর এবং ঈমানের মাঝে নামাযই হচ্ছে পার্থক্য নির্ধারক সীমা-রেখা। কেননা ঈমান এবং কুফর উভয়টিই হচ্ছে, মানুষের আভ্যন্তরীণ অবস্থার সাথে জড়িত। যার প্রকাশ ঘটে কাজের মাধ্যমে। মুসলমানদের যে কাজটি দিনে বার বার প্রত্যক্ষ করা যায়-তা হচ্ছে নামায। ঠিক ঐ সময় যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র হায়াতের শেষ মুহূর্ত ছিল এবং নবুওতের দায়িত্বের সর্বশেষ হুকুম যা তাঁর পবিত্র জব হতে বেরিয়েছিল, তা হচ্ছে, “নামায এবং গোলাম।” (এ সকল হাদীস কান্জুল উম্মাল : কিতাবুস সালাত, ৪র্থ খ- হতে চয়নকৃত)
নামাযের হাকীকত :
নামাযের জন্য যে আসল আরবী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে; তাহলো সালাত। আরবী এবং ইবরানী ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে দোয়া। এজন্য নামাযের শাব্দিক বিশেষত্ব হচ্ছে আল্লাহর নিকট দরখাস্ত ও প্রার্থনা করা এবং আভ্যন্তরীণ হাকীকতও একই। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)-ও নামাযের এই বিশ্লেষণই করেছেন। মুয়াবিয়া বিন হেকাম সালমী (রা.) ছিলেন একজন নয়া মুসলিম সাহাবী। তাঁকে ইসলামের যে আদব পালন করতে বলা হয়েছিল এর মাঝে এই একটি বস্তুও ছিল যে, যদি কোন মুসলমানের হাঁচি উঠে এবং সে আল-হামদু লিল্লাহ বলে, তাহলে এর উত্তরে তোমাদের উচিত ‘ইয়ারহামু কাল্লাহ’ বলা। একবার ঘটনাক্রমে জমাতে নামায আদায় হচ্ছিল। মুয়াবিয়া (রা.)-এর মাঝে শামিল ছিলেন। তাঁর নিকটবর্তী কোন মুসলমানের হাঁচি আসল। মুয়াবিয়া নামাযে থেকেই “ইয়ারহামু কাল্লাহ’ বলে ফেলল। সাহাবীগণ তাঁকে তিরস্কার করলেন, মুয়াবিয়া (রা.) নামাযরত অবস্থায়ই বললেন, কেন তোমারা আমাকে তিরস্কার করছ? সাহাবীগণ উরুদেশে হস্ত দ্বারা প্রতিহত করলেন এবং সোবহানাল্লাহ বললেন। তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, কথা বলাকে নিষেধ করা হচ্ছে। নামায শেষ হলো। রাসূলুল্লাহ (সা.)-জিজ্ঞেস করলেন নামাযের হালতে কে কথা বলেছে? লোকজন হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর দিকে ইশারা করলো। তিনি তাকে কাছে ডেকে নিলেন এবং বিন¤্র ও কোমলতার সাথে বুঝিয়ে বললেন যে, কোরআন পাঠ করা, আল্লাহকে স্মরণ করা এবং তাঁর পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করার নাম সালাত বা নামায। এখানে মানুষের কথাবার্তা বলা ঠিক নয়। (সূনানে আবু দাউদ)
হযরত আনাস (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, “দোয়া এবাদতের সারবস্তু।” হযরত নু’মান বিন বশীর আনসারী (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একথা বলেছেন, “তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন।” এর স্বপক্ষে তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন, যেখানে দোয়াকেই এবাদত বলা হয়েছে। (সূনানে আবু দাউদ : কিতাবুস সালাত এবং জামে তিরমিজী : কিতাবুদ দাওয়াত। আবু দাউদ : কিতাবুস সালাত : মোস্তাদরেকে হাকেম : কিতাবুদ দোয়া)
আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “তোমরা আমার কাছে দোয়া কর, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব এবং যে ব্যক্তি আমার এবাদতের প্রতি বিরোধিতা করে, সে সত্বর জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (মোস্তাদরেকে হাকেম কিতাবুদ দোয়া) কিতাবে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সর্বোত্তম এবাদত হচ্ছে দোয়া।” তারপর তিনি উল্লিখিত আয়াত পাঠ করলেন।
কোরআনুল কারীমে হযরত মূসা (আ.)-এর কাহিনী বর্ণনার প্রাক্কালে নামাযের হাকীকতকে শুধুমাত্র একটি শব্দের দ্বারা তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ‘আল্লাহর স্মরণ’। ইরশাদ হলো, “আমার স্মরণের নিমিত্ত নামায কায়েম কর।” প্রকৃত কামিয়াবী ও সফলতা ঐ ব্যক্তিই লাভ করবে, যে আল্লাহকে স্মরণ করে নামায আদায় করে। ইরশাদ হচ্ছে, “সেই ব্যক্তি কামিয়াবী অর্জন করেছে, যে পবিত্রতা হাসিল করেছে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করেছে এই নামায আদায় করেছে।” (সূরা আ’লা : রুকু-১)।
মানুষ যখন স্বীয় রুহানী প্রভঞ্জন, আন্তরিক অশান্তি, কলবের পেরেশানী এবং মানসিক শোরগোলের সময় দুনিয়া এবং দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু, নশ্বর বুদ্ধির প্রতিটি পদক্ষেপ বেকার, শরীরের যাবতীয় শক্তি অচল এবং সালামতির সকল পথ বন্ধ দেখতে পায়, তখন শান্ত ও নিরাপত্তার স্পর্শ সে কেবলমাত্র সেই সর্বশক্তিমানের স্মরণ, আহ্বান ও প্রার্থনার মাঝেই লাভ করতে পারে। অহীয়ে ইলাহী-এর তাৎপর্যকে এসকল শব্দে বিবৃত করেছেন-হ্যাঁ আল্লাহর স্মরণেই অন্তর শান্তিলাভ করতে পারে।” (সূরা রুম)। কারণেই বিপদের ঘনঘটা, বেদনার তীব্রতার অবস্থায় দৃঢ়পদক্ষেপ এবং দোয়া একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। ইরশাদ হচ্ছে “দৃঢ় পদক্ষেপ ও নামাযের দ্বারা স্বীয় মুসিবতের সময় সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৫)। যমীন হতে শুরু করে আসমান পর্যন্ত সৃষ্টজগতের প্রতিটি বালুকণা, সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে অবনত রয়েছে। আসমান, জমিন, চাঁদ-সুরুজ, নক্ষত্র, সাগর, পর্বত, ঝাড়-জঙ্গল, ভূ-চর, খেচর সবকিছুই তাঁর সামনে সেজদাবনত এবং তার নির্দিষ্টকৃত আহকাম ও নিয়মাবলী বিনা দ্বিধায় পালন করে যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে তাদের তাসবীহ ও নামাজ। ইরশাদ হচ্ছে, “এ পৃথিবীতে এমন কোন বস্তু নেই যে তাঁর পবিত্রতার তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা সেগুলোর তাসবীহ বুঝতে পার না।” (সূরা বনী ইসরাঈল : রুকু-৫)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, “তমি কি প্রত্যক্ষ করনি যা যমীনে আছে এবং যা আকাশে আছে এবং চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পর্বত ও বৃক্ষরাজি, চতুষ্পদ জন্তু এবং অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য তাঁরই সকাশে প্রণত হয় এবং এগুলোর অধিকাংশের উপর আজাব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, (যেহেতু তারা আল্লাহকে সেজদাহ করত না)।” (সূরা হজ্জ : রুকু-২)
স্মর্তব্য যে, বিশ্ব-প্রকৃতির অণু-পরমাণু বিনা দ্বিধায় আল্লাহর প্রতি অবনত রয়েছে। কিন্তু বিভেদ শুধু মানুষের মাঝে। যারা উত্তম তারা সেজদাহ করে এবং তাদের অধিকাংশই সেজদাহ বিমুখ। তাই তারা শাস্তিযোগ্য হয়েছে। মানুষ ছাড়া সকল মাখলুকাত নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহর প্রতি অনুগত। কেননা, এসকল মাখলুক স্বীয় ইচ্ছা ও আকাঙ্খার অধিকারী নয় আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সৃষ্টির শুভলগ্ন থেকেই তারা নিজেদের কাজে ব্যাপৃত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত ব্যাপৃত থাকবে। কিন্তু মানুষ স্বীয় ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা-শক্তির একটি বিন্দু লাভ করে, বিরোধিতা ও বিদ্রোহে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইসলামের নামায এই বিরোধী, অবাধ্য এবং বিদ্রোহী মানুষকে অন্যান্য মাখলুকাতের মতো আনুগত্য, ও প্রাণোৎসর্গ এবং বন্দেগীর দাওয়াত পেশ করে। দুনিয়ার যাবতীয় মাখলুকাত নিজ নিজ শক্তি সামর্থ্য ও ধ্বনি প্রকাশের মাধ্যমে আল্লাহর হামদ ও সানা এবং তাসবীহ ও তাহলীল পাঠে নিরত থাকে। এমতাবস্থায় মানুষ কেন স্বীয় প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করে। নিজের আনুগত্য প্রকাশ করবে না? কেন নিজেকে আল্লাহর সকাশে সমর্পণ করবে না? এ সমপর্ণের ব্যবহারিক প্রক্রিয়াই হচ্ছে নামায।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন