কালাম ফয়েজী
ভোলায় বসবাসকারীরা এখন এক সমস্যা কবলিত জনপদের মানুষ। নিজ ভিটে মাটি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করি বলে অনেকে নিত্যদিনের কষ্টটা স্বচক্ষে দেখি না, হৃদয় দিয়ে অনুভব করি না এবং দুঃখ দূর করার জন্য উদ্যোগও গ্রহণ করি না। ভাবখানা এমন, ঐটা বড়দের কাজ, বড়রা দেখবে। আমরা ক্ষুদ্ররা দেখবো কি? আমাদের চিন্তা করাও প-শ্রম ছাড়া আর কি? কিন্তু আপনার যেখানে জন্ম, যে গ্রাম থেকে উঠে এসে স্বর্গ স্পর্শ করেছেন, আপনার কি একবারও সে গ্রামের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয় না?
আমরা বেশিরভাগ কাজ করি বাধ্য হয়ে। মনের টানের চেয়ে বাহ্যিক প্রয়োজনকেই গুরুত্ব দেই। আমরা অফিসে যাই অফিসের নিয়মে। টেবিলে কিছু কাজ জমা থাকে। সে কাজটা না করলেই নয়। বস এসে ধমক দিবেন। জানতে চাইবেন ফাইলটা ছাড়া হলো কি না? আমরা তখন তাড়াহুড়া করে ফাইল প্রস্তুত করি। কিন্তু যদি আগে থেকে সময় নিয়ে কাজটা করতাম তাহলে ধমক খাওয়ার দরকার হতো না। তেমনি আমাদের কেউ কেউ ভোটের প্রয়োজনে জনগণের কাছে যান বলে তাদের সমস্যার কথা বলেন এবং মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সমস্যাগুলো সমাধানের ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন। কিন্তু সুযোগটা হস্তগত হওয়ার পর আর সেদিকে ফিরেও তাকান না। সমাধানের কথা তো মনেই থাকে না। ফলে জনম জনম ধরে সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়।
আমাদের একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, বড় বড় সব কাজ সরকারই করবে। আমরা যারা অধীনস্থ নাগরিক আমাদের দায়িত্ব হলো প্রজার মতো চেয়ে চেয়ে দেখা এবং রাজা বা সরকারের তারিফ করা। বলতে কি যদি ক্ষুদ্র রাস্তার একটা সø্যাপও ভেঙে যায় সেটা মেরামতের জন্য আমরা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। অথচ একটা সø্যাপ ঠিক করতে কয় টাকা লাগে? তার চেয়ে বহু গুণ টাকা এমনি নষ্ট হয়ে যায় না? অবশ্য ভোলার নদী ভাঙন প্রতিরোধের মতো একটা বিশাল বাজেটের কাজ সরকারি সাহায্য ছাড়া করা সম্ভব না ঠিক, তবু ব্যক্তি উদ্যোগ বা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা যে একেবারে মূল্যহীন সেটাও বলা যাবে না। একজনে উদ্যোগ না নিলে দশজনে উদ্যোগী হবে কেমন করে!
আমাদের শৈশবে দেখেছি বড় বড় পীর-ফকিরদের ডেকে আনতে। দৌলতখাঁ ঈদগাহে প্রতিবছর জৈনপুরের পীর সাহেব ঈদের নামাজ পড়াতেন। আজকের কিশোরগঞ্জের সোলাকিয়ার মতো সেকালে দৌলতখাঁ ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য সারা ভোলার আগ্রহী মুসল্লীগণ সমবেত হতেন। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না জেনেও লোকজন বহু দূর-দূরান্ত থেকে একত্রিত হতে মোটেই কার্পণ্য করতেন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিবছর পীর সাহেব নদী ভাঙন রোধের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইতেন এবং সকলকে নিয়ে দোয়া করতেন। এ রকম দোয়ার ফলে অনেক স্থানে নদীর ভাঙন ঠেকে যায়। কিন্তু দৌলতখানের ভাঙন ঠেকেনি। এতে অসংখ্য সমৃদ্ধ জনপদ, ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ, ঐশ্বর্যশালী বাড়িঘর, উর্বর ভূমি, নজরকাড়া সুদৃশ্য সুপারি বাগান নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এরপরও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তখন ভুক্তভোগী জনগণ দাবি তোলে এবং রাজনৈতিক নেতারাও ভোটের স্বার্থে প্রতিশ্রুতি দেন। পারলে যেন তক্ষুণি নদী ভাঙন ঠেকিয়ে ফেলেন আর কি!
ভোলা যদিও মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন একমাত্র জেলা, কিন্তু এ জেলা কখনো অবহেলিত ছিল না। সেই ব্রিটিশ আমল অর্থাৎ যতদূর পেছনে আমাদের চোখ যায়, সেই থেকে ভোলার কর্তৃত্বকারী লোকজন নিজ পিতৃভূমির পক্ষে কম-বেশি কাজ করে আসছেন। ১৯৩৫ সালে হোমরুলের অধীনে যে নির্বাচন হয়, ভোলা তখন একটি সংসদীয় আসনের অধীন। কেবল পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক নির্বাচনের স্বার্থে এর আসন সংখ্যা বাড়িয়ে চারটি করা হয়। সেই আমলে যারা ভোলার পক্ষে কথা বলেন, তারা হলেন খানবাহাদুর নূরুজ্জামান, কবি মোজাম্মেল হক, তোফায়েল আহমদ চৌধুরী, ফরমুজল হক, মন্ত্রী আজিজুদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী আব্দুল হাই প্রমুখ। নির্বাচিত এসব জাতীয় নেতৃবর্গ বিভিন্ন সময়ে ভোলার প্রতিনিধিত্ব করেন, করছেন।
১৮৪৫ সালে দৌলতখাঁয় যখন মহকুমা সদর স্থাপিত হয় তখন ভোলা ভূখ- ছিল বৃহত্তর নোয়াখালীর অধীন। তখন নোয়াখালী ও ভোলার মধ্যখান দিয়ে প্রবাহিত যে মেঘনা নদী সেটা ছিল নিতান্তই সরু। লোকজন এমনও বলেছেন, ওপারে আজান দিলে এপার থেকে শোনা যেতো। অথবা রাখাল বালকরা ভোলার চরে সারাদিন মহিষকে ঘাস খাইয়ে সন্ধ্যায় সে মহিষ নিয়ে মেঘনা পাড়ি দিয়ে ওপার চলে যেতো। অথচ সেই সরু স্রোতস্বিনী মেঘনা কীভাবে রাতারাতি এমন বিশাল রাক্ষুসী মেঘনায় পরিণত হলো, সেটাই ভাববার বিষয়।
১৯৫০ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পে মেঘনার মাঝামাঝি নতুন চর জেগে ওঠে। তখন দেশ ছিল পাকিস্তনের অধীন। দেশের এত দক্ষিণের অবহেলিত অঞ্চলে কখনো শাসকদের নজর যেতো না। যেমন দৃষ্টি পড়েনি ১৯৭০ সালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের অব্যবহিত পরেও। ওলন্দাজ-মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণে ঐ জনপদ বিরাণ হোক বা ঝড় জলোচ্ছ্বাসে সব লোক ভেসে যাক অথবা ভূমিকম্পে পুরো এলাকা তলিয়ে যাক সেটা নিয়েও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারো মাথাব্যথা ছিল না। তাছাড়া তখন ড্রেজিং ব্যবস্থাও এমন উন্নত ছিল না যে, ড্রেজিং করে নতুন জেগে ওঠা চর কেটে পানির স্রোতের সঙ্গে ভাসিয়ে দেয়া হবে। যদি দেয়া যেতো তাহলে নদীর গতিপথ আগের মতই স্বাভাবিক থাকতো। সেটা যখন সম্ভব হলো না, তখন অস্বাভাবিক পন্থায় নদী নিজেই তার গতিপথ তৈরি করে নিল। শুরু হল দুইকূল ভাঙনের পালা। নদীর ¯্রােত বৃদ্ধি পাচ্ছে, দু’কূল ভেঙে মধ্যখানের চরের পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চরের পরিধি যত বাড়ে, বিপরীত দিকের নদী ভাঙন ততই প্রবল হয়। দেখতে দেখতে ভোলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম, ইউনিয়ন, জেলার প্রাচীন ভূখ- ভেঙে যেতে থাকলো নদীর খর¯্রােতে। এভাবেই ঐতিহাসিক চৌকিঘাট, নেয়ামতপুর, চতইল্লা, শুকদেব, চরসুলতান, মির্জাকাল, স্বরাজগঞ্জ, গুপ্তগঞ্জ, হাজিপুর, সোনাপুর, খড়কি, মধুপুর মেদুয়া, কালুপুর, ভবানীপুর, সৈয়দপুর, গাজীপুর, মদনপুর, নাদের মিয়ার হাট, কাচিয়া, সাঁচড়া, মলংচড়া, রাধাভল্লব, নাছিরমাঝি প্রভৃতি এলাকাসহ কয়েকশ’ কিলোমিটার জনপদ প্রমত্তা মেঘনার অতল তলায় হারিয়ে গেল।
শুরু হলো ভাঙন প্রতিরোধ ও বাঁধ নির্মাণের নামে জমজমাট ব্যবসা। প্রথম মাটির সাহায্যে ভেড়িবাঁধ দিয়ে ভূখ- রক্ষার প্রচেষ্টা শুরু হয় দেশ স্বাধীনের অনেক আগে। সে বাঁধের কোন কোন অংশ এখনো বহাল আছে। কিন্তু মেঘনা উপকূলীয় যে পূর্বদিক সেদিকের ভেড়িবাঁধের ভাঙন শুরু হয় বাঁধ নির্মাণের সাথে সাথেই। যেস্থান দিয়ে মেঘনার ভাঙন দেখা দেয় সেদিক রক্ষার জন্য পুনরায় মাটির বাঁধ দেয়া শুরু হয় সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। দেখা গেল বর্ষার আগে উচুঁ করে বাঁধ দেয়া হয়েছে, বর্ষার প্রবল ঢেউ এর ধাক্কায় সে বাঁধ ভেঙে নদী অনেকদূর ভিতর ঢুকে গেছে। এভাবে বাঁধ ও পানির খেলা দুই-তিন প্রজন্ম চোখের সামনে দেখে আসছে।
কালে কালে মানুষ অনেক কিছুকে অসম্ভব বলে মনে করতো। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ এত জ্ঞান ও শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, তাদের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তারা ইচ্ছে করলে প্রকৃতির ভয়াবহ গ্রাসের হাত থেকে কেবল নিজেদের রক্ষাই করতে পারে না, প্রয়োজনে প্রকৃতিকে নিজেদের বশে এনে নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারে। তারা জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃতির অনেক খামখেয়ালিপনাকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। আল্লাহ সূরা জাসিয়ার ১২নং আয়াতে নিজেই উল্লেখ করেছেনÑ “আল্লাহ সমুদ্র ও সমুদ্রের জলরাশিকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন, যাতে নৌযান ব্যবহার করে দূর-দূরান্তে যেতে পার এবং তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার।” এ আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল সমুদ্রের ঢেউ যত ভয়াবহই হোক আর নদী যত করালগ্রাসীই হোক না কেন সেটা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। মানুষ ইচ্ছে করলে প্রকৃতির সে উচ্ছ্বাস থামিয়ে দিতে পারে। প্রয়োজনে সে উচ্ছ্বাসকে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে। পৃথিবীর নগর সভ্যতা একান্তই মানুষের প্রচেষ্টার ফসল। স্বর্গের সুরম্য প্রাসাদের বিবরণ পড়ে মানুষ চিন্তা করে দেখলো, স্বর্গে গিয়ে যেহেতু সুরম্য অট্টালিকা পাওয়া যাবে, দুনিয়াতেই আমরা চেষ্টা করে দেখি না সেরকম প্রাসাদ নির্মাণ করতে পারি কি না! চেষ্টা করতে করতে মানুষের প্রচেষ্টা এক সময় সফল হয়ে গেল।
নদী যখন ভাঙে, তুফান যখন শুরু হয় তখন এককভাবে একজন মানুষের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব না, ভাঙন ঠেকানোও সম্ভব না, ভাঙন থেকে পিছু হটা ছাড়া অন্য উপায়ও থাকে না। কিন্তু হটতে হটতে সে কোথায় গিয়ে ঠেকবে? নদীকে যদি ইচ্ছে মতো ভাঙতে দেয়া হয়, দেখা যাবে জনপদের পর জনপদ ভেঙে শেষ করে ফেলছে। ভাঙতে ভাঙতে পুরো দেশটাই ভাঙনের কবলে পড়ে গেছে। পানিকে যদি ইচ্ছে মতো বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়, দেখা যাবে পুরো বাড়িটাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
নদীর স্বভাবই হলো বয়ে চলা। সে বইতে বইতে কোথায় যাবে তার ঠিকানা সে নিজেও জানে না। কিন্তু কেউ না জানলেও বিজ্ঞানীরা জানেন। এও জানেন কোন কোন নদীতে কত জল আর কোন মহাসাগরের কতটুকু গভীরতা। জেনে লাভ হয়েছে এই : ইচ্ছে করলেই তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদীর গতিপথ বদলে দিতে পারেন।
১৯৫০ সালের ভূমিকম্পে যদি মেঘনার মাঝখানে নতুন চর জেগে না উঠতো তবে মেঘনা হয়তো ভোলার মানুষের জন্য সর্বকালের আশীর্বাদ হয়েই থাকতো। যেটুকু পানি নদী দিয়ে যাতায়াত করতো শত শত বছর ধরে তার জন্য খুব বেশি প্রশস্ততার দরকার হতো না। নদীও এমন রাক্ষুসী এটিচুড নিয়ে দুর্বল জনপদে এমন আছড়ে পড়তো না। চর জেগে উঠার ফলে নদী বাধাপ্রাপ্ত হয়েই বাঁধালো যত গ-গোল। নদী দু’পাড়ে সমানভাবে আঘাত করলো। কিন্তু পূর্ব পাড়ের তুলনায় ভোলার মাটি অধিক পলল গঠিত বলে এ অঞ্চলটাই অধিক ভাঙনের কবলে পড়ল। বিগত ৭০ বছর ধরে অবিরাম ভাঙনের কারণে এক সময়কার যে মূল ভূখ- দৌলতখাঁ, তালতলি, গাজীপুর, তজুমদ্দিন, তুলাতলি তার প্রায় সবটুকুই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যে স্রোতস্বিনী মেঘনা, যে নদীর এপাড় থেকে ডাক দিলে ওপাড় থেকে শোনা যেতো, সে নদী ভাঙতে ভাঙতে আজ সমুদ্রের মত প্রশস্ততর হয়ে গেছে।
ইউরোপীয় বা আমেরিকান কিংবা চীনের বিশেষজ্ঞরা এসে যখন প্রমত্তা মেঘনা নদীর প্রশস্ততা ও ভয়াবহতা দেখে তখন তারা একে নদী বলে মানতে নারাজ। কারণ মেঘনার যে ঢেউ ওঠে খোদ ভূমধ্য সাগরেও এমন ভয়াল ঢেউ ওঠে না। তারা বলেন- নদী বলতে যে স্রোতধারাকে বোঝায় এতো সেরকম না। এ তরঙ্গমালা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ বা স্রোতকেও হার মানায়। তবু আমরা মেঘনা, পদ্মা বা যমুনাকে নদী বলেই তাদের নিকট গর্ব করি। মেঘনা বা পদ্মা নিত্য রুদ্ররূপ ধারণ করে, বছরের পর বছর আমাদের ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দশকের পর দশক ধরে সমৃদ্ধ জনপদ নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সেটা আমরা সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষরা দেখেও না দেখার ভান করি। কবিতার সৌন্দর্যের স্বার্থেই আমরা মেঘনাকে রাক্ষুসী না বলে রূপালী ইলিশের অভয়ারণ্য বলে তার সুনাম গাইতে থাকি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মেঘনা যে রাজ অন্দরে ঢুকে রাজ্যের বারোটা বাজাচ্ছে সেটা টের পায় কেবল ভুক্তভোগী ভূমিহারা ভিটাহারা সর্বস্বান্ত চাষিরাই।
আজ থেকে ত্রিশÑবত্রিশ বছর আগে নদী এত দূরে ছিল যে, দশ কিলোমিটার ভিতরের মানুষ কল্পনাই করেনি মেঘনা তাদের বাড়িঘর, বাগান-জমিন, সুদৃশ্য জনপদ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। দেখতে দেখতে বহু দূরের নদী কারো কারো একেবারে ঘরের কাছে চলে আসবে সেটাও তারা ভাবেনি। ২৫ বছর আগেও ভোলা সদর থেকে নদী ছিল অন্তত সোজাসুজি পূর্ব দিকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরে। উত্তরে দিক দিয়ে অন্তত ১১/১২ কিলোমিটার দূরে। ভোলা ভূখ-ের চারপাশে নদী। সেজন্যে এর কাছাকাছি দূরত্বে নদী থাকবেÑ এ খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ভাঙন ঠেকাতে না পারায় প্রতিবছর কোন না কোন অঞ্চল নদীর গ্রাসে পতিত হয়েছে। হতে হতে সেটা এখন শহরের দু’কিলোমিটারের মধ্যে এসে ঠেকেছে।
৮/১০ বছর আগে মেঘনা হঠাৎ রুদ্র হয়ে ওঠায় অল্পদিনের মধ্যে অনেকগুলো গ্রাম-ইউনিয়ন-বাজার চিরতরে হারিয়ে গেছে। ঠিক একই কায়দায় ভাঙন শুরু হয় দু’বছর আগে। গত বছর তো ইলিশা ফেরিঘাটসহ কয়েক মাইল রাস্তা ভেঙে যায়। উত্তর ও পূর্ব দিক দিয়ে মেঘনা দু’কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে পড়ে। কয়েক বছর আগে মেঘনা-ডাকাতিয়ার খর¯্রােতে পড়ে চাঁদপুর শহরের রেলস্টেশনসহ অনেকটুকু স্থান মুহূর্তে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু তাৎক্ষণিক বিরাট বাজেট বরাদ্দ হওয়া এবং তার সদ্ব্যবহার হওয়ায় সেটা কোনমতে রক্ষা পায়। গত বছর যখন ইলিশা ফেরিঘাট, জংশন বাজারসহ কতগুলো জনপদ কয়েক দিনের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছিল, তখনও সেটা নিয়ে তুমুল হৈচৈ হয়, টেলি মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচুর সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। প্রধানমন্ত্রীসহ কর্তা ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিস্তর লেখালেখি হয়। অবশেষে বরাদ্দ এলো ঠিক কিন্তু কাজের ধারা, ব্লক ফেলার ধরন, ভুখ- রক্ষার যে আন্তরিকতা, বাজেট ছাড়ের যে দীর্ঘসূত্রিতা সেটা দেখেই ভুক্তভোগীরা আশা ছেড়ে দিলেন। তারা বললেন, বাজেটের টাকা নদীর জলে ভাসিয়ে না দিয়ে বা দগদগে ঘা-কে বাণিজ্যের অংশ না বানিয়ে যেমন আগে ছিল তেমনটা থাকলেই ভালো হতো। তাহলে অন্তত আশা করে আশাহত হয়ে এমন তীব্র কষ্ট অনুভব করার দরকার হতো না।
ভাঙনের দগদগে ঘা সারানোর জন্য ভোলা জোনে ১৭শ’ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান আছে। টাকার অংকটা একেবারে খাটো না। খাটো করে দেখারও সুযোগ নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে সশরীরে স্বচক্ষে কেউ যদি যথাস্থানে গিয়ে ভাঙন প্রতিরোধের কার্যক্রম দেখেন, আপনা থেকেই যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন ভাঙন প্রতিরোধের নামে ভয়াল মেঘনার সাথে কি রকম মস্করা করা হচ্ছে। চান্সে সংশ্লিষ্ট কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া আজকে থেকে শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী কাল থেকে। মস্করা বললাম এ কারণেÑ নানান নামে বাজেট বরাদ্দ হয়। নামগুলো হচ্ছেÑ নদীর তীর সংরক্ষণ, শহর রক্ষা প্রকল্প, নদী ভাঙন প্রতিরোধ, নদীর নাব্যতা রক্ষা এসব আর কি। বিষয়টার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি জননেতা ও প্রভাবশালী মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে অসংখ্যবার কথা বলেছি। বলেছি- স্যার, আপনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ইচ্ছে করলে দল-মত-নির্বিশেষে ভোলার সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে একত্র করতে পারেন। শুধু সরকারি বাজেটে মেঘনার ভাঙন ঠেকবে না। ঠেকবে যদি আপনি ভোলার সকল জনতাকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে পারেন। ভোলার সবচেয়ে বড় নেতা আপনি, আপনার পক্ষেই কেবল এতবড় উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। যদি তা করতে পারেন, কেয়ামত পর্যন্ত আপনার নাম নিয়ে গর্ব করবে ভোলাবাসী।
আমি তার সামনে লক্ষীপুর-৪ এর সংসদ সদস্য আব্দুল্লা আল মামুনের উদাহরণ স্থাপন করলাম। তিনি কীভাবে মাত্র সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে চিরতরে ভাঙন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। বিগত বিএনপি আমলের পানি সম্পদমন্ত্রী ছিলেন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজ উদ্দিন সাহেব। দুর্নাম করা হয় যে, তিনি ভোলা রক্ষার জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ধরে নিলাম তিনি দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ভোলাপ্রেমিক নেতা নন। কিন্তু আপনারা তো স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, দেশপ্রেমিক ও ভোলা প্রেমিক। আপনাদের দ্বারা তো বড় বাজেট আবশ্যক এবং তার সদ্ব্যবহারও আবশ্যক। কিন্তু সেটা হচ্ছে কি?
প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে ভোলা নদী ভাঙন প্রতিরোধ বিষয়ে একাধিক সেমিনার-সিম্পেজিয়াম ও আলোচনা সভা হয়, কিন্তু এবার অজ্ঞাত কারণে সেটাও হয়নি। আমি নিজে উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। হলো কেন? তার উত্তর অনেকের জানা থাকলেও কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নয়।
ভোলার সমস্যা ও দুর্যোগ পীড়িত সাধারণ লোকজন, যাদের কথা কেউ লেখে না, তাদের নিরানব্বই ভাগ লোক চায় মেঘনার পূর্বপাড়ের মতো এপাড়ের কাজটাও সেনাবাহিনী করুক। তাতে বাজেটের যথাযথ ব্যবহার হবে বলে তাদের বিশ্বাস। বিগত দিনের কিছু প্রকল্পের উপমাও তারা সামনে আনেন। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ব্লক ফেলার যে কাজগুলো হয়েছে সে প্রকল্পগুলোর সবই সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং সে বাঁধগুলো এখনো টিকে আছে। অন্য সাধারণ ঠিকাদারদের কাজ অসমাপ্তই থেকে গেছে। যারা সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষ তাদের ইচ্ছা কাজগুলো সেনাবহিনী করুক। কিন্তু যারা তাদের ইচ্ছার কথাগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরবেন বা টাকার ব্যবহার নিশ্চিত করবেন, তারাই তো কেবল এগিয়ে আসছেন না। যেন সরিষাতেই ভূত।
বাজেট আসে। বাজেট যথারীতি খরচও হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। নদী ভাঙন আগে যত প্রবল ছিল, সেটা আরও প্রবলতর হয়ে ছোবল হেনেই চলেছে। ভোলার একজন সিনিয়র সাংবাদিক, যার বাড়িঘর ১০ বছর আগে বিলীন হয়ে গেছে, কথায় কথায় তিনি বললেন- ‘ভাঙন প্রতিরোধের নামে নাটক মঞ্চস্ত হতে হতে মূল মহকুমা সদর দৌলতখানের মতো জেলা সদর ভোলাও আগামী দশ বছরের মধ্যে ভয়াল নাগিনী মেঘনার অতলান্ত গভীরে হারিয়ে যাবে।’ সত্যি কি হারিয়ে যাবে? যদি হারিয়ে যায়, আমরা কোথায় গিয়ে রাজনীতি করব, কোথায় গিয়ে পূর্বপুরুষদের কবর খুঁজব? শিকড়শূন্য হয়ে গেলে কি আমরা ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে পারব? সময় থাকতে ভাঙনের রাস টেনে ধরা আজ সময়ের দাবি মাত্র।
লেখক : প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন