ধুলার কারণে চট্টগ্রাম নগরীতে বেড়েছে বায়ু দূষণের মাত্রা। নগরজুড়ে উড়ছে ধুলা-বালু। রাস্তায় নেমেই নাকাল হচ্ছেন নগরবাসী। নাকে-মুখে, চোখে ধুলা ঢুকে দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জনজীবন। দূষিত পরিবেশে বাড়ছে রোগ-বালাই। বিশেষ করে অ্যাজমা, এলার্জি, কাশিসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। করোনাকালে এমন দূষণে চরম হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি, সিটি কর্পোরেশনসহ সেবা সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় নগরজুড়ে ধুলা-বালুতে এমন দমবদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে যানবাহন ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়া। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে পাহাড় ও গাছপালা নিধনের কারণে নগরীতে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীতে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব কাজের ধীরগতিতে এমনিতেই জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। অনেক এলাকায় চলছে সড়ক সংষ্কার ও সম্প্রসারণের কাজ। পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের জন্য নগরীতে খাল, নালা সম্প্রসারণ কাজ চলছে। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অলি-গলি রাস্তা এবং খাল-নালা-নর্দমায় খোঁড়াখুঁড়িতে শুষ্ক মৌসুমে শুরু হয়েছে ধুলা-বালুর উৎপাত। ভাঙ্গাচোরা সড়ক আর চলমান নির্মাণ কাজের মধ্যে চলাচলের সময় যানবাহনের চাকায় উড়ছে ধুলা, বালু। নগরীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায় সর্বত্রই ধুলাময় পরিবেশ। শীতের কুয়াশার মতো ধুলায় আচ্ছাদিত রাস্তা। চলন্ত যানবাহনের পেছনে কুণ্ডলি পাকিয়ে বাতাসে উড়ছে ধুলা-বালু। সড়কে দুই পাশের দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ঘর ধুলায় সয়লাব।
উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা, নালা-নর্দমা খুঁড়ে রাস্তায় রাখা মাটি আর বালু রাখা হয়েছে। গণপরিবহনের যাত্রীরা ধুলায় নাকাল হচ্ছেন। গায়ের পোশাক, মাথার চুল বিবর্ণ হচ্ছে ধুলায়। সড়কের পাশের শো-রুম, খাবারের দোকান, হোটেল, রেস্তোঁরা ধুলা বালুতে একাকার। আশপাশের ভবন আর গাছপালায় জমেছে ধুলার আস্তরণ। সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হচ্ছেন রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশের সদস্য, ভ্যানগাড়ি, রিকশা চালকসহ গণপরিবহনের চালক ও যাত্রীরা।
বিমানবন্দর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত সড়কে চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ। তিন বছরের বেশি সময় ধরে নগরীর প্রধান এই সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির লাইন সরানোর পাশাপাশি এই সড়কের পাশে ভবন ভাঙার কাজও চলছে। এত বড় প্রকল্পেও উপেক্ষিত হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি। প্রকল্প এলাকায় প্রাচীর দেওয়া এবং দিনে কমপক্ষে তিনবার ধুলা নিবারণে পানি ছিটানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বরং ফাইলিংয়ে তোলা মাটি দিনের দিনের পর দিন রাস্তায় রেখে দেয়া হচ্ছে। বারিক বিল্ডিং থেকে ফকিরহাট ও কাস্টমস হাউস পর্যন্ত সড়কের একপাশে ভাঙা হচ্ছে পুরনো ভবন। পর্দা দিয়ে ঘেরাও না দেয়ায় ভবন ভাঙার ধুলা-বালু উড়ছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর এই প্রকল্পের মতো পানিবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পেও একই অবস্থা। নগরীর বেশিরভাগ খাল-নালা সংস্কার কাজের জন্য মাটি, বালি রাখা হয়েছে সড়কের ওপর।
সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নগরীতে কয়েকটি সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ চলছে। এসব প্রকল্প এলাকায়ও ধুলা-বালুর প্লাবন। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের বেশিরভাগ প্রকল্পে নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট কানেকটিং রোড, বহদ্দারহাট থেকে সিঅ্যান্ডবি কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে কালুরঘাট পর্যন্ত সড়ক, মাঝিরঘাট রোডসহ বেশ কয়েকটি সড়কে উন্নয়ন কাজ চলছে গত কয়েক বছর ধরে। কাজের ধীরগতিতে এসব সড়কেও ধুলা-বালুর কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। কয়েকটি সড়কে চলছে সংষ্কার কাজ। কাজের জন্য রাস্তায় রাখা হচ্ছে বালু আর নির্মাণ সামগ্রী। রাস্তায় ইট-বালু রেখে ভবন নির্মাণ চলছে। কোথাও আবার কোন রকম ঘেরাও ছাড়া ভাঙা হচ্ছে পুরাতন ভবন।
এসব কারণেও বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। সংষ্কারের পর সড়কেই রেখে দেওয়া হচ্ছে অবশিষ্ট বালু, মাটি। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ট্রাকে ট্রাকে মাটি আর বালু পরিবহন করা হচ্ছে। খোলা ট্রাকে অতিরিক্ত বালু পরিবহন করার সময় ভাঙ্গা সড়কে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ছে মাটি, বালু। নগরীর সড়ক ও রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। অথচ প্রায় সড়কে এখন ধুলার জোয়ার। নামমাত্র কিছু সড়কে সুইপিং মেশিন দিয়ে ধুলা তাড়ানো হচ্ছে। কিছু সড়কে ঝাড়ু দিচ্ছেন পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। আর বেশিরভাগ সড়কে ধুলা-বালু।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-বন্দর) শাকিলা সুলতানা বলেন, নগরীতে বিশেষ করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প এলাকায় ধুলা-বালুর কারণে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্য থেকে শুরু করে পথচারী, গণপরিবহনের যাত্রী সবাই ধুলায় নাজেহাল হচ্ছেন। ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বলা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগরীর পরিচালক মোহাম্মদ নূরউল্লাহ নূরী বলেন, নগরীতে বায়ু দূষণের প্রধান কারণ ধুলা, বালু। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ধুলা-বালু বেড়ে যাওয়ায় বাষু দূষণের মাত্রাও বেড়েছে। এছাড়া যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং নগরী ও আশপাশের কয়েকটি কল-কারখানা বিশেষ করে রি-রোলিং মিলের কারণে বাষু দূষণ হচ্ছে। সিডিএর দুটি মেগা প্রকল্পের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া হলেও সিটি কর্পোরেশনসহ কয়েকটি সেবা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকল্পের জন্য কোন ছাড়পত্র দেয়নি। বায়ু দূষণ রোধে নিয়মিত অভিযান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় দিনে তিন বার পানি ছিটাতে বলা হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার রাখছে। এ কাজে দুটি সুইপিং মেশিনও ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজের জন্য রাস্তায় ধুলা-বালুর পরিমাণ বেড়ে গেছে। এজন্য তিনি উন্নয়ন কাজে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর গাফেলতি এবং সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন। মেগা প্রকল্পের জন্য রাস্তায় ইট-বালু, নির্মাণ সামগ্রী রাখা হচ্ছে। জনদুর্ভোগ লাঘব ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে কর্পোরেশন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে বায়ু দূষণের ফলে হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য। শীত আসতেই বেড়েছে অ্যাজমা, এলার্জি, কাশিসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগবালাই। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মুসলিম উদ্দিন সবুজ বলেন, বায়ু দূষণের মারাত্মক শিকার হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এ সময়ে শিশু অ্যাজমাসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বাড়ছে। আমাদের কাছে রোগী আসার হার আগের তুলনায় বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে শীত মওসুমে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্বাসকষ্ট, এলার্জি ছাড়াও বায়ু দূষণের কারণে চর্মরোগের উপদ্রবও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ধুলা-বালু থেকে রক্ষায় মাস্ক পড়ার পাশাপাশি ঘর থেকে বের হলে ফুলহাতা শার্ট এবং মাথায় ক্যাপ বা টুপি পরা যেতে পারে। এতে ধুলা-বালু থেকে কিছুটা রেহাই মিলবে। বাসায় ফিরে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধোয়া অথবা গোসল করার পরামর্শ দেন তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন