বায়ু দূষণে বিশ্বের দূষিত শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রায়ই শীর্ষে থাকে। ঢাকার বাতাসে বিষ। ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি দূষণও চরম পর্যায়ে রয়েছে। এসব কারণে রাজধানী ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় অনেক আগেই স্থান করে নিয়েছে। এবার ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানির দিক থেকে (বাস অযোগ্য) সপ্তম স্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। বিশ্বের ১৭২টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম। ঢাকার পিছনে আছে যে ৬টি শহর সেগুলো হচ্ছে, নাইজেরিয়ার লাওস, লিবিয়ার ত্রিপলি, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, পাকিস্তানের করাচি এবং পাপুয়া নিউনিগির পোর্ট মোরসবি। গতকাল ইআইইউ ২০২২ সালের সূচকে এই তালিকা প্রকাশ করে।
জীবন ও জীবিকার তাগিদে ধারণক্ষমতার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি মানুষ বসবাস করছে ঢাকায়। সেই সঙ্গে উন্নত নগরায়ণের লক্ষ্যে চলছে উন্নয়নকাজ। ফলে চাপ বাড়ছে ঢাকার পরিবেশের ওপর। সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটছে বায়ুর। ধুলোয় ধূসর ঢাকার বায়ুদূষণ দিন দিন বেড়েই চলছে। অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাসে এখন ভাসছে বিষ, যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকছে শরীরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে সারাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। তার মানে ঢাকায় বায়ুদূষণ না থাকলে একজন নাগরিক আরও প্রায় সাত বছর সাত মাস বেশি বাঁচতে পারতেন। সেই সঙ্গে বায়ুবাহিত রোগে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। কিডনি, হৃদরোগসহ ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। নষ্ট হচ্ছে নারী-পুরুষের প্রজনন ক্ষমতাও। অতি বায়ুদূষণের ফলে পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ুর। উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমÐলের ওজনস্তর। পরিবেশ দূষণরোধে আইন থাকলেও তা মানার বালাই নেই। নগরে মেগা উন্নয়নকাজে বায়ুদূষণরোধের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বেশির ভাগ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানই সরকারি। পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা এদের বিরুদ্ধে কঠোর না হওয়ায় কমছে না বায়ুদূষণ। গত ১০ বছরে উন্নয়নকাজের ফলে রাজধানীতে বেড়েছে খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ। বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণাধীন স্থাপনা ও কলকারখানার বর্জ্য, নিয়মিত রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করাসহ নানা কারণে দূষিত হচ্ছে ঢাকার বাতাস। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিনিয়তই বাড়ছে ঢাকায় বায়ুদূষণ। ফলে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ, অ্যাজমাসহ নানা ব্যাধি নিয়ে হাসপাতালে বাড়ছে রোগী।
বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস বায়ুতে মিশে যাচ্ছে। এতে উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ু। আর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ঢাকা নগরী।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমÐলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে ধুলোবালি এবং শিল্পকারখানার ধোঁয়া বেড়ে যাওয়ায় বাতাসের মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে দূষণের যে মাত্রা তাতে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। বাতাসে ভাসছে বিষ। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
একটি শহরের পরিবেশ, শিক্ষা, স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও অবকাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ইআইইউ বাসযোগ্যতার সূচক তৈরী করে। এবারের সূচকে আগের বছরের চেয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় তিন ধাপ এগিয়েছে ঢাকা। ২০২১ সালের সূচকে ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৭তম হয়েছিল ঢাকা। বাসযোগ্যতার সূচকে এ বছর ঢাকার স্কোর ১০০ নম্বরে মধ্যে ৩৯ দশমিক ২। আগের বছর প্রাপ্ত স্কোর ছিল ৩৩ দশমিক ৬। মহামারিসংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার কারণে স্কোর বেড়েছে বলে জানিয়েছে ইআইইউ। তালিকার একেবারে তলানিতে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। অবশ্য তলানিতে থাকা ১০টি শহরের মধ্যে অবকাঠামোতে সবচেয়ে কম স্কোর ঢাকার। এ ক্ষেত্রে ঢাকার স্কোর মাত্র ২৬ দশমিক ৮।
কাভিড-১৯ মহামারির কারণে ইআইউর এই তালিকা প্রকাশ ধাক্কা খায়। ২০২০ সালে তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। পরের বছর তালিকায় শহরগুলোর অবস্থান ব্যাপক ওলটপালট হয়। কারণ, লকডাউন ও সামাজিক দূরত্বের মতো পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপি শহরগুলোর সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার স্কোরকে প্রভাবিত করে।
তবে মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় ২০২২ সালের সূচক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। আগের বছর ১২তম স্থানে ছিটকে পড়া অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা আবার শীর্ষ স্থানে ফিরে এসেছে। লকডাউনের কারণে জাদুঘর ও রেস্তোরাঁ বন্ধ করে আগের বছর ইউরোপের শহরটির এই অবনমন হয়েছিল। ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও শীর্ষে ছিল ভিয়েনা। আগের বছর শীর্ষ থাকা নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড এবার ৩৪তম স্থানে নেমে গেছে। মহামারির বিধিনিষেধের কারণে শহরটির এই ছিটকে পড়া বলে জানিয়েছে ইআইইউ। তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছে কোপেনহেগেন। জুরিখ ও ক্যালগারি যৌথভাবে তৃতীয় হয়েছে। শীর্ষ ১০ শহরের বেশির ভাগই পশ্চিম ইউরোপ ও কানাডার শহর। শীর্ষ ১০ শহরের ছয়টি ইউরোপের।
তালিকায় তলানির দিক থেকে দ্বিতীয় হয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস (স্কোর ৩২.২)। আর ৩৪.২ স্কোর নিয়ে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির অবস্থান তলানির দিক থেকে তৃতীয়। রাশিয়া হামলা করায় ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে তালিকায় রাখা হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন