দেশে কোনো অঘটন না ঘটলে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে। আগামী এই নির্বাচনকে সামনে রেখেই এখন থেকে সরব হয়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি সব মহল। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠনে প্রেসিডেন্টের সংলাপ, অল্প সময়ে নির্বাচনী আইন করা সম্ভব নয় ঘোষণা থেকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে হঠাৎ নির্বাচন কমিশন আইন পাস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের ‘বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য রাখা’ বক্তব্য, বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’, র্যাব এবং সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ, আন্তর্জাতিক ১২টি মানবাধিকার সংস্থার র্যাবকে শান্তি মিশন থেকে সরিয়ে দেয়ার আবেদন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিমালাবিষয়ক সিনিয়র প্রতিনিধি ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেলের কাছে সেøাভাকিয়ার ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ইভান স্টেফানেকের চিঠি, যুক্তরাষ্ট্রে দুইদলের লবিস্ট নিয়োগ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ইসি আইন নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান সবকিছুই আগামী নির্বাচনকে ঘিরে। এমনকি বাম গণতান্ত্রিক জোট জাতীয় সংসদে পাস করা নির্বাচন কমিশন আইন পাসের বিরুদ্ধে আজ দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে।
‘লবিস্ট’ শব্দটি গত কয়েকদিনে দেশে ব্যপক পরিচিতি পেয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ও মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি একে অপরের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের দোষারোপ চলছে। দুইদল লবিস্ট নিয়েগের তথ্য পরোক্ষভাবে অস্বীকার করলেও বিশিষ্টজনরা বলছেন, আগামী নির্বাচনের আগে বাইডেন প্রশাসনকে নিজেদের অনুকূলে নিতেই দুইদল এই পথ অনুসরণ করেছে। দেশের নির্বাচন গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সবার উচিত জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদের শঙ্কা আওয়ামী লীগ চায় সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো অন্য কোনো ছকে নির্বাচন করে বিজয়ী হতে। আর বিএনপি চায় ভোটের আগে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চিত করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। তাছাড়া বিএনপি বুঝে গেছে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন অংশ নেয়া আর হাত-পা বেঁধে সাঁতার প্রতিযোগিতায় নামার নামান্তর।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, সরকারের অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে সার্চ কমিটি ও তাদের অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের চেষ্টা হচ্ছে। সংসদে পাস হওয়া নুতন নির্বাচন আইনকে ‘সরকারি দলের পক্ষে নির্বাচনী ফলাফল নিশ্চিতকরণ আইন’ বলা যেতে পারে।
আগামী নির্বাচন ইস্যুতে দেশের বড় দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপী ইউনিয়নসহ দাতা দেশ, সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করছে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দক্ষিণ এশিয়া দেখভালের’ জন্য চৌকিদারের দায়িত্বে থাকা ভারতের উপর থেকে চৌকিদারিত্ব তুলে নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে গণতন্ত্র দেখতে চাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের এই কঠোর মনোভাব বুঝতে পেরে সরকার কার্যত চাপের মুখে পড়েছে। যার কারণে বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার কর্মজীবন শেষ করে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ পাননি।
ভৌগলিক অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো চাচ্ছেন বাংলাদেশের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে দেশি-বিদেশি সবপক্ষই সরব হয়ে উঠেছেন। জাতীয় সংসদে নির্বাচন কমিশন আইন-২০২২ পাসের সময় সে চিত্র দেখা গেছে। বিএনপি আগামী নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার ব্যাপারে অনড়। আর আওয়ামী লীগ চায় নতুন ‘নির্বাচন কমিশন আইন-২০২২’ এর ওপর সওয়ার হয়ে ২০১৪, ২০১৮ সালের মতো অন্য কোনো ছকে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। আর এতে যেসব দল নিরপেক্ষ ভোট হলে জামাতন হারানোর ভয়Ñ সেই জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির এমপিরা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ভোট করতে বেশি উৎসাহী। সংসদে তারা সেই মনোভাব বক্তৃতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগের ওপর মুখাপেক্ষী এসব দলের এমপিদের বক্তব্য শুনে আওয়ামী লীগের এমপিরাও লজ্জা পেয়েছেন। তবে বিএনপির কঠোর সমালোচনা করেই জাতীয় পার্টি তথা বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙা উল্টো ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যদি বিএনপি দুর্নীতির কাগজপত্র দেখাতে পারে তাহলে প্রেসক্লাবে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনশন করব। কয়েকদিন আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছিলেন, ‘আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কোন প্লাটফর্মে থেকে করবে তা বলার সময় আসেনি’।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ব্রতীর নির্বাহী প্রধান শারমিন মোর্শেদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়াই ছিল অস্বচ্ছ। সরকারের পাস করা এই আইনে জনগণের কোনো আস্থা নেই। দেখে মনে হচ্ছে এই আইনে নির্বাচন কমিশন নামে আমরা আবার মেরুদণ্ডহীন কিছু লোক পাব।
বিদেশিরা যে আগামী নির্বাচনকে খুব গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে তা ঢাকায় কর্মরত বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের বক্তব্যে পরিষ্কার। ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেছেন, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কীভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং কীভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। আগামী নির্বাচন নিয়ে ইইউ’র আগ্রহ আছে। চলমান ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইইউ। নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষককে বাংলাদেশে আসাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ইইউ। ইইউ চায় বাংলাদেশে অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।
কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি গঠন করতে প্রেসিডেন্ট মো. মো. আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করেন গত বছরের ডিসেম্বরে। কিন্তু বিএনপি, সিপিবি, জাসদ (একাংশ), এলডিপি, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ দেশের অর্ধেক রাজনৈতিক দল সে সংলাপ বর্জন করে। যারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়, সেসব দল থেকেও নির্বাচন কমিশন গঠনে নতুন আইন করার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয় নতুন আইন করা সময় সাপেক্ষ। অল্প সময়ে সম্ভব নয়। তাই সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন ইসি গঠন করা হবে। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের র্যাব নিষিদ্ধ, গণতন্ত্র সংম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানানো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্তা সরকারকে চাপের মুখে ফেলে দেয়। এসব ইস্যু বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করে করেছে এমন বক্তব্য প্রচার করে সুবিধা হয়নি। ফলে হঠাৎ মন্ত্রিসভায় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়। জাতীয় সংসদের ভেতরে বাইরে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই ২৭ জানুয়ারি তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশন আইন পাস করা হয়।
সংসদে এই আইন পাসের বিরোধিতা করে বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, সঠিকভাবে নির্বাচন না হওয়ার কারণে বিশ্বের অনেক দেশে গৃহযুদ্ধ হয়েছে। ইসি গঠনে সংবিধানে আইন করার কথা বলা আছে, কিন্তু অংশীজনের সঙ্গে কথা না বলে তাড়াহুড়ো করে আইন করা ‘আইওয়াশ’। এ আইন কেবল বিএনপি নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে। জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তড়িঘড়ি করে এই আইন পাস হয়নি। আওয়ামী লীগ কাউকে ইনডেমনিটি দেয়নি। এ আইনের মধ্যে কেউ অন্যায় করে থাকলে তাকে প্রটেকশন দেওয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশন আইনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই আইন ঐতিহাসিক। সংবিধানের আলোকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশের জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন আইন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণমানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন আইন এক অনন্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে নতুন আইন পাস করার কোনো এখতিয়ার এই সংসদের নেই। কারণ এই সংসদ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ নয়। সুতরাং এই আইন শুধু আমাদের কাছে নয়, পুরো দেশের মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য। আওয়ামী লীগ এক সময় বাকশাল করে নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছিল, শেষ রক্ষা হয়নি; নির্বাচন কমিশন আইন করেও তাদের শেষ রক্ষা হবে না।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সার্চ কমিটির প্রজ্ঞাপনকে এখন আইনি আবরণ দেয়া হয়েছে। বাস্তবে অনুসন্ধান কমিটির যোগ্য ব্যক্তিদের অনুসন্ধানের কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন আইন পাসের নামে যা হয়েছে তা নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা; সবকিছু হবে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী।
জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, নির্বাচন হবে, নির্বাচন কমিশন হবে, সংবিধানের দায় পালনের জন্য নির্বাচনের আয়োজন করা হবে; কিন্তু ফলাফল সরকারের অনুকূলেই থাকতে হবে- এ যখন সরকারের মনোবাসনা ও প্রতিজ্ঞা, তখন আর অবাধ নির্বাচন হতে পারে না। সেটা মাথায় রেখেই সরকার নির্বাচন কমিশন আইন করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন