চিকিৎসা নিতে গিয়ে রাজধানীর আদাবরে মাইন্ডএইড মানসিক হাসপাতালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এএসপি আনিসুল করিম শিপন। চিকিৎসার নামে তাকে হাসপাতালের সাউন্ডপ্রুফ টর্চার সেলে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে মামলাও হয়। পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে সহকর্মী পুলিশ সদস্যরা দ্রুততম সময়ে আসামিও গ্রেফতার করে।
অথচ আলোচিত এই হত্যার এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঘটনার তদন্তই শেষ করতে পারেনি পুলিশ। আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট না দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিচার কাজ শুরু হয়নি। অথচ খোদ পুলিশ কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে খুনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন ভাইরাল হয়েছিল।
আনিসুল ৩১তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। ঘটনার আগে তিনি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর মাইন্ডএইড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে হত্যার শিকার হন তিনি। এ হত্যা মামলার তদন্ত করছে ডিএমপির আদাবর থানা পুলিশ। কিন্তু তদন্তে পুলিশের ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ এক আসামি কারাগারে মারা গেছে।
যদিও তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত চলছে। তবে করোনার কারণে অনেক সাক্ষীকে ডেকেও পাওয়া যায়নি। এজন্য তদন্ত কাজে বিলম্ব হয়েছে। এখন তা জোরেশোরেই চলছে।
আনিসুলের বাবা মো. ফাইজুদ্দীন আহম্মেদও পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বলেন, আমি পুলিশের উপ-পরিদর্শক হিসেবে অবসরে গেছি। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছি। ছেলেকে পুলিশের কর্মকর্তা বানিয়ে নিজের অবশিষ্ট স্বপ্নটুকু পূরণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চিকিৎসা নিতে গিয়ে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এক বছর পার হয়ে গেল; এখনো তদন্তই শেষ হলো না! কেন এমন হচ্ছেÑ বুঝতে পারছেন না। যোগাযোগ করলে বলা হচ্ছে, খুব শিগগিরই তদন্ত শেষ হবে। ফলে এখন তদন্তেই সান্ত¦না খুঁজতে হচ্ছে পরিবারকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ফারুক মোল্লা ইনকিলাবকে বলেন, মামলার তদন্ত একেবারেই শেষ পর্যায়ে, দ্রুতই আমরা তদন্ত শেষ করব। দু’জন আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এজাহার নামীয় পলাতক একজন অভিযুক্ত বিদেশে চলে গেছেন, আরেকজন পলাতক রয়েছেন। তাকে খুঁজছি।
ঘটনার পর আনিসুল করিমের ভাই রেজাউল করিম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পারিবারিক ঝামেলার কারণে তার ভাই (আনিসুল) মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ঘটনার দিন ১১টার দিকে তাকে মাইন্ডএইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তারা ভর্তির ফরম পূরণ করছিলেন। ওই সময় কাউন্টার থেকে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী আনিসুলকে দোতলায় নিয়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা জানান আনিসুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাকে দ্রুত হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিলে চিকিৎসক পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। দোতলায় নিয়ে আনিসুলকে হত্যা করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেছিলেন।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, আলোচিত ওই হত্যা মামলার ১৫ আসামির মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা গেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আসামিদের মধ্যে মাইন্ডএইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, পরিচালক ফাতেমা খাতুন ময়না, মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, বাবুর্চি মো. মাসুদ, ওয়ার্ডবয় জোবায়ের হোসেন, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ডবয় মো. তানিম মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ, সাইফুল ইসলাম পলাশ এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সাখাওয়াত হোসেন ও সাজ্জাদ আমিন নামে দুই আসামি পলাতক। মামুন জামিনে থাকলেও হাসপাতালটির অন্যতম পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ গত ৫ নভেম্বর কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।
১৭ নভেম্বর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তখন পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আনিসুলকে স্বজনরা প্রথমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার রেজিস্ট্রার মামুন তাকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে মাইন্ডএইড হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এজন্য তিনি ওই হাসপাতাল থেকে কমিশন পেতেন এবং শুধু ওই বছরেই তিনি অন্তত ৩০ জন রোগীকে সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি মাইন্ডএইডে পাঠিয়েছিলেন। পুলিশ তাকে রিমান্ডেও নিয়েছিল। ওই চিকিৎসককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জরুরি চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। গ্রেফতারের ছয় দিন পর ওই চিকিৎসকের জামিন হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
যেভাবে হত্যার শিকার আনিসুল : ওই হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করে পুলিশ জানতে পারে, আনিসুল করিমকে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে টেনে-হেঁচড়ে হাসপাতালটির একটি কক্ষে ঢোকানো হয়। এ সময় হাসপাতালের ছয়জন কর্মচারী মিলে তাকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। তখন নীল পোশাক পরা আরো দুজন কর্মচারী তার পা চেপে ধরেন। আর মাথার দিকে থাকা দুজন কর্মচারীকে হাতের কনুই দিয়ে তাকে আঘাত করতে দেখা যায়। একটি নীল কাপড়ের টুকরা দিয়ে আনিসুলের হাত পেছনে বাঁধা ছিল। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদ তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর চার মিনিট পর আনিসুলকে যখন উপুড় করা হয়, তখন তার (আনিসুল) শরীর নিস্তেজ। একজন কর্মচারী তার মুখে পানি ছিটান, কিন্তু আনিসুলের নড়াচড়া নেই। তখন কর্মচারীরা কক্ষের মেঝে পরিষ্কার করেন। সাত মিনিট পর সাদা অ্যাপ্রন পরা এক নারী কক্ষটিতে প্রবেশ করেন। ১১ মিনিটের মাথায় কক্ষটির দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়। ১৩ মিনিটের মাথায় তার বুকে পাম্প করেন সাদা অ্যাপ্রন পরা ওই নারী। এরপরই তারা আনিসুলের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, মামলায় প্রায় ১৪ জন সাক্ষী পাওয়া গেছে। আরো সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী আছে। ঘটনার পর তাদের অনেকের মোবাইল ফোন নম্বর ও ঠিকানা মিলছিল না। তাই তদন্তে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন