নানা কারণে দেশের অন্যতম শ্রমঘন ও বিনিয়োগবান্ধব আবাসন খাতে সংকট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। করোনা অতিমারি শুরুর আগের এক খবরে বলা হয়েছিল, দেশের আবাসন খাতের উদ্যোক্তা বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও প্রায় ২৫ হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রিত রয়েছে এবং বিক্রিত হাজার হাজার ফ্ল্যাটও হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ ছিল, আবাসন খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকা। সেই সাথে নির্মান সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চুক্তি অনুসারে ফ্ল্যাট বিক্রি ও হস্তান্তর লাভজনক না হওয়ায় বিপুল পরিমান লোকসানের মুখে পড়তে হয় এ খাতের ব্যবসায়ীদের। করোনাকালীন সংকট কাটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও বাংলাদেশের আবাসন খাত এখনো বড় ধরণের সংকটের মধ্যে রয়েছে। বিশেষত নির্মান সামগ্রীর অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে সম্ভাবনাময় এ খাতের স্থবিরতা কাটছে না। সেতু ও বহুতল ভবন নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাচামাল রড। গত ৮ মাসে প্রতি টন রডের দাম ৭০ হাজার থেকে কোম্পানি ভেদে এখন ৮০-৮৮ হাজার টাকায় উঠে গেছে। সে তুলনায় সিমেন্টের দাম খুব বেশি না বাড়লেও ইট-পাথর, বালি, টিনশিট, এঙ্গেল বার ও টাইলসের মত নির্মাণ সামগ্রীর দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রামের ঠিকাদারদের একটি সংগঠন নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য কমানোর দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। আট মাসে নির্মাণ সামগ্রীর দাম ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। এতে আড়াই হাজার ঠিকাদারের অধীনে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি হুমকির মুখে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের হিসেবে দেশের গার্মেন্ট শিল্পের পরেই নির্মান শিল্পের অবস্থান। প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। এ খাতের যে কোনো সংকট দেশের কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান ও সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটকে বাড়িয়ে তুলবে। বেশ কয়েকমাস ধরে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। এর ফলে কর্মহীন, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। খাদ্যের পর আবাসন হচ্ছে মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। শহুরে ভ’মিহীন মধ্য আয়ের মানুষ ফ্ল্যাট কিনে নিজের পরিবারের আবাসনের স্বপ্ন দেখে। সেই সাথে বিনিয়োগকারী, ঠিকাদার, নির্মাণ শ্রমিক ও এ খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের সাথে জড়িত কোটি মানুষের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সংকট দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নির্মাণ সামগ্রীর অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি এবং গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে সেই স্বপ্ন ক্রমশ দূরাশায় পরিনত হচ্ছে। দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের নাগরিকদের আবাসনের মৌলিক চাহিদা পুরণে রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব অগ্রাহ্য করা যায় না।
করোনাত্তোর নতুন অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য এবং যুদ্ধসহ আন্তজার্তিক প্রেক্ষাপটে গ্যাস-পেট্টোলিয়ামের দাম গত এক দশকের মধ্যে রেকর্ড অতিক্রম করেছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আঁচ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সব পণ্যের উপরই পড়ে থাকে। আগেই থেকেই ক্রমবর্ধমান ইস্পাত ও রডের মূল্যবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের আবাসন খাত এবং উন্নয়ন প্রকল্পসমুহ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হবে। এমনিতেই দেশের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের গতি খুবই মন্থর। গত সপ্তাহে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও অগ্রগতির হার এখনো শতকরা ৩০ ভাগের মধ্যে রয়েছে। জ্বালানি ও রডসহ নির্মান সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানতে না পারলে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প এবং বেসরকারি আবাসন খাতের বিনিয়োগ ও লাখ লাখ পরিবারের বাড়ি নির্মাণের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। মানুষের আবাসন সংকটে শহরে বস্তি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রোধ করা অসম্ভব হবে। বৈশ্বিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আকষ্মিক মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা হয়তো রোধ করা সম্ভব নয়। তবে সংশ্লিষ্ট উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে যে সব বিষয়কে ব্যবহার করছে তার সঠিক মাত্রা ও প্রবণতা খতিয়ে দেখে মূল্য স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানিকৃত স্ক্র্যাপের মূল্য এবং রডের দামে তুল্যমূল্য বিচার করে দাম নির্ধারণ করতে হবে। ৭০ হাজার টাকার রড ৮০-৮৮ হাজার টাকা, ৫ হাজার টাকার বিটুমিন ১১ হাজার টাকা, ৩ হাজার টাকার পাথর রাতারাতি ৫ হাজার টাকায় উঠে যাওয়ার পেছনের সিন্ডিকেটেড কারসাজি থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন