জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেছেন, আবাসন খাতের জটিলতা নিরসন করা হবে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আবাসন খাতে যে জটিলতা ছিল, তা আর থাকবে না। ভবিষ্যতে আবাসন খাতকে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।’ শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর যৌথ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। সভায় আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, আবাসন খাতকে এগিয়ে নিতে ও কর্মচাঞ্চল্য তৈরিতে সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা চালু প্রয়োজন। পাশাপাশি অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে গেইন ট্যাক্স ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করাসহ রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমানোর দাবি করেন। এছাড়া স্বল্প সুদে বিশেষ তহবিল গঠনের কথাও বলেন তারা।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল)। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। এ সময় রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূইয়া, এনবিআর সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন ও পারভেজ ইকবাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এনবিআরের পক্ষে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এনবিআরের প্রথম সচিব (ভ্যাট) ড. আব্দুর রউফ। রিহ্যাবের পক্ষে প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আবাসন শিল্পের বিভিন্ন বিষয় গভীর মনোযোগের দাবি রাখে। সে জন্য এনবিআর-রিহ্যাব আলাদাভাবে বসে এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। আবাসন শিল্পের যে জটিলতা এতদিন ছিল, তা আর থাকবে না। ভবিষ্যতে আবাসন শিল্পকে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। এ শিল্পের ৮টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সমস্যা সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা হবে।’
নজিবুর রহমান বলেন, ‘গত একসপ্তাহ ধরে এনবিআর সারা দেশে আয়কর মেলার মাধ্যমে কর সেবা দিয়েছে। এতে সম্মানিত করদাতারা ব্যাপক সাড়া দিয়েছেন। এ সাড়ায় এনবিআর উৎসাহিত হয়েছে। এনবিআরকে এখন আর কালেক্টর বলা ঠিক না। মেলায় আমরা বলেছি, আমরা উৎসাহ দেই, ফ্যাসিলেটেড করি আর জনগণ কর দেয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূল্যবান দিকনির্দেশনা হলো বাংলাদেশে যেসব সম্ভাবনাময় শিল্প রয়েছে সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া। সে অনুযায়ী এনবিআর নজর দিচ্ছে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘রিহ্যাব-এনবিআর কর্মশালা বা প্রশিক্ষণের আয়োজন করা ও আবাসন সেক্টরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এনবিআরের যত নির্দেশনা হয়েছে, সেগুলো একীভূত করে একটি আদেশ জারি করা হবে। এর মধ্য দিয়ে রিহ্যাব-এনবিআর পার্টনারশিপ জোরদার হবে বলে জানান নজিবুর রহমান।’ তিনি বলেন, ‘আমাকে মাঝে মাঝে বিল্ডার্স মনে হয়। সেজন্য বিল্ডার্সদের কি চ্যালেঞ্জ, সেটা আমি জানি। আমাদের ঢাকায় ৩০ তলা রাজস্ব ভবন, চট্টগ্রাম একটি দীর্ঘ ভবন হবে। প্রতিটি জেলায় রাজস্ব ভবন হবে। ভবন নির্মাণ ও এ সেক্টরের জটিলতা সম্পর্কে আমি জানি।’
রিহ্যাবের সহযোগিতা চেয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা ২০১৯ সাল থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করব। এ আইন বাস্তবায়নে আগামী দুই অর্থবছর রিহ্যাব-এনবিআর যৌথভাবে কাজ করবে। প্রত্যক্ষ আয়কর আইনের সংস্কার করা হচ্ছে। বর্তমান প্রত্যক্ষ কর আইন সামরিক শাসন আমলে জারি করা একটি অধ্যাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলা ও ইংরেজিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি গণমুখী নতুন আয়কর আইন করতে এনবিআর কাজ করছে। এ আইনের ক্ষেত্রে রিহ্যাব লিখিতভাবে অভিমত দিলে খসড়ায় তার প্রতিফলন করা হবে। এর মাধ্যমে আবাসন শিল্পের জন্য একটি স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে।’
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে দেশের আবাসন শিল্প নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। নানা কর আরোপ ও সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে আবাসন খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। কর্মসংস্থানের বড় খাত হওয়া সত্ত্বেও গত চার-পাঁচ বছর ধরে কোম্পানিগুলো কেবল লোকবল ছাঁটাই করছে। বর্তমানে আর্থিক সরবরাহের অভাবে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যথাযথ গৃহঋণ না থাকায় বিক্রিত ফ্ল্যাটের রিপ্লেসমেন্ট হচ্ছে না। সময়মত ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ঋণ খেলাপি হচ্ছে, উচ্চ রেজিস্ট্রেশন ব্যয়ের ফলে ক্রেতারা রেজিস্ট্রেশনে আগ্রহ হারাচ্ছে, তাই রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। তাই সম্ভাবনাময় এ খাতকে এগিয়ে নিতে রেজিস্ট্রেশন ব্যয় ও গেইন ট্যাক্স কমানো, সেকেন্ডারি বাজার তৈরি এবং স্বল্প সুদে বিশেষ তহবিল গঠনসহ বেশ কিছু দাবি করা হয়।
রিহ্যাব জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত ব্যয় সাড়ে ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে গেইন ট্যাক্স ৪ শতাংশ, স্ট্যাম্প ডিউটি ৩ শতাংশ, রেজিস্ট্রেশন ফি ২ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ২ শতাংশ এবং ভ্যাট দেড় থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ। তাই রেজিস্ট্রেশন ব্যয় সাড়ে ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশে কমিয়ে আনা জরুরি।
বর্তমানে ডেভেলপারদের জন্য ৫টি শ্রেণিতে আবাসিকে প্রতি বর্গমিটারে ৩০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা আয়কর দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিকে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হচ্ছে ১২০০ টাকা থেকে ৬৫০০ টাকা। আয়করের এ হারকে প্রতি বর্গমিটারের আবাসিকের জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং বাণিজ্যিকের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা আয়কর নামিয়ে আনার দাবি করেন। গেইন ট্যাক্স ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার দাবিও জানানো হয়।
দেশের ফ্ল্যাটের সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা নেই। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠলে নতুন একটা পেশাজীবী গড়ে উঠবে। এই সেক্টরে কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হবে। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন একদিকে যেমন এই শিল্পকে এগিয়ে নেবে তেমনি বাজারে অর্থের লেনদেনও বাড়াবে। অন্যদিকে সরকারও তার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। ফ্ল্যাট পুনঃবিক্রয়ের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত রেজিস্ট্রেশন খরচ সর্বমোট ৩ শতাংশ নির্ধারণ করে সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও আবাসন খাতে ৫ শতাংশ সুদে ৩০ বছর মেয়াদে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের দাবি করা হয়।
সভায় এসবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্ল্যাট বা জমি রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমানো ও গেইন ট্যাক্স ১৫ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে। এছাড়াও আবাসন খাতের সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে এনবিআর-রিহ্যাব যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন