এতটুকু আশা ছোট্ট একটি বাসা, এটা প্রতিটি মানুষের কেবল স্বপ্ন নয়, এর অপরিহার্যতা প্রশ্নাতীত। মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারগুলোর মধ্যে বাসস্থান অন্যতম। বাংলাদেশের মানুষের সবার জন্য এই চাহিদা বা অধিকার নিশ্চিত নয়। গ্রামে যেমন ভূমিহীন, আবাসহীন মানুষ রয়েছে, তেমনি রয়েছে শহরেও। শহরে আবাসিক সংকট নিরসনে সরকার কাজ করছে। কাজ করেছে বেসরকারী উদ্যোক্তারা। বেসরকারী আবাসন শিল্পখাত মানুষের আবাসন সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখছে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান জিডিপিতে অবদানের নিরিখে এটি একটি বিশাল খাত। রিয়েল স্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) দাবি মতে, এখাতে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ৩৫ হাজার উচ্চ শিক্ষিত লোকসহ প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও রয়েছে। জিডিপিতে গোটাখাতের অবদান ১৫ শতাংশের মতো। এহেন গুরুত্বপূর্ণ খাতটির অবস্থা দিন দিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে এর অবনমন শুরু। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। উত্তরনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্যযোগ্য নয়। রিহ্যাবের মতে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, জমির স্বল্পতা ও উচ্চমূল্য, শেয়ারবাজারে ধস, নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চমূল্য, ঋণের উচ্চ সুদহার ও ফ্ল্যাট ও প্লটের বর্ধিত নিবন্ধন ব্যয় ইত্যাদি কারণে আবাসন খাতে এক প্রকার স্থবিরতা নেমে এসেছে। হাজার হাজার ফ্ল্যাট ও প্লট অতিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা পড়েছে মহাবিপাকে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ দিতে না পারার বাস্তবতায় ফ্ল্যাটের বিক্রী বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে রিহ্যাব নেতৃবৃন্দ গত পরশু এক সংবাদ সম্মেলনে কতিপয় দাবি পেশ করেছেন। তারা আবাসন খাতে রিফাইনান্সিং ব্যবস্থা চালুর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছেন। তারা শর্তহীনভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ ফ্ল্যাট ও প্লট ক্রয়ে বিনিয়োগের জন্য সুযোগ দেয়ার আহŸান জানিয়েছেন। এই সঙ্গে ফ্ল্যাট ও প্লটের নিবন্ধন ব্যয় কমানোর কথাও বলেছেন। আবাসন খাতের যে বিপন্নপ্রায় দশা, তাতে তাদের এই দাবিগুলোর যৌক্তিকতা বিশেষভাবে প্রতিধানযোগ্য। অবশ্য বলাই বাহুল্য, এসব দাবি মোটেই নতুন নয়। বিভিন্ন সময় তারা দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন। এখাতের সংকট নিরসনে রিফাইনাসিং সুবিধা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সরকার তার বহুখাতে, বহু প্রকল্পে ব্যয়বৃদ্ধি করছে। নানা খাতে আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা দিচ্ছে। আবাসন খাতকে তুলে আনার জন্য সরকারের উদ্যোগ ও সহযোগিতা তাই স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যেতে পারে। আমরা জানি, আবাসন খাতে অপ্রদশিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ অতীতে দেয়া হয়েছে। তাতে আশানুপাতে সাড়া না পাওয়া গেলেও এ সুযোগ রহিত করা সঙ্গত হবে না। এই যে যথাযথ সাড়া না পাওয়া, তারও কারণ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, আয়কর বিভাগ ও বিভিন্ন সংস্থার হয়রানি ও বিড়ম্বনার আশঙ্কায় অনেকেরই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আসতে পারেনি। একটা অভয় অবস্থা নিশ্চিত না হলে এ বিনিয়োগ জোরদার হবে বলে মনে হয় না। এর পরিবর্তে অপ্রদর্শিত অর্থ আগের মতোই বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। অতীতে লক্ষ্য করা গেছে, অপ্রদর্শিত হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ওয়াকিবহাল মহলের অবিদিত নেই, আমাদের দেশে ফ্ল্যাট ও প্লট নিবন্ধনে ফি অত্যন্ত বেশী। সার্ক দেশগুলোতে যেখানে এই ফি ৪ থেকে ৭ শতাংশের বেশী নয়, সেখানে আমাদের দেশে ফি ১৪ শতাংশ।
সন্দেহ নেই, আবাসন খাতের বিনিয়োগ উচ্চ ঝুঁকিতে পড়েছে। বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়লে যে কোনো খাতের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়তে বাধ্য। অন্যদিকে এর সুফল পাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়া অবধারিত। কাজেই, এখাতের অবনতিশীল পরিস্থিতি ও সংকট নিরসন তাই জাতীয় স্বার্থেই অপরিহার্য। সরকারকে এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। রিহ্যাব যে দাবিগুলো করেছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। রিফাইনান্সিংয়ের ব্যবস্থা, বিনাশর্তে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ এবং ফ্ল্যাট ও প্লট নিবন্ধন ফি কমানো হলে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এই সঙ্গে প্রয়োজনীয় বা স্বল্প মূল্যে জমি দেয়াসহ গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে এ খাতের উত্তরণ দ্রæতায়িত হতে পারে। প্রসঙ্গত বলা আবশ্যক, বেসরকারী আবাসন খাতের বিনিয়োগকারীরা শুধু ব্যবসা বা অর্থ উপার্জনের জন্য বিনিয়োগ করেছেন বা করছেন এটা ভাবা ঠিক নয়, তারা একইসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবাকর্মে নিয়োজিত, এটা ভাবাও সঙ্গত। কাজেই তারা ফ্ল্যাট বা প্লটের দাম এত বেশী রাখবেন না, যা অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। সরকারকে আবাসন খাতের সংকট নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ক্রেতাস্বার্থের বিষয়টিও নজরে রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন