শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নির্বাচন কমিশন কি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০২২, ১২:৩০ এএম

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিরোধীদলসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হয়। তাদের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে, মেরুদন্ড সোজা করে কিংবা সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে দায়িত্ব পালন করার মতো ‘হিম্মতওয়ালা’ নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক। বিগত দুইটি নির্বাচন কমিশন বা তার আগের কমিশনের মেরুদন্ড ছিল না, এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই তারা এ দাবী করে আসছেন। দেশের বড় বিরোধীদল বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, বর্তমান সরকারের অধীনে গঠিত নির্বাচন কমিশনে কোনো লাভ নেই। তারা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেত সক্ষম হবে না। দলটির দাবী, সরকারের পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গঠিত নির্বাচন কমিশনই একমাত্র সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে। তাদের এ দাবি একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। আমরা দেখেছি, দেশের ইতিহাসে যে কয়টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশনই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পেরেছে। এর বাইরে অন্য কোনো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। কারণ হচ্ছে, তখন কমিশন ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে। এর ফলে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেনি। প্রশাসনকেও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বিগত রকিব ও হুদা কমিশন। এ দুটি কমিশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন করেছে। অনেকে বলে থাকেন, দলটির অনুগত এবং অনুকম্পার নির্বাচন কমিশন ছিল। তাদের পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের অদৃশ্য আকার-ইঙ্গিতের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। মাঝে মাঝে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছায় দুয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য দেখিয়ে কিংবা বিরোধীদলের প্রার্থীদের বিজয়ী করে দিয়ে তাদের সক্ষমতার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।

দুই.
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যে রকিব কমিশন গঠিত হয়, তা গঠন করা হয়েছিল সার্চ কমিটির মাধ্যমে। প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদলগুলোর সাথে পালাক্রমে মিটিং করে তাদের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনে নাম আহ্বান করে। প্রথম সার্চ কমিটিতে ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বড় বিরোধীদল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদল নাম প্রস্তাব করে। সেখান থেকে প্রেসিডেন্ট রকিব কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন গঠন করা নিয়ে তখন তুমুল বিতর্ক হয়। বিরোধীদল থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ এ কমিশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পছন্দমতো গঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে। এ কমিশন তার এখতিয়ারের মধ্যে থেকে কিংবা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবের বাইরে গিয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন করতে পারবে না বলে অভিমত দেয়। তাদের এই অভিমত অসত্য হয়নি। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারিতে যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে রকিব কমিশন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যায়। সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। সরকার গঠন করতে যেখানে ১৫০ আসন প্রয়োজন, সেখানে ক্ষমতাসীন দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও তার জোটের প্রবল আন্দোলনের মুখে এ নির্বাচন হয়। বিরোধীদলগুলোর বিরোধিতার তোয়াক্কা না করেই ক্ষমতাসীন দল পুনরায় সরকার গঠন করে। তখন তার পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়, সাংবিধানিক ধরা রক্ষার্থে এ নির্বাচন করা হয়ছে। অচিরেই সবদলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন দেয়া হবে। পরবর্তীতে তা আর হয়নি। এটা যে কথার কথা ছিল এবং বিরোধীদলগুলোর প্রতি সান্ত¦নার বাণী, তা পরবর্তীতে বুঝতে বাকি থাকেনি। উল্টো নির্বাচনটিকে জায়েজ করতে এবং বিরোধীদল যাতে পরবর্তীতে এর বিরোধিতা করতে না পারে, এজন্য সরকার তাদের উপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিয়ে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। এরপর রকিব কমিশনের অধীনে উপনির্বাচন, মেয়র, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের যতগুলো নির্বাচন হয়েছিল, তা সবই সরকারের অনুকূলে যায়। সরকার আর নির্বাচন কমিশনকে আলাদা করা যায়নি। নির্বাচন কমিশন ছিল নামকাওয়াস্তে। মূলত নির্বাচন করেছে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। কমিশনের কাজটি অনেকটা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে সাধারণ ভোটার এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অনেক সমর্থকও ভোটদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সরকারি দলের সচেতন সমর্থকরা নিশ্চিতভাবে তাদেরই ভোট দিত, তবে তারা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যাতে ভোটটি দিতে পারে, এ অধিকারটুকু চেয়েছিল। তাদের এ অধিকারও শেষ পর্যন্ত সংরক্ষিত হয়নি। ফলে ভোটের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ সৃষ্টি হয় এই ভেবে যে, ভোট দিয়ে লাভ নেই। নিশ্চিতভাবে সরকারি দলের প্রার্থীই জিতবে। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, দেশের যে ভোট ব্যবস্থা, তা রকিব কমিশন ভেঙ্গে দেয়। তার পরবর্তী হুদা কমিশনও একইভাবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত হয়। তারা রকিব কমিশনের ধারাবাহিকতা শুধু ধরে রাখেনি, এক কাঠি সরেস হয়ে ভেঙ্গে দেয়া ভোট ব্যবস্থাকে চূর্ণবিচুর্ণ করে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। অভিনব পন্থায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনটি রাতের আঁধারেই করে ফেলে। এ নির্বাচনে বিএনপি ও তার জোট অংশগ্রহণ করলেও তারা সাকুল্যে ১০টি আসনও পায়নি। বিএনপি পেয়েছে ৭টি। তারপরও বিরোধীদল যাতে বিতর্কিত নির্বাচনের বিরোধিতা করতে না পারে, ক্ষমতাসীন দল তাদের পীড়নমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে। রকিব ও হুদা কমিশনে যে ১০ জন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, তাদের বিবেকটি ছিল সরকারের কাছে বন্দী। হুদা কমিশনের মাত্র একজন মাহবুব তালুকদার ‘সলিটারি সোলজার’ হয়ে বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনের অনিয়ম, গণতন্ত্র আইসিইউতে বলে প্রতিবাদ করে গেছেন। তাতে কিছু যায় আসেনি। উল্টো প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার রোষের মুখে পড়েছিলেন। রকিব ও হুদা কমিশন গঠন করা হয়েছিল, শুধুমাত্র নিয়মরক্ষার নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার জন্য। তারা সরকারের পক্ষে ছিল, জনগণের পক্ষে ছিল না। অথচ, যথার্থ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে, কোথাও যদি একজন ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারে, তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া। কেন ভোটটি দিতে পারল না, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়া। বিগত দশ বছরে দেশের মানুষ দেখেছে, একজন নয়, কোটি কোটি ভোটার ভোট দিতে পারেনি। বহু আসনে ভোটেরও প্রয়োজন পড়েনি। বিনাভোটে নির্বাচন হয়ে গেছে। আমরা যদি ভারতের নির্বাচনের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, সেখানে বিজেপি’র মতো উগ্র এবং কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন বলবৎ থাকার পরও ভোট নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জী নিজে ক্ষমতায় থেকেই হেরে গেছেন। এ নিয়ে তার কোনো অভিযোগও ছিল না। নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার জন্য বিজেপি ও মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে কি তুমুল বাগবিতন্ডা ও নানা অভিযোগের শোরগোল শোনা গেলেও ফলাফলের পর এ নিয়ে কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। ক্ষমতায় থেকে বিজেপি’র ভরাডুবি হলেও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তার কোনো অভিযোগ ছিল না। বরং বিজেপি মমতার বিজয়কে অভিনন্দিত করেছে। আমাদের দেশে যতই সুষ্ঠু নির্বাচন হোক যদিও তার নজির খুব কম এবং হলেও বিজয়ী দলকে পরাজিত দলের অভিনন্দন জানানো দূরে থাক, নির্বাচনের পরদিন থেকেই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। বিগত একদশকে যে দুটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তাতে বিরোধীদলের হুমকি দূরে থাক, নির্বাচনের পরপরই ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিরোধীদলকে চুপ করিয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা গেছে।

তিন.
১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত ভারতের নির্বাচনে বেশ কিছু ত্রুটি ছিল। নির্বাচন মানেই অর্থ আর প্রার্থীদের প্রভাব মুখ্য বিষয় ছিল। এভাবেই সুদীর্ঘকাল ভারতে নির্বাচন হয়ে আসছিল। ১৯৯০ সালে ভারতের ১৮তম কেবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তিরুনেল্লাই নারায়ণা লিয়ার সেশান, যিনি টি এন সেশান হিসেবে পরিচিত, তাকে ১০ম নির্বাচন প্রধান কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দায়িত্ব পেয়েই তিনি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার তা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজান। কমিশনের কর্মকর্তা তার পছন্দমতো নিয়োগ দেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হিসেবে শতাধিক অসঙ্গতি শনাক্ত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেন। নির্বাচনী আচরণবিধি, প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় সীমিতকরণ, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে প্রচারণা না চালানো, পূর্বানুমতি ছাড়া মাইকে বা অন্য উপায়ে উচ্চশব্দে প্রচারণা চালানো বন্ধ, ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রচারণা বন্ধ, প্রার্থীদের হিসাব যথাযথভাবে দেয়ার মতো আরও অনেক পদক্ষেপ নেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন, প্রতিটি আসনে নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের আচরণবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যবেক্ষক দল নিয়োগ দেন। এতে প্রার্থীদের অত্যন্ত হুশিয়ার হয়ে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। কোনো ধরনের অনিয়ম হলেই নির্বাচন কমিশন প্রার্থীতা বাতিল করে দিতেন। ’৯২ সালে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘণের দায়ে বিহার ও পাঞ্জাবের নির্বাচন তিনি বন্ধ করে দেন। একই বছর তিন বছরের আর্থিক হিসাব ও মিথ্যা তথ্য দেয়ায় ১৪ হাজার প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল করেন। ১৯৯৯ সালে তিন বছরের আর্থিক হিসাব যথাযথভাবে দিতে না পারায় তিনি ১৪৮৮ জন প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য টি এন সেশানের এই ‘ড্রাস্টিক অ্যাকশন’ তখন প্রশংসিত হয়। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও তার কাজে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপ করেনি। এর ফলে ভারতে একটি শক্তিশালী নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে উঠে। তিনি পাঁচ বছর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চলে যাওয়ার পরও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা পরবর্তীতেও অব্যাহত থাকে। ফলে ভারতের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদল থেকে শুরু করে দেশটির জনগণের কোনো অভিযোগ নেই। একজন মেরুদ-সম্পন্ন এবং ডিটারমাইন্ড প্রধান নির্বাচন কমিশন যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ রচনা করে দিতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন টি এন সেশান। আমাদের দেশেও যে ভারতের মতো না হোক, মোটামুটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি, তা নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ’৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচন দুটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পরপর এই দুই নির্বাচন কমিশন যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা পরবর্তী কোনো নির্বাচন কমিশনই ধরে রাখতে পারেনি। সে সময় ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের মধ্যে এমন মাইন্ডসেট সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন যে নির্বাচন করবে তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। এতে ক্ষমতাসীনদল ও বিরোধীদল রাজনীতি করার ক্ষেত্রে সচেতন থাকত। কি করলে জনসমর্থন বাড়বে এবং কি করলে কমবে, এ চিন্তা মাথায় নিয়ে রাজনীতি করত। বলা যায়, একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথে আমাদের রাজনীতি পা রেখেছিল। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের অদূরদর্শীতা পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে দেয়। পরবর্তীতে ওয়ান-ইলেভেন সরকার এসে যে নির্বাচন করে তাও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল, তা নয়। তবে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এ নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে বাতিল করে দেয়। আদালতও জানত, দলীয় সরকারের অধীনে আমাদের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না এবং হবেও না। এ কারণে রায়ের এক অংশে বলে দিয়েছিলেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে আদালতের রায়ের এ অংশটুকু ক্ষমতাসীন দল আমলে না নিয়ে তার অধীনেই নির্বাচনের আইন সংসদে পাস করে। এরপর নির্বাচন কমিশন গঠন এবং তার ভূমিকা দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। এই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল অনেকটা চালাকির আশ্রয় নেয়। সার্চ কমিটি গঠন এবং তাতে সব দলের প্রতিনিধি দেয়া নিয়ে এ চালাকির ঘটনা ঘটে। ২০১৭ ও এবারের যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, তাতে এ চালাকি ধরা পড়ে। নির্বাচন কমিশনে ক্ষমতাসীনদের পছন্দের লোক নেই, এমন ধারণা সৃষ্টি করার জন্য তার জোটভুক্ত ছোট ছোট দল দিয়ে সিইসিসহ অন্যন্যা নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করায়। সরকারিদলের জোটভুক্ত সরকারঘেঁষা তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-বিএসডি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)-এর প্রস্তাবিত তালিকা থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও বলা হয়, সার্চ কমিটিতে দেয়া ক্ষমতাসীন দলের এবারের তালিকা থেকে কেউ নির্বাচন কমিশনে জায়গা পায়নি। এটা বলে এ কথাই প্রমাণ করতে চায়, তাদের পছন্দের কাউকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেয়া হয়নি। কাজেই এটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, গঠিত নির্বাচন কমিশন কি উল্লেখিত সরকারি দলের জোটভুক্ত ও তার মিত্রদের পক্ষে কাজ করবে? তাদের ভোটে জেতাবে? বোধসম্পন্ন কেউই এ ধরনের চিন্তা করবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, দলগুলোর ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার মতো সক্ষমতাই নেই এবং তাদেরকে ক্ষমতাসীন দলের অনুকম্পায় তার প্রতীক দিয়েই পাস করিয়ে আনতে হয়। সরকারি দলের দেয়া নাম প্রস্তাব করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশন গঠন করার ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যই তাদের আত্মতৃপ্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য, ক্ষমতাসীন দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য একজনও যোগ্য লোক বাছাই করতে পারেনি কিংবা তার সক্ষমতা নেই? বিশ্বাস করার কারণ নেই। এখানে ক্ষমতাসীন দল চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। তারা তার শরিক ও সমর্থক ছোট ছোট দল দিয়ে তাদের পছন্দের তালিকা উপস্থাপন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে চেয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের তালিকা থেকে নির্বাচন কমিশনে কাউকে না নিলেও তারা ভালো করেই জানে, নির্বাচনের সময় তারাই ক্ষমতায় থাকবে এবং কমিশনকে তাদের প্রভাব ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেই নির্বাচন করতে হবে। ফলে তাদের তালিকা থেকে নাম নেয়া, না নেয়া কোনো বিষয়ই নয়।

চার.
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল শপথ নেয়ার পর এবং পরবর্তীতে বেশ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিটি নির্বাচনই একটা চ্যালেঞ্জ। মানুষের জীবনটাও চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ভয় পেলে হবে না। চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হবে।’ তার এ কথার সূত্র ধরে বলা যায়, তিনি কি টি এন সেশানের মতো বুক চিতিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দিকে না তাকিয়ে এবং তাদের প্রভাবমুক্ত হয়ে, প্রার্থীদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে কাটিয়ে, প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবেন? টি এন সেশান তো সরকার ও প্রার্থীদের কোনো প্রভাবের তোয়াক্কা করেননি। তিনি কি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই বেতোয়াক্কা হতে পারবেন? কারণ, তার সামনে তো ক্ষমতাসীন দলের অধীনে রকিব ও হুদা কমিশনের মতো আজ্ঞাবাহী নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন করার উদাহরণ রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, তার পক্ষে এ কাজ করা শুধু চ্যালেঞ্জ নয়, কঠিন এবং কঠিনতর। আবার এ কথাও বলা যায়, কেউই নিরপেক্ষ নন। প্রত্যেকেই তার পছন্দ মতো দল ও প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকেন। সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে নিরপেক্ষ হচ্ছে কাঠ বা সোফা দিয়ে নির্মিত নির্জীব চেয়ারটি। এটি বিচার ও বিবেকের প্রতীক। এই চেয়ারে বসলে যদি ব্যক্তির ব্যক্তিগত চেতনা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে ন্যায়-ন্যায্য’র প্রতীক হয়ে উঠে, তাহলেই কেবল সম্ভব আবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। ব্যাক্তিগত ব্যাপার যখন দলীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তখন কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন