যমুনা ও বাঙালি নদীর বুকে এখন ধু ধু বালুচর : করতোয়া নদীর বুকে হচ্ছে বোরো ধানের আবাদ : ফারাক্কার বাঁধসহ অন্যান্য নদীর উৎসমুখে বাঁধ, স্পার, রেগুলেটর নির্মাণ করে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এদেশের নদীগুলো মৃত্যুর মুখে : বাপা
ফারাক্কার মরণ বাঁধের বিরূপ প্রভাবে কাঠফাটা চৈত্র আসার আগেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে বগুড়ার নদনদী। এ অঞ্চলের বড় নদী যমুনা ও বাঙালি নদীর বুকে এখন ধু ধু বালুচর। এসব নদীতে নেই স্রোতধারা, নেই কোন প্রবাহ। নদীগুলো ক্ষীণ জলধারা নিয়ে মৃত প্রায়। এ ছাড়া ঐতিহাসিক করতোয়া নদীর বুকে কোথাও কোথাও বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। কোথাও কচুনিপানা, ময়লা অবর্জনার স্তুপ।শিবগঞ্জের গাং নৈ, দুপচাঁচিয়ার নাগর, গাবতলির ইছামতি, ধুনটের ভদ্রা ইত্যাদি নদী এখন শীর্নকায় খালের আকারে নিজেদের অস্তিত কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছে।
তিন দশক আগেও বগুড়ায় ছোট বড়ো মিলিয়ে ২৮ টি নদীর অস্তিত্ব ছিল। জেলা প্রশাসনের মহাফেজখানায় এ তথ্য রয়েছে। সেই ২৮টি নদী থেকে বগুড়ায় এখন রয়েছে মাত্র ৭ টি নদী। ভারত ফারাক্কাসহ অন্যান্য নদ-নদীসমুহের উৎসমুখে এক তরফাভাবে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মওশুমে পানি প্রত্যাহারের কারণে এদেশের নদীগুলোর এই মরণদশা। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে দখল, দুষণ ইত্যাদি কারণেও দিনে দিনে নদীগুলো মরে যাচ্ছে এবং অস্তিত্ব হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হযতো আর কিছুদিনের মধ্যেই বগুড়ার মানচিত্রে নদীর আর কোন চিহ্ন থাকবে না।
বগুড়া পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ ফজলে রাব্বি ডলার জানান, ভারত ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুসহ বিভিন্ন নদ-নদীর উৎসমুখে ছোটবড় বাঁধ, স্পার, রেগুলেটর নির্মাণ করে শুকনো মওশুমে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পানি সংকটের এটাই মুল কারণ। সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কে জি এম ফারুক বলেন, জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় ভুমি দস্যুরা ছোটছোট নদ-নদীর বুক ভরাট করে দখল করে নিচ্ছে। বগুড়ার ছোট বড় নদ-নদীগুলোর অপমৃত্যুর পেছনে এটাও একটা বড় কারন।
বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহমান ঐতিহাসিক করতোয়া নদী সর্বাধিক দখল ও দুষণের শিকার। এক সময়ের স্রোতস্বীনী করতোয়ার স্বচ্ছ পানির প্রবাহ দেখলে পথিকের চক্ষু শীতল হয়ে যেত। সেই নদীর বুকে এখন কচুরিপানা, ময়লা আবর্জনার স্তুপ। শতশত সওদাগরী নৌকা করতোয়া নদী দিয়ে এসে ভিড়তো শহরের উপকন্ঠে। খুলনা ও মংলা থেকে আসতো নারিকেল সহ আমদানি করা বিদেশী পণ্য। বগুড়া থেকে পাট, চাউল, মরিচ, আলু নিয়ে ফিরতি যাত্রা করতো সেসব নৌকা। নৌ পথের খরচ কম পড়তো বিধায় পণ্যের দামও থাকতো মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই বলে জানিয়েছেন বগুড়ার সিনিয়র নাগরিকবৃন্দ। কিন্তু সেব দৃশ্য এখন আর নেই। তারা বলেছেন, বগুড়ার ফুসফুস হিসেবে খ্যাত ঐতিহিাসিক করতোয়া নদী এখন ময়লা আবর্জনার ভাগারে পরিণত হয়েছে। নদীতে ময়লা আবর্জনা দেখলে মনটায় খারাপ হয়ে যায়, ধড়ফড় করে ওঠে বুক।
কবি বলেছেন, যে নদী হারায়ে পথ চলিতে নাহি পারে, সহ¯্র শৈবাল ধাম বধে আসি তারে’। কবির এ কথার মতই এখন করতোয়ার অবস্থা। হাজামোজা করতোয়া নদীর বুকে শুকনো মওশুমে কোথাও বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে কোথাও কচুরিপানার সমাহার। দেখে মনে হয় শীর্ণ খাল।
পশ্চিম বগুড়া দিয়ে একেবেঁকে বয়ে চলা নদের নাম নাগর। এই নদীটিই শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। এর উচ্ছ¡ল প্রবাহ দর্শনে বিশ্বকবিও কবিতা লিখেছেন। কালের প্রবাহে সেই নাগর নদীও আজ বালিদস্যু, ভুমি দস্যু এবং অসচেতন মানুষের দুর্বিনিত আচরনের কারনে প্রতিদিনই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
নদনদীর অপমৃত্যুকে ঘিরে বগুড়ার বিভিন্ন খাল, বিল জলাশয়সমুহও শুকিয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। পেশা হারাচ্ছে শতশত জেলে পরিবার। অথচ তিন দশক আগেও বগুড়ার পূর্বাঞ্চলে ছিল অসংখ্য জেলে পল্লী। ছিলো ধীবর ও কৈবর্ত সংস্কৃতির অস্তিত্ব ও অনেক অনুসারী। বগুড়ার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আব্দুর রহীম বগরা ইনকিলাবকে বলেন, পূর্ব বগুড়া অঞ্চলে মৎস্যজীবী কৈবর্ত বা ধীবর সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যায় বসবাস ছিল পুরাকাল থেকেই। তার মতে মাছে ভাতে বাঙালী বলে যে কথাটার প্রচলন রয়েছে সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল পূর্ব বগুড়ার নদী বিধৌত এলাাকার জনবসতিগুলো। পূর্ব বগুড়ার সর্ববৃহৎ যমুনা নদীর পাঙাশ, ইলিশ, চিংড়ি, গলসা, বোয়াল, রিঠা, কালি বাউশ, আইড় ও বাঘাইড় মাছ ছিল বিখ্যাত। এছাড়া বাঙালি নদীর রুই, মৃগেল, করতোয়ার চেলা ও বোয়াল, গুজা ইত্যাদি মাাছের ছিল ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। এখন এগুলো এই প্রজন্মের মানুষের কাছে অনেকটাই রূপ কথার গল্পেরম মত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন