সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে...বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,/ কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/ দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভ‚মি-স্তনে। কপোতাক্ষ নদের পানিকে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার কবিতায় এভাবেই দুগ্ধ-স্রোতরূপী বলে অখ্যায়িত করেছেন। কাকের চোখের মত স্বচ্ছ টলটলে এ নদের পানিতে কবি তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। অথচ সেই স্রোতস্বীনি কপোতাক্ষ নদ এখন জীর্ণ-শীর্ণ এক মরা খালে পরিণত হয়েছে।
ফারক্কা বাঁধ এবং অন্যান্য নদীর উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণ করে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এদেশের নদীগুলো দিন দিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ষাটের দশকে বৃহত্তর খুলনায় ছোট বড় ৭৮ টি নদী ছিল। খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেকর্ডে এ তথ্য রয়েছে। অথচ মরণ বাঁধ ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে ২০২০ সালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ইতোমধ্যে ২৫ টি নদী মরে গেছে। ১০ টি নদী চর পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ার পথে। স্রোত কমে অনেকটা নিথর হয়ে গছে আরও ১০ টি নদী। অর্থাৎ শতকরা ৬০ ভাগ নদীই মানচিত্র থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নদী বিধৌত খুলনার উপর প্রথম আঘাত আসে ষাটের দশকে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ন্যায্য পানির হিস্যা না দেয়ায় পানি প্রবাহ কমে পদ্মা ও গড়াই এর শাখা নদী মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, চিত্রা, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা ও অভিন্ন নদী ইছামতি ও কোদলাসহ অর্ধ শত নদনদীর সিংহভাগ সরু খালে পরিণত হয়। প্রবাহহীন এসব নদীর তলদেশ দ্রæত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে পানি কম থাকায় জোয়ারের সময় সাগরের লবন পানি প্রবেশ করছে। এতে স্বাভাবিক কৃষি ও জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
এছাড়া দখল-দূষণ, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ, নদী খননের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জনপ্রতিনিধিদের লুটপাট এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে খুলনাঞ্চলের মানচিত্র থেকে একে একে অনেক নদী হারিয়ে যাচ্ছে। উপক‚লীয় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত খুলনা-বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার কোনো কোনো নদীতে এখন হাঁটু পানি। কোথাও নদীর বুকে সারা বছর চলে চাষাবাদ। নাব্য সঙ্কটে বন্ধ হয়ে গেছে একাধিক নৌ রুট। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। কমছে মৎস্য সম্পদ, হুমকিতে রয়েছে জীববৈচিত্র ও নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবন জীবিকা। বারবার নদী রক্ষা ও নদী শাসনের নামে বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও কার্যত কোনো সুফলই মিলছে না।
নদ নদী মরে যাওয়ায় খুলনাঞ্চলের ৩০ টি নৌ রুটের মধ্যে মাত্র ৬ টি এ মুহুর্তে সচল রয়েছে, বাকী ২৪ টিই বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবোচরের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে নৌযানগুলো চলাচল করছে। খুলনার রূপসা ও ভৈরবের বিভিন্ন স্থাানে চর পড়েছে। ফলে খুলনা কেন্দ্রিক নৌ বাণিজ্যও সংকটে পড়েছে।
খুলনার লঞ্চ মালিক সমিতির কর্মকর্তা আহসান হাবীব জানান, পণ্য পরিবহণে লাভজনক পথ হচ্ছে নদীপথ। নাব্য সংকটে এখন লঞ্চ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই লঞ্চ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। নদীগুলো যথাযথভাবে খনন করা গেলে আমারও নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সুদিন ফিরে আসতো।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নির্বাহী সভাপতি ড. আব্দুল মতিন বলেন, ফারাক্কাসহ অন্যান্য নদীতে ভাঁধ দিয়ে এক করফা পানি প্রত্যাহার করে ভারত এদেশের নদ-নদীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় উপকূলীয় অঞ্চল অর্থাৎ খুলনা-বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় লবাণাক্ত বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জমিতে ফসল হচ্ছে না। জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে। সব মিলিয়ে ভারতের পানি আগ্রসনের ফলে এদেশ মরুকরণের দিকে যাচ্ছে। ফারক্কায় পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যাচ্ছে না। তিস্তার পানি চুক্তি হচ্ছে না। অথচ এ নিয়ে সরকারের খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। নদী হচ্ছে এদেশের প্রাণ। সেই নদী যদি মরে যায় তাহলে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের মুখে পড়বে। তাই নদী বাঁচাতে সরকারের দ্রæত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ফারাক্কার বাঁধের প্রভাবে নদীগুলোর যখন মৃত্যু শয্যায় ঠিক সেই সময় অবৈধ দখল ও দূষণ নদীগুলোর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে গত দুই যুগে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া, খর্ণিয়া ও রুদাঘরা ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের প্রমত্তা ভদ্রা ও হরি নদীর তীরের চর ভরাট জমি স্থাানীয় এমপি ও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি দীর্ঘ দীর্ঘ দিন ধরে অবৈধ ভাবে দখল করে ইট ভাটা পরিচালনা করে আসছেন। এর প্রেক্ষিতে গত বছর ২২ ফেব্রæয়ারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হরি ও ভদ্রা নদীর জায়গা দখল করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটা উচ্ছেদের জন্য জনস্বার্থে সংগঠনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়ার আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রীট পিটিশন দায়ের করেন। এক পর্যায়ে গত বছর ১৪ ডিসেম্বর মহামান্য হাইকোর্ট রীট পিটিশনটি শুনানী শেষে পরবর্তি ৬০ দিনের মধ্যে ১৪টি ইটভাটার মধ্যে সরকারি জায়গায় স্থাপিত সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে নদী দখলমুক্তে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। উচ্ছেদের আদেশ দেয়া ইটভাটার মধ্যে খুলনা ০৫ আসনের এমপি সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ’র মালিকানাধীন কে.পি.বি ব্রিকস রয়েছে। এ আদেশের পর উপজেলা প্রশাসন গত ২০ ফেব্রæয়ারি উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলেও পরে তা অজ্ঞাত কারণে ঝিমিয়ে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র মতে খুলনায় তালিকাভুক্ত অবৈধ নদী দখলদার রয়েছে ২ হাজার ৩০০ জন।
খুলনাঞ্চলের নদ-নদীর মৃত্যুর পেছনে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষও দায়ি। তিন জেলার লক্ষাধিক ঘের থেকে উৎপাদিত চিংড়ি বিশ্ববাজারে রফতানি করা হয়। বছরে আয় হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু চিংড়ি চাষের নামে যত্রতত্র নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ আটকানো হয়। ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে। এভাবে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের সব উপজেলায় একই চিত্র। বাংলাদেশ ফিশ ফার্ম ওনার্স এসোসিয়েশন এর কেন্দ্রিয় সভাপতি মো. শাহীন জানান, অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। নদ নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর মৃত্যুকে তরাম্বিত করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, নদ-নদী মরে যাওয়ায় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। মাছের অবাধ চলাচল না থাকায় এ অঞ্চলে মৎস্য সংকট দেখা দিয়েছে। উপক‚লীয় এলাকা থেকে মিষ্টি পানির কমপক্ষে ২০ প্রজাতির মাছ প্রায় হারিয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
নদী খননের নামে একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও সংশ্লিষ্টদের লুটপাট ও অপরিকল্পিত পরিকল্পনার কারণে কোনো সুফলই পাওয়া যাচ্ছে না। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খুলনার ভদ্রা ও সালতা নদী পুনর্খননের কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এর জন্য ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। কথা ছিল, দুটি নদীর ৩০ কিলোমিটার ১২০ ফুট চওড়া আর ১৬ ফুট গভীর করে পুন:খনন করা হবে। বাস্তবে তা করা হয়নি। নদী খননের মাটি পাশেই রাখা হয়েছিল। ফলে যা হবার তা হয়েছে। নদী ভরাট হয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা খরচ করে বাকী টাকা পকেটে গেছে পাউবো কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের। গত বছর খুলনাঞ্চলের নদ-নদী খননে ১ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের আশংকা, এবারও নদী খননের নামে অবাধ লুটপাট চলবে, সুফল কিছুই মিলবে না।
খুলনাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নদীগুলো ছিল শিবসা, পেসা, বলেশ্বর, পগুর, আড়পাঙ্গাসিয়া, খোলপেটুয়া, আগুনমুখা, ভদ্রা, আঠারোবাকী, আলাইপুর, গাসিয়াখালী, দড়াটানা, ইছামতী, খোলপটুয়া, রায়মঙ্গল, নমুদ সমুদ্র সোনাগাঙ্গ, ভাঙ্গরাকুঙ্গ, মালঞ্চ, সাতক্ষীরা, সুতেরখালী, মারজাতী, হারিণভাঙ্গা, মহাগঙ্গ, গলাঙ্গী, হরিপুর, সোনাই বুধহাটার গাঙ্গ, ঢাকি, গলাঘেমিয়া, উজীরপুর, কাটাখাল, গুচিয়াখালী, খাল আকরার, খাল মংলা, সোলপায়ারা আগুরমুখ মহুরী মোদলাম হাডুয়াভাঙ্গা পানগুছি, মেয়ার গাং, কাজিবাছা, কাকশিয়ালি, বলেশ্বর মরাভোলা। নদীগুলোর সিংগভাগ ভরাট হয়ে যাওয়ায়, সমগ্র উপক‚লজুড়ে পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। ভাটায় পানি নেমে জোয়ারে লবনাক্ত পানি ঢুকছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের শিক্ষক ড. দিলীপ কুমার দত্ত জানান, উপক‚লীয় স্বাদু জলের এলাকা ৪৫ ভাগ থেকে কমে ৩৬ ভাগ, মৃদু লবণাক্ততার এলাকা ৫০ ভাগ থেকে কমে ৪৭ ভাগে নেমে এসেছে। অপরদিকে আগামীতে তীব্র লবণাক্ততার এলাকা ৫ ভাগ থেকে বেড়ে ১৭ ভাগে উন্নীত হবে। ভ‚গর্ভস্ত পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। নদ নদীর বেঁচে থাকার সাথে মাটির অভ্যন্তরে পানির স্তরের সজীবতার সম্পর্ক রয়েছে সরাসরি।
স্থাানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ছায়াবৃক্ষের প্রধান নির্বাহী মাহবুব আলম জানান, নদ নদী মরে যাওয়ায় জীবন ও পরিবেশ চরম হুমকির মুখে রয়েছে। উপক‚লের ৫ লক্ষাধিক মানুষ সরাসরি নদীর সাথে জীবিকার বন্ধনে বাঁধা। তারা মাছ, কাঁকড়া, পোনা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া নৌকা ট্রলার চালানোসহ নদী কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যও করে থাকে। নদীই তাদের প্রাণ। এখন আর নদীতে পাল তোলা নৌকা চলে না। লঞ্চের সাইরেন শোনা যায় না। ১৯৮০ সাল পর্যন্তও নদ নদীগুলোর অবস্থা মোটামুটি ভাল ছিল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন