কে, এস, সিদ্দিকী
একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আবু হোরায়রা (রা.)-কে বলেন, ইবলিশ চরম মিথ্যাবাদী, অথচ তোমাকে সে সত্য কথা বলেছে ইবলিস সারাক্ষণ মিথ্যার বেশাতি করা ছাড়াও এমন কোনো দোষ বা মন্দ কাজ নেই যা করেনা। দুনিয়ার সর্ব প্রকারের পাপাচার ও অঘটনের গুরুঠাকুর হচ্ছে ইবলিশ। তার ভক্ত-অনুসারী, চেলা-চামুন্ডার দল হচ্ছে একশ্রেণির মানব ও দানব। (শায়াতানুল ইনসি ওয়াল জিন কোরআন) ইবলিশ শয়তানের প্রতারণা-প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে মানুষ বিভ্রান্ত-গুমরাহ হয়ে জাহান্নামি হয়।
ইবলিস শয়তানের কলঙ্কিত জীবনে দুর্যোগ-দুর্বিপাক এই দুনিয়াতেও এসে থাকে। তখন সে বিপদ হতে আত্মরক্ষার জন্য কখনো কখনো সত্য কথা বলে থাকে। এরূপ বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু হোরায়রা (রা.)-এর সাথে সংঘটিত ওই ঘটনার কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। তিরমিজি শরিফে বর্ণিত ঘটনাটি নি¤œরূপ :
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে ফিতরা সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান করেন। এক রাতে আমি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় দেখতে পাই যে, এক বৃদ্ধ আসে এবং ফিতরা সামগ্রী হতে কিছু গম চুরি করে পালাতে থাকে। আমি তাকে গ্রেফতার করি এবং বলি যে, তোকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে নিয়ে যাব। সে আমাকে আকুতি করে বলে, আমার পরিবার-সন্তানাদি আছে, আমি একজন দরিদ্র-অভাবী ব্যক্তি। অনাহারে এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। আজ আমাকে ছেড়ে দিন, আগামীতে এদিকে আর আসব না। তার কাতর কণ্ঠে আমার দয়া হয়। আমি তাকে ছেড়ে দেই।
ভোরে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার কয়েদির কী অবস্থা? আমি সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে বলি, সে ভবিষ্যতে আর আসবে না বলে অঙ্গীকার করেছে এবং অনুনয়-বিনয় করায় আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার বর্ণনা শুনে বলেন, আজ রাতে সে আবার আসবে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এ কথা বলায় আমার বিশ্বাস হয় যে, সে অবশ্যই আসবে। সুতরাং রাতে আমি তার প্রতীক্ষায় থাকি। রাতের শেষ প্রহরে আবার সে আসে এবং কিছু গম উঠিয়ে নেয়। আমি তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলি। সে আবারও আমার কাছে অনুরোধ করে ছেড়ে দিতে এবং বলে যে, তার ছেলেপেলে আছে। অভাবের তাড়নায় সে এ কাজ করতে আসে। আগামীতে আর কখনো এ কাজ করতে আসবে না বলে দৃঢ় অঙ্গীকার করে। তার প্রতি দয়াপরবশত হয়ে আমি এবারও তাকে ছেড়ে দেই।
ভোরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে হাজির হলে তিনি আবারও প্রশ্ন করেন, তোমার বন্দির কি হলো? আমি পূর্ণ ঘটনা আবার ব্যক্ত করি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে মিথ্যা বলে। আজ রাতে সে ফের আসবে। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, তৃতীয় রাতও আমি তার অপেক্ষায় থাকি। সে রাতেও সে আসে এবং সদকার মাল হতে কিছু গম উঠিয়ে নেয়। এ সময় আমি আটক করি এবং তাকে বলি যে, আজ তোকে যেভাবেই হোক রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট হাজির করবই করব, আর তোর কোনো ভান করা চলবে না, তোর কোনো আপত্তি শুনব না, তোর কোনো ওয়াদা-অঙ্গীকার মানব না। সে বলে, আজ তুমি যদি আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে এমন কিছু কলেমা বাক্য শিখিয়ে দেব যা সারা জীবন তোমার উপকারে আসবে। আমি বলি, সে কলেমাগুলো কী? সে বলে, রাতে শোবার সময় আয়াতুলকুরসি পড়ে নেবে, আল্লাহ তোমার রক্ষণকারী ও নিরাপত্তা বিধানে ফেরেশতাদের নিয়োগ করবেন এবং রাতে শয়তান তোমার নিকট আসবে না।
এক কথা শুনে আমি তাকে ছেড়ে দিই। ভোর হওয়ার পর আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হই। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার কয়েদির কী খবর? আমি আয়াতুলকুরসির বরাতে তার কথা উদ্ধৃত করি এবং সমগ্র ঘটনা বর্ণনা করি। তিনি বলেন, ‘ছাদাকাকা ওয়া হুয়া কাজুবুন’Ñ তোমাকে সে সত্য কথা বলেছে, আসলে সে মিথ্যাবাদী। অতঃপর তিনি বলেন, আবু হোরায়রা। তুমি কি জান, তিনদিন যাবত তোমার নিকট আগত ব্যক্তি (বৃদ্ধ) কে ছিল? আমি বলি, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জানা নেই। তিনি বলেন, সে ছিল শয়তান।
আয়াতুলকুরসির ফজিলত-মাহাত্ম্য বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যা আমাদের এ আলোচনাবহির্ভূত। তবে আয়াতুলকুরসি পাঠের প্রভাব সম্পর্কে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত এতদসংক্রান্ত বিস্ময়কর কাহিনীগুলোর মানবের ক্ষতিসাধনকারী দানব দৈত্যের একটি হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহ.)-এর বরাতে নি¤েœ উল্লেখ করা যাচ্ছে, যাতে বলা হয়েছে যে, এক ভয়ংকর দৈত্য-দানব আয়াতুলকুরসি পাঠ করার ফলে ভস্মীভূত হয়ে যায়, ঘটনাটি এরূপ :
ইমাম গাজ্জালী (রহ.) ইবনে কোতাইবার বরাতে লিখেছেন যে, বনি কাবের এক ব্যক্তি খেজুর ব্যবসার উদ্দেশ্যে বসরায় গমন করে। লোকটি বলে যে, বসরায় আমি কোনো বাসস্থান পায়নি। একটি বিরান গৃহ দৃষ্টি গোচারীভূত হয়, যার প্রাচীর ও ছাদে মাকড়সা ঝুলছিল। গৃহের মালিককে আমি অবগত হই এবং তার কাছ থেকে গৃহটি ভাড়া করার জন্য কথাবার্তা শুরু করি। মালিক বলেল, ভাড়া দিতে আমার আপত্তি নেই, তবে ঘরটি খুবই বিপজ্জনক। তা একটি ভয়ঙ্কর দৈত্য অধিকার করে রেখেছে, সেখানে যে কেউ বসবাস করতে যায়, দৈত্যটি তাকে হত্যা করে। তাই তুমিও প্রাণ রক্ষার স্বার্থে অন্যত্র বাসা খোঁজ কর।
খেজুর ব্যবসায়ী লোকটি বলেল, তুমি আমাকে ঘরটি দাও। আল্লাহ মালিক, ব্যাপারটি আমার ও দৈত্যের। আমি গৃহটির দখল নিয়ে সেখানে উঠে পড়ি। রাতে গভীর অন্ধকারে দেখতে পাই এক দীর্ঘকায় ভয়ঙ্কর গাঢ় কালো দৈত্য আমার কক্ষে ঢুকে পড়েছে। আপাদমস্তক কালো, নয়ন যুগল হতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে, ধীরে ধীরে আমার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সে যখন আমার নিকটবর্তী হয়, তখন আমি আয়াতুলকুরসি পাঠ করতে থাকি, সেও আমার সাথে তা আওড়াতে থাকে, আমি যা পাঠ করি সেও আবৃত্তি করতে থাকে। আমি যখন আয়াতুলকুর্সির শেষ অংশে পৌঁছি এবং ওয়ালা ইয়াওদু হিফজুহুম্মা ওয়াহহুয়াল আলিয়্যল আজিম পড়তে থাকি, তখন তার জবান রুদ্ধ হয়ে যায়। আমি যখন দেখি সে এই অংশ আবৃত্তি করতে অক্ষম হয়ে গেছে, তখন আমি সেই বাক্যগুলো বার বার উচ্চারণ করতে থাকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় সেই কালো দৈত্য আমার সামনে হতে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি স্বস্তিবোধ করি এবং শান্তিপূর্ণভাবে ঘুমাই। ভোরে জাগ্রত হওয়ার পর দেখি, যে স্থানে দৈত্য দাঁড়ানো ছিল, সেখানে একটি পুড়ে যাওয়া লাশ পড়ে আছে এবং গায়েবি আওয়াজ শুনি, তুমি রাতে একটি বিরাট দৈত্য জ্বালিয়ে দিয়েছ। আমি জিজ্ঞাসা করি, কোন বস্ত দ্বারা সে দগ্ধ হয়েছে? গায়বেী আওয়াজ আসেÑ ওয়ালা ইয়াওদু হিফজু হুম্মা ওয়াহহুয়াল আলিয়্যল আজিম। আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশারদগণ পরীক্ষা করে বলে থাকেন, ভয়ঙ্কর ভীতিকর অবস্থায় আয়াতুলকুরসি পাঠ করার সময় আয়াতের উদ্ধৃত শেষ অংশটুকু বার বার পাঠ করা উচিত।
জিন তথা দানব-দৈত্য দমনের মহৌষধ হচ্ছে আয়াতুলকুরসি। শয়তানের মুখে এর সত্যতা প্রকাশকে রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীকার করেছেন, যার প্রমাণ উল্লিখিত ঘটনা। এখানে আরো একটি বিষয় স্মরণ করা যেতে পারে, পাশ্চাত্যঘেঁষা নব্য শিক্ষিত যারা জিন-শয়তানের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন বা সন্ধিহান, বর্ণিত ঘটনার ন্যায় আরো অসংখ্য ঘটনা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস দূরীভূত করার জন্য যথেষ্ট।
কোরআনে জান্নাত-জান্নাতি এবং জাহান্নাম ও জাহান্নামিদের সম্পর্কে অজস্ত্র আয়াত বিদ্যমান। ইবলিশ শয়তানের খোলাফা মুরিদানের শোচনীয় পরিণতি নানা আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে। কেয়ামতে হিসাব-কিতাবের পর ইবলিশকেও জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। সে সময় ইবলিশ তার প্ররোচনা-প্রতারণার কথা স্বীকার করবে এবং পাল্টা প্রশ্ন করবে, তারা ইবলিশের প্ররোচনায় সায় দিয়েছে কেন? তার বিভ্রান্তিকর কথাবার্তার প্রতি তারা কান না দিলেই পারত। ইবলিশের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে তারা নিজেদের সর্বনাশের সাথে ইবলিশকেও ডুবিয়েছে।
যখন বিচারকার্য সম্পন্ন হবে তখন শয়তান বলবে, আল্লাহ তো তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমার তো তোমাদের ওপর কোনো আধিপত্য ছিল না। আমি কেবল তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং আমার প্রতি দোষারোপ কর না, তোমরা নিজেদের প্রতি দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরিক করেছিলে আমি তা অস্বীকার করছি, জালেমদের জন্য তো মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে। শয়তান হযরত উমর (রা.)-কে ভীষণ ভয় করত এবং তাকে দেখা মাত্র পলায়ন করত। একবার তার ঘুষিতে শয়তানের এক চোখ কানা হয়ে যাওয়ার বর্ণনাও রয়েছে। হযরত উমর (রা)-কে তাহাজ্জুদ নামাজের সময় এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে এবং তাহাজ্জুদের নামাজে কিছুটা বিলম্বিত হওয়ায় তিনি এটাকে শয়তানের কারসাজি মনে করে পরের দিন হতে তাহাজ্জুদের সময় হওয়ার আগেই উঠে যেতে থাকেন। এ অবস্থা দেখে শয়তান সময় হলে নিজেই উমর (রা.)-কে ঘুম থেকে জাগাত এবং বলতÑ উমর, তাহাজ্জুদের সময় হয়েছে, ওঠো। তার বদ নিয়ত ছিল উমর যেন তাহাজ্জুদে অধিক সময় নিয়োজিত রাখার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারেন। শয়তানের সত্য কথা ও কাজেও লুকায়িত থাকে অসৎ উদ্দেশ্য ও ভ-ামি। তার দ্বারা প্রতারিত ও বিভ্রান্ত বিপথগামী হয় অজ্ঞ-অর্ধশিক্ষিত সরলপ্রাণ মানুষ। খাটি লোকেরাও শয়তানের দ্বারা পরিবেষ্টিত। ইবলিশ শয়তান থেকে যেমন সাবধান সতর্ক হওয়া প্রয়োজন তেমন মানব শয়তানকেও সঠিকভাবে চিনতে, জানতে হবে। এরা ইবলিশ শয়তানের চেয়ে অধিক ভয়ঙ্কর। সুতরাং সকল শ্রেণির শয়তান হতে আত্মরক্ষা করার দায়িত্ব সকলের। কারণ শয়তান খোদাদ্রোহী, মানবদ্রোহী, অপশক্তি এবং সমাজদ্রোহী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন