শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বাংলাদেশের নৌপথে জাহাজ চলাচল

প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ এমদাদুল হক বাদশা
বাংলাদেশের নৌপথে জাহাজ চলাচলের আদি ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই ভূখ-ে আজ থেকে প্রায় ১৭৩ বছর পূর্বে ১৮৩৪ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক নামে একটি স্টিমার সর্বপ্রথম গঙ্গা নদীতে চালু হয়েছিল। এর পূর্বে ১৭৬৭ হতে ১৭৭৬ পর্যন্ত মেজর রেনেলের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম এ দেশে নদী জরিপ করা হয়। এতে বিগত দুই শতাব্দীতে নদীর ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী এ সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং গঙ্গা পদ্মা নদী অধিকতর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত হতো এবং এসব নদীর সংযোগস্থল ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি। ১৮৮০ হতে ১৯৫০ সালের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদী আমূল পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নামে প্রবাহিত হয়ে তৎকালীন গোয়ালন্দ ঘাটের কাছে গঙ্গা নদীর সাথে মিলিত হয়। সেখান থেকেই সম্মিলিত ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদী পদ্মা নামে চাঁদপুর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হয়। ১৯৫০ সালে আসামের প্রচ- ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র এবং এর শাখা-উপ-নদীগুলোর নাব্যের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭৫০-১৯১৮) কমান্ডা এডা ইউলিয়াম কর্তৃক প্রকাশিত হয়, যা অনেক তথ্যবহুল। ১৮৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টিমার টাগ অ্যাসোসিয়েশন, মেসার্স উইলিয়াম ক্যার, ট্যাগর অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি এন্টারপ্রাইজ হতে এই কোম্পানিটি বঙ্গ দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। এরপর ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানী লিঃ নামে সর্বপ্রথম একটি স্টিমার কোম্পানী ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৪ সালে চালু হয়। তখন জাহাজ/স্টিমারগুলো স্টিম বা কয়লা থেকে উৎপন্ন বাষ্প দ্বারা চালিত ছিল বিধায় এসব জাহাজ-স্টিমার হিসেবে অধিক পরিচিত ছিল। ১৮৬২ সালে নতুন রিভার্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই কোম্পানিই রিভার্স স্টিমার কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। প্রথম দিকে আইজিএসএন কোং এবং আরএসএন কোং বেশ প্রতিযোগিতা করে চলছিল। কিন্তু ১৮৭৬ সালে রাষ্ট্রীয় রেলওয়ের বিপরীতে তুমুল প্রতিযোগিতা করার জন্য দুটি কোম্পানি একীভূত হয়ে যায়। এই যৌথ প্রচেষ্টার ফলে ১৮৮০ সালে এ দুটো কোম্পানি একটি নিয়মানুগ ট্যারিফ চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রায় ৮ বছর পর্যন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। উনিশ শতকের শেষের দিকে (১৮৮০-১৮৯৯) প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮৯৮টি জাহাজ-স্টিমার কলকাতা হতে সুন্দরবন হয়ে খুলনা পর্যন্ত চলাচল করত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮০৩ টিতে দাঁড়ায়। ১৮৮৯ সালে কলকাতা হতে আসাম পর্যন্ত নৌ-চলাচলের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যাপক ট্যারিফ যুদ্ধের পর লন্ডন চুক্তি হয়ে যায়। ফলে উভয় কোম্পানী মিলে একটি জয়েন্ট স্টিমার কোম্পানি সৃষ্টি করে। ১৮৯৭ সালে জয়েন্ট স্টিমার কোম্পানি কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ কোম্পানিকে একত্রিত করে কলকাতায় প্রধান দফতর স্থাপন করে বঙ্গদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ক্ষেত্রে খুবই প্রভাবশালী কোম্পানিতে পরিণত হয়। ১৮৯৯ হতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর যাবৎ ১৫ মাইল দীর্ঘ মাদারীপুর-গোপালগঞ্জ বিল রুটটি জলিরপাড় হতে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত কায়িক শ্রমে মাটি কেটে প্রথম নাব্য বৃদ্ধি করা হয়। ১৯০০ সালে যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চলের মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর মধ্যে প্রায় ১ মাইল কেটে কৃত্রিমভাবে একটি ক্রস কানেকশন করা হয়। এতে ওই অঞ্চলে নাব্য বৃদ্ধি পায়। জনৈক হালিফেক্সের নাম অনুসারে এর নাম রাখা হয় হালিফেক্স কাট। গড়াই, আতাই ও মধুমতি এই তিনটি নদীর সংযোগস্থল হচ্ছে নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার টোনা-বড়দিয়া যা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ওই অঞ্চলে ঐতিহাসিক নৌপথ সংযোগস্থল হিসেবে অসামান্য অবদান রেখেছে। ১৯১৭ সালে এদেশে সর্বপ্রথম ড্রেজার সংগ্রহ করে মাদারীপুর বিল রুট, লোয়ার কুমার নদী ও গোপালগঞ্জ লুপ কাট করা হয়। দ্বিতীয় ড্রেজার আলেকজান্ডার পরবর্তীতে আনা হয়। ১৯১৮ সালে ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের মাঝে অবস্থিত ১০ মাইল লম্বা গাবখান খাল খনন করে খুলনা ও বরিশালের মধ্যে নৌ পথের দূরত্ব প্রায় ৭০ মাইল হ্রাস করা সম্ভব হয়। ১৯২৮ সালে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট প্রথম পতেঙ্গা নামক একটি ড্রেজার সংগ্রহ করে কর্ণফুলী নদীর গুপ্তখাল এলাকায় ড্রেজিং শুরু করে। ১৯৩৪ সালে বেঙ্গল লেজিসলেচার কর্তৃক অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল বিল পাস হয়। এতে একটি নৌ চলাচল বোর্ড থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে মোট ৮টি প্রাইভেট কোম্পানি অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ব্যবস্থাকে পরিচালনা করত। সেগুলো ছিল: (১) বিআরএস কোম্পানি লিঃ (২) আইজিএনআর কোম্পানি (৩) পাক বে কোম্পানি লিঃ (৪) পাক ফ্লোটিলা লিঃ (৫) চালনা লাইটারেজ লিঃ (৬) সিনক্লেয়ার ম্যুরে লিঃ (৭) ইবি রেলওয়ে ফ্লোটিলা লিঃ এবং (৮) আরএসএন কোং লিঃ। আইজিএনআর এবং আরএসএন নামক দুটি ব্রিটিশ কোম্পানি ছিল, যার রেজিস্টার্ড অফিস ছিল লন্ডনে। এ দুটো কোম্পানি তখনকার প্রায় ৭০% ভাগ মালামাল ও যাত্রী পরিবহন করত। বিআরএস ছিল ভারতীয় কোম্পানি এবং এর প্রধান কার্যালয় ছিল কলকাতায়। ১৯৪৭ সালের পরও জয়েন্ট স্টিমার কোম্পানি ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাদের অফিস সম্প্রসারণ করে ব্যাপক কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ১৯৬১ সালে জয়েন্ট স্টিমার কোম্পানি পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নিজ নামে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তবে পাকিস্তান স্টিমার কোম্পানি জেআরএস কোম্পানির জাহাজ বহর নিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এতে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ও পিআরএসের সঙ্গে রেলওয়ের জাহাজ বহর নিয়ে নৌচলাচল কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে জাহাজগুলো কলকাতা হতে আসামে মেশিনারিজ নিয়ে যেত কিন্তু আসাম হতে ফেরার পথে চিলমারী (কুড়িগ্রাম) এবং সরিষাবাড়ি (জামালপুর) ঘাট হতে পাটবোঝাই করে নিয়ে যেত। ১৯৪৭ সালের পর কলকাতা হতে প্রায়ই খালি স্টিমার-জাহাজগুলো উজানে পাঠিয়ে এসব স্থান হতে পাট বোঝাই করা হতো, যার গন্তব্যস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ। পাকিস্তান সৃষ্টির পরও নৌপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কার্যকরী সংস্থা গঠনের জন্য বহু প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। যেমনÑ (১) ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল সার্ভে মিশন (২) ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের ইনল্যান্ড ওয়াটার স্টাডি গ্রুপ (৩) ১৯৫৩ সালে ইউএন রিপোর্ট বাইজে, জি স্যুরি অন আইডব্লিউটি অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান। (৪) আইডব্লিউটি কনফারেন্স অন ইস্ট পাকিস্তান ১৯৫২ ও ১৯৫৬। (৫) এডহক কমিটি অন আইডব্লিউটি ১৯৫৫-৫৬ সালে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত। (৬) ইউএন রিপোর্ট বাই জে জে, ক্রুগ অন ওয়াটার রিসোর্স অব ইস্ট পাকস্তান ১৯৫৫ ও ১৯৫৬। (৭) ওয়ার্লড ব্যাঙ্ক সার্ভে মিশন ১৯৫৭। (৮) আইসিএ সার্ভে মিশন ১৯৫৭। (৯) পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৫৭। (১০) ১৯৫৮ সালে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত আইডব্লিউটি তদন্ত কমিটি (সোবহান কমিটি)। এসব রিপোর্টের ভিত্তিতে একটি কার্যকরী সংস্থা গঠন করার লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালের ৩১ অক্টোবর এক আদেশবলে ইপিআইডাব্লিউটির সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের পর এদেশের নৌ যোগাযোগ ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন লক্ষণীয়। ক্রমবর্ধমান ট্রাফিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধাদি ১৯৪৭ সালে বছরে ৫ লক্ষ টন হতে ১৯৬৫ সালে ৩৫ লক্ষ টনে বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৪৯ সালে চালনা অ্যাঙ্করেজ নামে সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর চালু হয়। ১৯৪৭ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপথে মাত্র ৫০টি যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করত, যা ১৯৬৫-৬৭ সালে এসে ৬১৩টিতে দাঁড়ায়। ১৯৭২-৭৪ সালে বাগেরহাট জেলার ঘসিয়াখালী হতে রামপাল পর্যন্ত ৩.৫ মাইল শুকনো স্থান ড্রেজিং করে মংলা-ঘসিয়াখালী ক্যানেল সৃষ্টি করার ফলে ঢাকা হতে খুলনার দূরত্ব প্রায় ৮০ কি.মি. কমে যায়। এর আগে ঢাকা-বরিশাল-খুলনা নৌপথটি ছিল সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে কোচা নদীর শরণখোলা হয়ে শিবশা, টাইগার পয়েন্ট, হিরণপয়েন্ট, পশুর নদীর বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ও সময় সাপেক্ষ।
লেখক : নদী গবেষক, সাবেক পরিচালক, বিআইডব্লিউটিএ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন