সুইডেন ঠান্ডার দেশ। জাতি হিসাবেও এ দেশের মানুষ সাধারণত চুপচাপ, কথা কম বলে। অনেকের ধারণা শীতের দেশে বাস তাই এমন। আসলে তা নয়। এরা মজার মানুষ যদি সম্পর্ক সুন্দর করে তৈরি করা যায়। আমার বাসায় পড়ার প্রতিবেশী হঠাৎ চলে না এলেও, কলিং বেল চেপে বা ফোন করে মাঝে মাঝেই চলে আসে। আমিও একই কাজ করি। আবার এমনও দেখা যায়, অনেক প্রতিবেশী শুধু ‘হাই’ এবং ‘বাই’ ছাড়া অতিরিক্ত একটি কথা বলবে না। তবে কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয়। এরা অনেকেই একাকি বসবাস করে। বাকিরা ফামিলি নিয়ে বা শুধু স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসবাস করে। ছেলে-মেয়ে ১৮ বছর হলে সাধারণত বাড়ি ছেড়ে পড়াশুনা বা চাকরির সুবাদে নিজেদের মত একাকি বা লিভ টুগেদার করে থাকে। এদের লাইফ স্টাইলে বেশি লক্ষ্যণীয় যেটা, সেটা হলো এরা নেভার অ্যালোন, অলওয়েজ অ্যালোন। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে কী এরা একা থাকতে চায়, নাকি একা থাকতে হয়? আসুন জেনে নেই এদের জীবন ব্যবস্থার ধরণ সম্পর্কে, তাহলে হয়তবা উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
ট্র্যাডিশন, কালচার, ধর্ম, ক্লাইমেট, ভাষা এসব জন্মগত সূত্রে আমাদের জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশে ঐতিহ্য। ইউরোপে বিষয়টি ভিন্ন। কারণ কর্মের কারণে এরা এক শহর থেকে অন্য শহরে মুভ করে জীবনে কয়েকবার। খুব কম পরিবার রয়েছে যাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষদের একটি স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে। তার আগে বলে নেই আমার জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় আমার বাসস্থান। বাংলাদেশে বিভিন্ন শহরে বসবাস করলেও আমার জন্মস্থান নানাবাড়িতে, গ্রাম, চারিখাদা, জেলা নড়াইল। কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা গ্রাম পোস্ট নহাটা, জেলা মাগুরা। এ ঠিকানা বাংলাদেশী হিসাবে চিরদিনের। সুইডেনে স্থায়ী ঠিকানার বিষয়টি অন্যরকম। যেমন আমার প্রথম ঠিকানা ছিল লিনসোপিং-এ, যেখানে আমি লেখাপড়া করেছি পাঁচ বছর। পরে সেখান থেকে মুভ করেছি স্টকহোমে। লিনসোপিং-এ পড়েছি বিধায় শহরটি মনের মাঝে স্থান পেয়েছে, প্রথম শহর বা ঠিকানার কারণে নয়। আবার স্টকহোম থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে ছয় বছর থেকেছি যে শহরে তার নাম স্ট্রেংন্যাস। এই শহরে বাড়ি কিনেছি, গাছপালা লাগিয়েছি, আমার মেয়ের জন্ম হওয়া সত্তে¡ও এখন স্টকহোমই আমাদের নতুন ঠিকানা। বেশির ভাগ সুইডিশ আমার মতই ঠিকানা পরিবর্তনে অভ্যস্ত। তবে এদের পাসপোর্টে জন্মস্থানের শহরটির কথা উল্লেখ থাকে।
যদিও বাকি জীবনের কোন সময় হয়ত সেই শহরের সাথে কোন সম্পৃক্তই থাকে না। বসতবাড়ির জন্য ভাড়া, কেনা বা সম্পূর্ণ নতুন করে বাড়ি তৈরি করার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। বাংলাদেশের অনেকেই এভাবে বসবাস করছে। বাংলাদেশে সবারই একটি স্থায়ী ঠিকানা থাকে যা সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষদের বাড়িকেই বোঝায়। তবে ইউরোপে যারা যেখানে মুভ করে সেখানেই তাদের নতুন ঠিকানা হয়। সুইডেনে কেউ নতুন বাসাবাড়িতে মুভ করলে নতুন করে সাজিয়ে নেয়। তারা সুন্দর এবং মনের মত করে বাসাবাড়ি ডেকোরেট করতে পছন্দ করে। পছন্দ করা বাড়িতে যতদিন দরকার ততদিন থাকে। বলতে গেলে চলমান ফেরিওয়ালার জীবন।
আমি আমার স্টকহোমের বাসায় ১৫ বছর ধরে বসবাস করছি। বর্তমানে সেখান থেকে মুভ করে অন্য একটি শহরে বসবাস করছি। সুইডিশ লেকের ধারে এক চমৎকার পরিবেশে। ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। তারাও তাদের মত করে নতুন বাসাবাড়ি খুঁজবে বা হয়ত পৃথিবীর অন্য কোথাও মুভ করবে কোন এক সময়। তখন আমাদের জন্য এ বসতবাড়ি সাইজে দুজনের জন্য বড় হবে। সে ক্ষেত্রে খরচ কমাতে হয়ত আমরাও মুভ করব ছোটখাটো বাসাবাড়িতে। এটাই ইউরোপের বসতবাড়ি এবং জীবনযাপন পদ্ধতি।
এখন আমি এবং আমার স্ত্রী খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছি স্পেনে ছোটখাটো একটি কটেজ কেনার জন্য। সাগরের ধারে, পাহাড়ের কোলে থাকবে একটু জায়গা যেখানে শাকসবজি, ফলমূল লাগানোর ব্যবস্থা থাকবে। বাইরে বারবিকিউ গ্রিল করার সঙ্গে সাগরের ভিউ একদিকে, অন্যদিকে পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য মনকে উতালা করে তুলবে। ইচ্ছে হলে সাগরে গিয়ে একটু সাঁতরানোর ব্যবস্থা থাকবে। জীবনের শেষের দিকে এমন পরিকল্পনা থাকতেই পারে। ইউরোপের জীবনের এই চলমান ঠিকানা যা এখনও বাংলাদেশের মানুষের মনের দরজায় আসেনি।
এখানকার, বিশেষ করে সুইডেনের মানুষের মধ্যে আবার প্রায় ৪০% লোক সিঙ্গেল জীবনযাপন করে। এখন ভাবনায় ঢুকেছে চলমান ঠিকানার জীবনপদ্ধতি কি সিঙ্গেল লাইফের জন্য কিছুটা দায়ী? আমার মনে হয়, কিছুটা দায়ী। যেমন পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে যে সময়ের প্রয়োজন অনেক সময় তা সম্ভব হয়ে উঠে না বিধায় অনেকেই সিঙ্গেলই থেকে যায়। ইউরোপের এভারেজ চলমান ঠিকানা ৪-৮ বার হয়ে থাকে। চলমান ঠিকানার কারণে একা একা বসবাস করার প্রবণতা এদের জীবনে একটু বেশি। যার কারণে এরা একা থাকতেও অভ্যস্ত। নতুন মানুষের সঙ্গে ইন্টিমেট সম্পর্ক না হবার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।
তার মধ্যে নতুন পরিবেশ একটি। অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা আরেকটি। তারপর কারো উপর নির্ভরশীল না থাকাও আরেকটি কারণ। দুটি মন এক হলেই দুজন দুজনার হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ কম পক্ষে দশটি প্যারামিটারের সামঞ্জস্যতা থাকতে হবে সিঙ্গেল থেকে টুগেদারনেস হতে হলে। লিভি টুগেদার কনসেপ্টে যে জিনিসগুলোর গুরুত্ব এরা বেশি দিয়ে থাকে তার মধ্যে বিশ্বাস, আন্ডারস্ট্যান্ডিং, টলারেন্স, সিম্প্যাথি, প্যাশন, ভালোবাসা, মিউচুয়াল রেস্পেক্ট, আর্থিক এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা। সবকিছু থাকার পরও সংসারে ভাঙ্গন লাগতে পারে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে। শেষে আবার সেই সিঙ্গেল লাইফে ফিরে যাওয়া স্বাভাবিক হয়ে পড়ে জীবনে।
স্যোসাল মিডিয়া যেমন ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ফেসবুক ডেটিং, সুইপ নাইট সিঙ্গেলদের যোগাযোগের মাধ্যম হলেও নাইট ক্লাব, ডিস্কেটেক, অ্যারেঞ্জ পার্টি বা বন্ধু-বান্ধবীর মাধ্যমে এরা নতুন সাথী খুঁজে পেয়ে থাকে। এভারেজ ৫-৮ বার ডেইটিংয়ের পর, যদি ইন্টিমেট সম্পর্ক হয় তখন বিয়ে-সাদি পরে সন্তানের কারণে এরা একসঙ্গে বসবাস করার জন্য যৌথ বসতবাড়ি খুঁজতে শুরু করে। নতুন করে বসতবাড়ি খোঁজার সময় দেখা যায় ভিন্ন মতামতের উদয় হয়, তখন ক¤েপ্রামাইজে না এলে দেখা গেল সম্পর্ক টিকল না। কারণ এই নতুন বসতবাড়িতে একত্রে বসবাস করতে অনেক সময় পছন্দ-অপছন্দের কারণে নতুন সমস্যা জীবনে আসতে পারে বা এসে থাকে। যেমন কারো পছন্দ এক ডিজাইন, কারো বা অন্য, কারো জন্য রান্না ঘরের গুরুত্ব বেশি, আবার কারো জন্য ভিউ। অথবা কারো জন্য সুইমিং পুল হতে পারে একটি বিষয়।
সুইডেনে বলা হয়ে থাকে, ছোট বাচ্চা ছোট সমস্যা, বড় বাচ্চা বড় সমস্যা। যার বা যাদের জীবনে যত সুযোগ সুবিধা রয়েছে তার বা তাদের আবার অসুবিধাও রয়েছে। তার মানে বিলাসবহুল জীবনেরও উত্থান বা পতন থাকতে পারে। এখানেও অনেকে সুইসাইড করে, অনেকে একা মরে পড়ে থাকে, তারপরও জীবন থেমে নেই। থেমে নেই পরিবর্তনের, থেমে নেই সুখী সংসারের, থেমে নেই ভালোবাসার বন্ধনের।
লেখক: সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন