খুলনায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্রতিদিন তাদের শো ডাউনে আতংকিত সাধারণ মানুষ। স্কুুল-কলেজের মেয়েরা তাদের ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকছে। খুলনায় কিশোর গ্যাংয়ের হত্যা, হামলা, ইভটিজিং, চাঁদাবাজি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। খুলনা মহানগরীতে কমপক্ষে ২০টি কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের সবার বয়স ১৩ থেকে ১৮ এর মধ্যে। এরাই আবার মাদক সেবন ও ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর কাছে খুলনার কিশোর গ্যাংয়ের সুনির্দিষ্ট তালিকা থাকলেও তাদের ধরতে কোনো প্রকার তৎপরতা এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি।
সূত্র জানায়, নগরীর প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় সারাদিন চায়ের দোকানে, ফুটপাথে, খেলার মাঠে কিশোর গ্যাং এর উঠতি বয়সি সদস্যরা জটলা করে। স্কুল-কলেজ শুরু ও ছুটির সময় তারা ছাত্রীদের দেখে অশালীন অঙ্গভঙ্গী ও মন্তব্য ছুড়ে দেয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সিগারেট মুখে দিয়ে দামি দামি বাইকে তারা বসে থাকে। এলাকার মুরুব্বীরা অপমানিত হবার ভয়ে তাদের কিছু বলেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের অধিকাংশ সদস্যই খুবই নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। পরিবারের হাঁড়িতে ঠিক মতো রান্না হলেও ঠিকই তারা দু লাখ আড়াই লাখ টাকা দামের মোটর বাইকে ঘুরে বেড়ায়। তাদের অর্থের উৎস অজানা। অনেকেই বলে থাকেন, সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের কিছু নেতারা কিশোর গ্যাং পুষে থাকেন। মিছিল মিটিংয়ে এই কিশোররাই অংশ নেয়। মাদক ব্যসায়ও তারা জড়িত। তাই তাদের টাকার অভাব নেই।
সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, খুলনার রূপসা এলাকায় কিং অব রূপসা নামে ৪০ জনের একটি গ্যাং রয়েছে। লবনচরা-মাথাভাঙ্গা এলাকায় জিহাদের নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি গ্যাং রয়েছে। মুজগুন্নি এলাকায় আলিফ এর নেতৃত্বে ড্রাগন বয়েজ নামে ২০ সদস্যের একটি গ্যাং রয়েছে। বৈকালী এলাকায় রাকিবের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের ডেনজার বয়েজ, বয়রা পালপাড়া এলাকায় ইনজাম এর নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের টিপসি গ্যাং, খুলনা জিলা স্কুল মোড় এলাকায় তারভিরের নেতৃত্বে এক্স বস গ্রুপ, সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় হুসাইনের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের সাইক্লোন গ্রুপ, টুটপাড়া এলাকায় বাপ্পীর নেতৃত্বে ২০ সদস্যের বাংলা বয়েজ, চয়নের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের বাংলা হরর, শিরোমনি-ফুলবাড়িগেট এলাকায় কাজল ওরফে ফেসবুক কাজলের নেতৃত্বে ডেয়ারিং লাভার্স এবং জোড়াগেট-নিউমার্কেট এলাকায় হায়দার ওরফে জাপানী বস এর নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের ট্রিপল এক্স গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার গোপন ওই প্রতিবেদনে আরো ২০ থেকে ২৫ টি গ্যাং এর কথা বলা হয়েছে। আশংকার বিষয় হচ্ছে, কিশোরদের এসব গ্যাং এর পাশাপাশি অনলাই ভিত্তিক এসকর্ট সার্ভিস বা কিশোর যৌনকর্মী গ্রুপও সক্রিয় রয়েছে। এসকট গ্যাং, হট বয়েজ অব খুলনা, রাফ লাভ প্রভৃতি নামে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ে সদস্যরা যৌন ব্যবসা চালিয়ে আসছে।
প্রায়শ: খুলনায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপকীর্তি ঘটাচ্ছে। এতোটাই বেপরোয়া তারা যে, মানুষ খুনও তাদের কাছে ছেলে খেলা। সর্বশেষ গত ৩১ মার্চ দুপুরে খুলনার ফুলতলায় প্রকাশ্য দিবালোকে কলেজছাত্র সৈয়দ আলিফ রোহানকে কুপিয়ে হত্যা করে হাসনাত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এর আগে গত বছরের শেষে মহানগরীর চাঁনমারী বাজার এলাকায় ফায়েদ নামে এক স্কুল ছাত্রকে খুন করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নগরীর সোনাডাঙ্গায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শহিদুল ইসলাম রাসেল নামে এক যুবক নিহত হয় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। রূপসা বাগমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে গুপ্তির আঘাতে (দুই দিকে ধারালো ছুরি) সারজিল ইসলাম সংগ্রাম নিহত হয়। নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন মজিদ সরণি এলাকায় সুজুকি মোটরসাইকেল শো রুমের সামনে মহিদুল ইসলাম নামে আরেক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর অপরাধীরা। গত দু’বছরে খুলনায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে কমপক্ষে ১০ জন খুন হয়েছে বলে বিভিন্ন থানার রেকর্ড সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে কেএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) ফজলুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে তাদের কোনো তালিকা নেই। সকল থানাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এসকল অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে।
এদিকে, গতকাল রোববার দুপুরে খুলনা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির এপ্রিল মাসের সভায় প্রধান অতিথি খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, সমাজে কিশোর গ্যাং এর অপরাধ বেড়ে গেছে। এর পেছনে মাদকের প্রভাব রয়েছে। মাদক নির্মূলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। স্কুল-কলেজ এলাকার দোকানে সিগারেট বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ প্রশাসনসহ সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন