দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বেপরোয়া হয়ে ওঠার বিষয়টি উদ্বেগজনক। এক সময়ের নগরকেন্দ্রিক এ সমস্যা এখন কম-বেশি সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে যেসব কিশোর বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, সমাজ তাদের নিয়ে কতটা ভাবছে? এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান শুরু হলে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হলেও একসময় এ আলোচনা একেবারেই থেমে যায়।
উদ্বেগজনক তথ্য হলো, কেবল রাজধানীতেই ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৭৮ এবং সদস্য সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। এদের কাছে রয়েছে নানা রকম অস্ত্র। এদের অনেকেই রাজনৈতিক ছায়ায় অবস্থান করে। আবার কেউ কেউ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুচর হিসেবে কাজ করছে। একসময় দেশের উঠতি বয়সের তরুণদের মধ্যে নানারকম সমাজকল্যাণমূলক কাজের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যেত, আর এখন শহর-বন্দরে উঠতি বয়সের তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ একত্র হয়ে গ্যাং তৈরি করে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনায় গ্রুপে গ্রুপে চলছে হাতাহাতি-মারামারি।
কিশোর অপরাধীদের উৎপাত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। এমন বাস্তবতায় মাঠ পর্যায় থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা, সদস্য এবং পৃষ্ঠপোষকদের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকলে কিশোর অপরাধীদের উৎপাত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে, এটা আশা করা যায়।
নিম্নবৃত্ত পরিবারের কিশোর, যারা নানাভাবে বঞ্চিত তাদের অনেকে হতাশা থেকেও নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানা রকম প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে এ শিশু-কিশোরদের সম্পদে পরিণত করার পাশাপাশি তাদের উন্নত মূল্যবোধের দীক্ষা প্রদানে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হলে এই শিশু-কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা সহজ হবে।
বর্তমানে সারাদেশেই কিশোর অপরাধীদের উৎপাত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যারা কিশোর বয়স থেকেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, তারা যে একদিন শীর্ষ সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখাবে না; এর নিশ্চয়তা কী? এ ক্ষত সমাজদেহে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করার আগেই সবার এগিয়ে আসা উচিত। শিশুরা যে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা জীবনের শুরুতেই যদি পায়, তাহলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা যায়।
আজকাল প্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির থাবায় কিশোর-কিশোরীদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। তাদের মধ্যে সংবেদনশীল আচরণ, সহমর্মিতা ও উন্নত মূল্যবোধের দীক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে দেশে আরও ব্যাপক কর্মকাণ্ড চালু করতে হবে। একইসঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত না থাকলে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে, সেজন্য অভিভাবকদেরই বেশি সচেতন হতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানের পাশাপাশি শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাই সোচ্চার না হলে গ্যাং কালচার বন্ধে কাক্সিক্ষত সুফল মিলবে কিনা সন্দেহ, এটা বলাই যায়।
এদিকে, চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নগরে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকায় ২৫২ কিশোরের নাম আছে। এই কিশোরদের ‘বড় ভাই’ হিসেবে ছায়া দিচ্ছেন অন্তত ৪৮ জন রাজনৈতিক নেতা-সন্ত্রাসী, যাঁরা প্রায় সবাই নানাভাবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যা, ছিনতাই, ফুটপাতে হকার বসানো এবং আধিপত্য বিস্তারসহ প্রায় সব ধরনের অভিযোগের সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত দুই ডজন খুনের সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত বলে তথ্য রয়েছে।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে উঠতি বয়সী কিছু কিশোর। দলবদ্ধ এই অপরাধীচক্র ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত। উদ্ভট নাম নিয়ে গড়ে ওঠা এসব দলের অনেক সদস্যই স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হয়নি। পাড়া-মহল্লায় তারা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের ক্রাইম অ্যানালিসিস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।
কিশোরদের এভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার কারণ কী? সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে নানা অসংগতি রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোর বয়সে হিরোইজম ভাব থাকে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘গ্যাং কালচার’ গড়ে উঠছে। কিশোর বয়সে ইতিবাচক চর্চার দিকে না গিয়ে নেতিবাচক চর্চার দিকে চলে যায়। আবার যখন তারা দেখে যে অপরাধ যারা করছে, তারা সমাজে বেশি লাভবান হচ্ছে, সেটা কিশোররা অনুসরণ করে। তাদের ওপর পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিপার্শ্বিক নানা কারণে অনেক আগে থেকেই অপরাধী তালিকায় নাম এসেছে অল্প বয়সীদের। তাঁরা মনে করেন, দুর্বল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার অভাবও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। সন্তানের শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের প্রতি অভিভাবকদের যতটা মনোযোগ দেওয়া দরকার, তা প্রায়ই দেওয়া হয় না। আবার মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজের সামান্য লাভের জন্য কিশোরদের অপরাধজগতে টেনে নেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করেন।
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? কেন সমাজে কিশোর অপরাধ বাড়ছে? কেন কিশোরদের অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে?
সমাজবাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখন এলাকাভিত্তিক সামাজিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না, খেলার মাঠ কমে এসেছে। সামাজিকভাবে বিনোদনমূলক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ কম থাকায় কিশোররা ক্রমেই অপরাধজগতে ঢুকছে। সমাজ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিবার ও সামাজিক পর্যায়ে সঠিক পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ কিশোর অপরাধ কমাতে অনেক সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকেও কঠোর হতে হবে।
যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, মাঠে খেলার কথা, সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিভা বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেই বয়সের কিশোররা এখন ছুরি-চাকু, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাস্তানি করে, মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। রাস্তাঘাটে ছিনতাই করে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। বাধা দিলে রক্তারক্তি, খুুনাখুনি করে। উত্তরা, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরা গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অভিযান চালালেও কিশোর অপরাধ কমছে না, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয় তারা।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দুর্নীতি, অপরাধ ও অপরাধের নানা উপাদান রয়েছে, কিশোররা তার বাইরে নয়। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়ছে। এলাকায় খেলার মাঠ নেই। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাও নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তারকাখ্যাতি, হিরোইজম, ক্ষমতা, বয়সের অপরিপক্বতা, অর্থলোভ। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পারিবারিক শিক্ষার অভাবও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আবার মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত অনেকেই নিজের সামান্য লাভের জন্য কিশোরদের অপরাধজগতে টেনে নেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করেন। কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে।
কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধ করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার ও সমাজের সঠিক পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ কিশোর অপরাধ কমাতে অনেক সাহায্য করবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন