কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরে স্কুল ছাত্র খুনের কূল-কিনারা হওয়ার আগেই খুন হলো কলেজ ছাত্র। গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিন পুলিশের (সিএমপি) দক্ষিণ জোনের কার্যালয়ের কাছে চেরাগি পাহাড় সংলগ্ন রাজাপুর লেইনে এই খুনের ঘটনা ঘটে। দলীয় প্রতিপক্ষের কর্মীদের হাতে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাতে নিহত আসকার বিন তারেক ইভান (১৮) বিএএফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী। পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও এক ছাত্রলীগ নেতার মদদপুষ্ট উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণদের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘাতে এই খুনের ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছে।
এদিকে, পুলিশী অভিযানের মুখে মাহে রমজানের শুরুতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত কিছুটা কমলে হঠাৎ করে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নগরীর প্রতিটি এলাকায় কিশোর ও উঠতি যুবকদের দাপট চলছে। তাদের পাল্টাপাল্টি শোডাউন, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, অস্ত্রের মহড়ায় পাড়া মহল্লা আবাসিক এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। গভীর রাতেও এদের উৎপাত চলছে। কথায় কথায় প্রতিপক্ষের উপর হামলে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে সংঘাতে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ঈদ সামনে রেখে কোন কোন এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও দস্যুতার অভিযোগও উঠেছে। মূলত রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ক্যাডার, মাস্তানদের মদদেই এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে নগরীর চেরাগি পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত দুটি গ্রুপও রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ বলছে, তাদের একপক্ষ জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাস সুমনের অনুসারী এবং অপরপক্ষ নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাব্বির সাদেকের অনুসারী। শৈবাল দাস সুমন ও সাব্বির সাদেক নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলে আসছে তাদের মধ্যে। এর জেরে ওই দিন ইফতারের পর নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। রাত ১০টার দিকে দুই পক্ষ চেরাগী মোড় এলাকায় মুখোমুখি হয়। সেখানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা।
একপর্যায়ে সাব্বির গ্রুপের কর্মীরা ইভানকে ছুরিকাঘাত করে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বিএএফ শাহীন কলেজের এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইভান নগরীর ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক। তার বাড়ি নগরী এনায়েত বাজার এলাকায়। বাবার নাম এস এম তারেক। তিনি একজন ব্যবসায়ী।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর-যুবকদের দুই গ্রুপের বিরোধের জেরে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় শোভন নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ঘটনার পর নগরীর আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। শোভন নগরীর ওমর গণি এমইএস কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। তার হাতে ছুরির আঘাত রয়েছে। এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে জানিয়ে ওসি বলেন, এই ঘটনায় জড়িত বাকিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চেরাগির মোড়ে সংঘাতে জড়িত এসব কিশোর-তরুণেরা নিয়মিত চেরাগি পাহাড়ের বিভিন্নস্থানে এবং কাউন্সিলরের বাসার সামনে আড্ডা দেয়। প্রায়ই তারা ঝগড়া-মারামারিতে লিপ্ত হয়। অধিকাংশই বখাটে প্রকৃতির এসব কিশোর-তরুণের অনেকেই মাদক সেবন করে। স্থানীয়রা বিভিন্নসময় কাউন্সিলরের কাছে এসব বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। বরং কাউন্সিলরের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে দেখা যায় বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। জামালখানের মতো নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় সরকারি দলের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা ও কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ মদদে কিশোর গ্রুপের দৌরাত্ম্য চলছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের ছত্রছায়ায়ও গড়ে উঠেছে অসংখ্য কিশোর গ্যাং। এসব কথিত নেতারা তাদের দলভারি করার আড়ালে কিশোর-তরুণদের বিপথগামী করছে। এদের দিয়ে অপকর্ম করানোর পাশাপাশি নিজেদের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণও করছে।
এর আগে গত ১৮ এপ্রিল নগরীর পাহাড়তলী থানার ঈদজগাঁও কাঁচারাস্তার মাথায় দুই দল কিশোরের মধ্যে ঝগড়ার জেরে ছুরিকাঘাতে একজন খুন হয়েছে। এ ঘটনায় ছুরিকাঘাতকারী কিশোর সজলকে পরে কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, ঈদ বস্ত্রমেলায় সামান্য ধাক্কাধাক্কির জেরে বখাটে ওই কিশোর ছুরি চালিয়ে দেয় দুই কিশোরের শরীরে। এদের মধ্যে ফাহিম (১৬) নামে একজন মারা যায়। গুরুতর আহত হয় আরো একজন। পুলিশ জানায়, হালিশহরের দুলহান কমিউনিটি সেন্টারে ঈদ বস্ত্র মেলায় মেলায় ভিড়ের মধ্যে এক কিশোরের সঙ্গে আরেক কিশোরের ধাক্কা লাগে।
এর জের ধরে তারা সংঘাতে জড়ায়। গ্রেফতার কিশোর সজলের কাছ থেকে হত্যকাণ্ডে ব্যবহৃত একটিসহ মোট দুটি ছোরা জব্দ করে পুলিশ। সে জানিয়েছে দারাজের মাধ্যমে সে দুটি ছোরা কিনে। ঘটনার সময় একটি তার পকেটে ছিল। অন্যটি দিয়ে সে দুইজনকে ছুরিকাঘাত করে। নিহত ফাহিম নগরীর মনসুরাবাদ গণপূর্ত বিদ্যানিকেতনের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। আর ছুরিকাঘাতকারী কিশোর একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া লেখা করেছে। স্থানীয়রা জানায়, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার মদদে সেখানে একধিক কিশোর গ্রুপ গড়ে উঠেছে।
বিগত ২০১৮ সালে নগরীর জামালখান সড়কে প্রকাশ্যে দিবালোকে কলেজিয়েট স্কুল ছাত্র আদনানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় চট্টগ্রামে আলোচনায় আসে কিশোর গ্রুপ। এরপর থেকে পুলিশ নগরীতে কিশোর গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। তবে এরপরও কিশোর গ্রুপের অপতৎপরতা থামছে না। কিশোর ও উঠতি যুবকেরা ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ করে মুুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি, দস্যুতা, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি এমনকি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে তারা। বখাটেদের পাশাপাশি স্কুল কলেজ পড়ুয়া উচ্চবিত্তের সন্তানেরাও এই সব গ্রুপে ভিড়ে যাচ্ছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে রাজনৈতিক বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মদদ থাকায় পুলিশও অনেকটা অসহায়। পুলিশের খাতায় কিশোর গ্যাং লিডারদের অনেকে এখন কাউন্সিলর। তারাই এসব উঠতি তরুণদের আসকারা দিচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন