শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

রোহিঙ্গাদের সাথে বর্বর আচরণ

প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. আবদুল লতিফ নেজামী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সামরিক সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ কেবল উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে। কারেন প্রদেশের হ্যাপ-আ-য়েন জেলা থেকে পালিয়ে যাওয়া মুসলিমরা থাইল্যান্ডস্থ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়গ্রহণ করে। তারা জানায় মিয়ানমার সেনাদের হাতে নির্যাতন, মসজিদ ও মুসলমানদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার কথা। প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমার মুসলমানদের ভ্রমন সংকুচিত করা হয়। অধিকন্তু জানা যায় যে, সামরিক সরকার মিয়ানমারের ছোট ছোট শহরের মসজিদসমূহ ও ধ্বংস করে দেয়। তাছাড়া নতুন মসজিদ নির্মাণ ও পুরনো মসজিদ মেরামত ও নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া একই বছরের অক্টোবরে পাই, পাকুকা, বাগু এবং হ্যানথাদা প্রভৃতি শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এসব দাঙ্গায় কমপেক্ষ একশ’ লোক নিহত এবং ৩ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়। ১৯৪২ সালে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয় এবং ৮০ হাজার রোহিঙ্গা তৎকালীন বৃটিশ ভারত আজকের বাংলাদেশে চলে আসে।
বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গা শরনার্থী : ২০ হাজার রোহিঙ্গা শরনার্থী এখনো বাংলাদেশে রয়েছে। ১৫-২০ হাজার রোহিঙ্গা থাইল্যান্ডের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। মালয়েশিয়ায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা শরনার্থী আছে বলে জানা যায়। তাছাড়া ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং সৌদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশসমূহে বহু রোহিঙ্গা আছে।
তারা সকলেই মুসলমানদের বিরোধী : কারেন, স্যান, ওয়া, মন, বর্মি, রাখাইন, চীনা, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি মিয়ানমারের জনগোষ্ঠি একে অপরের বিরোধী। কিন্তু তারা সবাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
এর সমাধান কি : জাতিগত উত্তেজনা মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব জাতিগত উত্তেজনা নিরসনের ব্যাপারে যারা সহানুভূতিশীল, তারাও মুসলমানদের ব্যাপারে উদাসীন। মিয়ানমারে মুসলিম-অমুসলিম বিরোধ যথাযথভাবে নিরসন করা না হলে ভবিষ্যতে এই বিরোধ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারে ও মিয়ানমারিকরণের অনুশীলন চলছে। অনেকেই হয়তো অবগত আছেন যে, ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারের স্বৈরশাসকরা কয়েক হাজার লোককে হত্যা করে, যা মিয়ানমারের সকল জাতি-গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সামরিক সরকার পরে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুকী এবং অন্য আরও রাজনীতিবিদের গ্রেফতার করে, যা সমগ্র বিশ্বের নিন্দা কুড়ায়। মিয়ানমারের জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং আন্তর্জাতিক চাপে সামরিক সরকার কর্তৃক ১৯৯০ সালে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অং সান সুকীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এন এল ডি) শতকরা ৮০ ভাগ আসন লাভ করে। কিন্তু সামরিক সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন মিয়ানমারে মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনীতি ধ্বংস প্রায় এবং স্বাস্থ্য সেবায় ধস নামে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন মিয়ানমার সামরিক জান্তার বর্বরতার যথাযথ চিত্র তুলে ধরে। বাংলাদেশে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে, যারা মিয়ানমার সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছে। আর যারা এখনো মিয়ানমারে অবস্থান করছে তারাতো অব্যাহতভাবে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে চলেছে।
১৯৯১ সালে সামরিক সরকার মিয়ানমারে অমুসলিম জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। তাছাড়া আরাকানে মুসলমানদের নানাভাবে হয়রানি করতে শুরু করে। এর অংশ হিসেবে মুসলমানদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার, পিটুনি, অত্যাচার, হত্যা, সম্পত্তি লুট, মহিলাদের সম্ভ্রমহানী এবং বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োগ করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং কূটনীতিকদের সংগৃহিত সামরিক সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্যাদি মিয়ানমারের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয়। বিভিন্ন সময় পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে সামরিক সরকারের অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক উধাও, ধর্ষণ, সহায়-সম্পত্তি লুট, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ, অত্যাচার, গ্রেফতার, বিনা বিচারে আটক, জেলে বন্দিদের সাথে অমানবিক আচরণ, জোরপূর্বক গৃহচ্যুত করা, প্রভৃতি সকল প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকা- জাতিগত সংখ্যালঘুদের সাথে করা হয়। সামরিক সরকারের এসব অমানবিক কর্মকা-ের ফলে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে মিয়ানমার শরণার্থীদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
পৃথিবীর তাবৎ মানবতাবাদী মানুষের মাতমের দীর্ঘশ্বাস, আত্মার আহাজারি ও নৈতিক সমর্থনের কেন্দ্রবিন্দু রোহিঙ্গা জনগণ। রোহিঙ্গাদের এই মাতম বিশে^র প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের। সর্বোপরি এ আর্তনাদ ন্যায়ের পথে সমগ্র উম্মাহর আর্তনাদ, মুসলিম মিল্লাত ও বিশে^র শান্তিকামী মানুষের আর্তনাদ। রোহিঙ্গারা ইতিহাসের এক জ্বলন্ত ট্রাজেডি। মানবাধিকার আদায়ের লাগাতার ইতিহাসসমৃদ্ধ এক জাতির নাম রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার ব্যাপারে মুক্ত বিশ্ব ও মানবাধিকারের প্রবক্তাদের নীরবতায় মিয়ানমার আরাকানে বর্বরোচিত অভিযান অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত হচ্ছে। কিছু কিছু দেশ ও এর মিত্ররা বৃটেনের অবৈধ সমর্থনে বেআইনীভাবে দখলিকৃত আরাকানের ওপর মিয়ানমারের আগ্রাসী তৎপরতাকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির লালনভূমি আরাকানে রোহিঙ্গা জনগণ মিয়ানমারের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছে। আরাকানে অব্যাহত হত্যাযজ্ঞ থেকে মুসলিম বিশ্বকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ। আগ্রাসন থেকে কোন মুসলিম দেশই রেহাই পাবে না। সকল ন্যায়-নীতি, জাতিসংঘ সনদ জলাঞ্জলী দিয়ে মিয়ানমার ঘৃণ্য আচরণে লিপ্ত রয়েছে। বাঁচতে হলে ইসলামী উম্মাহকে শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্তব্য : ১৯৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে বিশেষ উদ্বেগজনক রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশপ টুটু মিয়ানমারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। চেক প্রজাতন্ত্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডেকল্যাপ হাভেল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বার্মা পরিস্থিতি সম্পর্কে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও অনুরূপ অবস্থান গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়। কিন্তু দুঃখজনক এই যে, মার্কিন ও বৃটিশ তামাক ও তেল কোম্পানিসমূহ মিয়ানমার সরকারকে সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী ও শান্তিকামী মানুষকে যথাসম্ভব দ্রুত মিয়ানমারের আরাকানী মুসলমানদের সহায়তায় এগিয়ে আসা উচিৎ যাতে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন, জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে আরাকানী মুসলমানরা রেহাই পায় এবং আরাকানী মুসলমানরা সুখে-শান্তিতে নিজ দেশ মিয়ানমারে বসবাস করার সুযোগ পায়। (সমাপ্ত)
লেখক : চেয়ারম্যান, ইসলামী ঐক্যজোট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন