কবে কখন কোথা থেকে বাংলা সনের প্রচলন শুরু হয়েছিল তার কোনো সঠিক ইতিহাস আমাদের জানা নেই। ব্যাপক কোনো গবেষণা বা প্রচেষ্টাও কখনো হয়নি।
মিশরীয় জ্যোতির্বিদরা তারকারাজির গতিবিধি বিশ্লেষণ করে রাশিচক্র নির্ণয়ে সক্ষম হন এবং রাশিগুলোকে মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন এই বারটি নামে অভিহিত করেন। মিশরীয়রাই কৃষির প্রয়োজনে দিন এবং রাত কে হিসেব করে ৩৬৫ দিনে ১ বৎসর হওয়ার পদ্ধতি বের করেন। যা সৌর বর্ষ হিসেবে আজও বিদ্যমান। কালের বিবর্তনে ব্যবলনীয় জ্যোতির্বিদরা বৎসরকে মাস ও সপ্তাহে এবং রাত ও দিনের সময় কে বিভাজন করে নিয়েছিলেন, যা’ পরবর্তীতে ঘন্টা ও মিনিটে বিভাজন হয়ে অধূনা সময় নির্ণয়ে পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মিশরীয় সময় গণনা পদ্ধতির হাত ধরেই পৃথিবীর জ্যোতিবিদ্যা চর্চা চলতে চলতে মিশরীয়, ব্যবলনীয়, গ্রীক, ভারতীয় ও আরবীয় জ্যোতিবিদ্যা বেশ কয়েকটি বর্ষ গণনা পদ্ধতি বের করেন। আর এভাবেই তৈরি হয় সৌর, চন্দ্র ও নক্ষত্র বর্ষ পঞ্জীর।
সমগ্র পৃথিবীর নববর্ষ এবং সনগুলোর যে ইতিবৃত্ত রয়েছে সেগুলো মূলত অঞ্চল ভিত্তিক জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বা শাসকের ক্ষমতায়নের দিন থেকে শুরুর ইতিহাস। অর্থাৎ প্রধান সনগুলো ধর্ম প্রবর্তকের জন্ম, মৃত্যু এবং দেশ ত্যাগের সময় থেকে শুরু। পৃথিবীতে সন গণনার অনেক আগে থেকেই দিন ও মাস গণনা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। যেমন- চন্দ্রমাস, সৌরমাস, নক্ষত্রমাস। এই তিন প্রকার মাস থেকেই তিন প্রকার সনের প্রচলন। ইতিহাসের দৃষ্টিতে এই তিন প্রকার সন প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। তবে নক্ষত্র বর্ষপঞ্জী ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বে সৌর সনই প্রচলিত। সৌর সনকে সবাই বিজ্ঞান সম্মত সন বলে মেনে নিয়েছে।
বাংলা সন প্রবর্তনের ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখতে গেলে হিজরী সনের কিছু কথা এসেই যায়। কারণ ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাশেমের সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারত বর্ষে হিজরী সনের আগমন ঘটলেও ১২০৪/৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের সময় হতে এদেশে হিজরী সন প্রাধান্য লাভ করে। অর্থাৎ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের ৪৯২ বৎসর পর বাংলা হিজরী সন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে মুসলিম বিজয়ের পূর্বেই নবী করিমের (সা.) জীবদ্দশায় ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সাহাবায়ে কেরাম ও আরব বণিক স্ব-উদ্দীপ্ত প্রেরণায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন। সে বিষয়ে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে মুসলিম সমাজে হিজরী সনের প্রচলনও শুরু হয়।
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন। সম্রাট আকবর তার সভা জ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লা সিরাজীাকে খাজনা আদায়, আইন ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে একটি সঠিক ও কাল উপযোগী বর্ষপঞ্জী প্রণয়নের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। আমীর ফতেউল্লা সিরাজী সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের দিনকে স্মারক হিসেবে ধরে নিয়ে হিজরী ৯৯২ সনের ৮ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ১০ মার্চ ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সৌরভিত্তিক যে বর্ষ গণনা পদ্ধতি প্রচলন করেন সেটিই বঙ্গাব্দ নামে আজও বিদ্যমান রয়েছে।
কাজেই হিজরী সনকে বঙ্গাব্দের মা’ আর শকাব্দ কে বঙ্গ সনের অগ্রজ হিসেবে বলা হলে দোষের কিছু আসে না। কারণ আমীর ফতেউল্লা সিরাজী উদ্ভাবিত বঙ্গাব্দ সন প্রণয়নের ফসল ও সৌর পদ্ধতি অবলম্বন করে বৈশাখ কে প্রথম মাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সত্য কিন্তু মূল ভিত্তি ছিল হিজরী সন। কারণ হিজরী ৯৬৩ সনকে বঙ্গাব্দে ৯৬৩ সন ধরেই বর্ষ পরিক্রমা প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে বঙ্গাব্দ হিজরী সনের হাত ধরাধরি করে এদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে এ কারণে যে, ফসল আর ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, অপেক্ষাকৃত নির্ভূল, বিজ্ঞান সম্মত এবং আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খেয়ে চলার সামর্থ্য রাখে। যে কারণে এই সনটি স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় বর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে হিজরী সনের জনপ্রিয়তার এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। পাকিস্তানের নিজস্ব নববর্ষ নেই। কারণ উর্দু ভাষার কোন ক্যালেন্ডার নেই। যেহেতু উর্দু ভাষীরা সবাই মুসলমান তাই তারা আরবি ক্যালেন্ডার কে নিজেদের ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহার করে। আরবিয়দের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পাকিস্তানিরা সকল ধর্মীয় ও জাতীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। আরবিয়রা মহরমের ১ তারিখ হিজরী নববর্ষ পালন করে থাকে।
বর্ষ গণনার যত পদ্ধতি আবিস্কারে মানুষ যতই প্রচেষ্টাই করুক না কেন পরম স্রষ্টা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন “তিনিই মহান সত্ত্বা, যিনি সুর্যকে উজ্জ্বল আলোক ময় আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলোক বিতরণ কারী রূপে তৈরি করেছেন, যেন তোমরা বছরের সংখ্যা ও হিসাব চিনতে পার” (সুরা ইউনুস, আয়াত-৫)।
গ্রামীন মানুষ পহেলা বৈশাখে ঘুম থেকে জাগ্রত হয় যেন একটা পুত:পবিত্র মন মানসিকতা নিয়ে। ঐদিন টাকা পয়সা কাউকে দেয়া বা নেয়া যাবে না। ভাল খেতে ও খাওয়াতে হবে, মেলায় যাওয়াই চাই। কৃষাণ বউয়ের উচ্ছাস, গৃহস্থ বউয়ের প্রতিবেশীকে খাওয়ানোর পরিতৃপ্তি প্রভৃতি বিষয়গুলি আবহমান কাল থেকে আজও উভয় বাংলার ঘরে ঘরে কুলবধুরা আনন্দ উচ্ছাসে পালন করে থাকে, যা বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিতে শহর ও গ্রাম্য জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এ কথা অনস্বীকার্য।
বিশ্বে যত ক্যালেন্ডার আছে সবই ধর্মভিত্তিক একমাত্র বাংলা বর্ষ ছাড়া। খ্রিষ্টাব্দ যীশু খ্রিষ্টের জন্ম থেকে গণনা করা হয়। হিজরী সন হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মদিনা হিজরতের দিন থেকে হিসেব করা হয়। ইরানে নওরোজ পারশীক ধর্মের প্রবর্তিত। একমাত্র বাংলা বর্ষ সৃষ্টি হয় বঙ্গভূমির প্রাকৃতিক মৌসুমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, যে কারণে কোন ধর্মের সাথে বাংলা বর্ষের কোন যোগসূত্র নেই বা ধর্মীয় ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বাংলা বর্ষ প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ ভাবে বাংলার ঋতুর সাথে মিল রেখে এ দেশের কৃষকের উপর নির্ভর করে। শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবরের দরবারের পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ এ কাজ এত সুন্দর ভাবে সমাধা করেন যে গোটা বাঙ্গালী জাতি তাদের কাছে চিরঋনী। বঙ্গাব্দ নিয়ে প্রশ্ন এবং বিতর্ক আছে ঠিকই কিন্তু আজকের “বঙ্গাব্দ” শব্দটি যে সম্রাট আকবরের প্রতিষ্ঠিত নয় একথা অনস্বীকার্য। আকবর প্রবর্তিত সনটি ছিল “এলাহি সন”। সনটি ভারত বর্ষের কোথাও প্রচলিত করতে পারেনি মোগল প্রশাসক। আকবরের মৃত্যুর প্রায় ২০০ বছর পর সম্ভবত বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এই সন চালু করেছিলেন। তখন সনটি লেখা হতো সন বা সাল শব্দে। সাল শব্দটি ফার্সি সন শব্দটি তিব্বতি।
বাংলা বর্ষ গণনায় প্রকৃতির অপরূপ সাজে সাজানো এই রূপসী বাংলার ছয় ঋতুকে বারো মাসে এতসুন্দর ভাবে বিন্যাস করা হয়েছে যে মাসের সাথে ঋতুর বন্ধন এদেশের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাথে অদ্ভূত সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে যা মায়াঘেরা মধুময় সোনার বাংলায় পরিণত হয়েছে।
গ্রামাঞ্চলে শুরু হলেও পহেলা বৈশাখের উৎসবের আড়ম্বর এখন শহর গুলোতেই বেশি। রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সজ্জিত বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় নানা ধরণের অনুষ্ঠান হয়, মেলা বসে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও বসে বৈশাখী মেলা। আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা খুলে বসেন হালখাতা। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উৎসবের রঙ্গিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে, ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের উৎসব চলে। পথ-ঘাট, মাঠ-মঞ্চ-সবকিছু ভরে ওঠে নতুন প্রাণের উচ্ছাসে। এছাড়া গ্রামীণ বাংলায় এক সময় খেলাধুলারও আয়োজন হতো। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, হাডুডু, লাঠিখেলা, নৌকা বাইচ, গরুর দৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, যাত্রা, জারিগান, পাঁচালি, পুঁথি পাঠ, পুতুল নাচ, সার্কাস, ঘুড়ি উড়ানো ইত্যাদি বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল। জীর্ণ-পুরাতন সবকিছু পিছে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ।
দবাংলা বর্ষ মানেই নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সংকল্প। বাংলা নববর্ষ শুধু মাস পঞ্জি বা বর্ষ পঞ্জি নয়, বাংলাদেশী সহ বিশ্বের যেখানে যত বাঙ্গালী আছে সকলের সর্বকালের অক্ষয়, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও ব্যাকুল হৃদয়ের বানী যা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে সর্বদাই মধুর সুরে উচ্চারিত হয়। বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে আমরা বাংলাদেশকে নবীন সাজে সাজানোর শপথ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বো আর এক সংগ্রামে। এ সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন