বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

গভীর সমস্যায় চা শিল্প

প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
ভোরবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে এবং অতিথি আপ্যায়নে যে জিনিসটি সকলের কাছে আপনজনের মত ঠাঁই করে নিয়েছে তাকেই আমরা চা নামে জানি। এ চাকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দারুণ উপভোগ্য করে তোলা হয়েছে। এ অতি পরিচিত পানীয়র পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে প্রতারণা, লাঞ্ছনা ও ন্যায্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চনা।
আজ থেকে দুশ’ বছর পূর্বে ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষে এ চায়ের গোড়াপত্তন করা হয়। আজকালকার মত চা বাগানগুলোতে তখন তেমন হাহাকার পরিলক্ষিত হতো না, প্রতি বছর অনুষ্ঠানাদির প্রাক্কালে বোনাস নিয়ে নেতা-মন্ত্রী ও ইউনিয়ন কর্মীদের মধ্যে দৌড়ঝাঁপও ছিল না। প্রতিটি বিষয় শ্রমিক প্রতিনিধি ও বাবুদের মধ্যে মালিক পক্ষের যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় সমাধান হত। বর্তমানে তার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। দীর্ঘ দিনের প্রতারণা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বেশিরভাগ চা বাগানে কেউ আজ আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না।
বর্তমানে চা বাগানগুলোতে আন্তরিকতা ও ভালবাসার বন্ধন নেই বললেই চলে। খ-িত করে শাসন করো নীতিতে কিছু শ্রেণীবিভাগ পরিলক্ষিত হয়। যেমন সাহেব সম্প্রদায়, বাবু সম্প্রদায় ও শ্রমিক সম্প্রদায়। এ তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তরিকতার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয়। কেউ কারও প্রাধান্য সহ্য করতে পারে না। যার জন্য চা বাগান পরিচালন ব্যবস্থা এক প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। সর্ব্বত্রই বাবু-শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা বেধে থাকতে দেখা যায়।
আজকাল যে সকল কর্তা ব্যক্তির অধীনে বাবু ও শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন তাদের মধ্যে অনেকেই এসেছেন বিহার, উত্তর প্রদেশ, ওড়িষ্যা, রাজস্থান ও গুজরাট থেকে। এ চায়ের সঙ্গে অনেকেরই নতুন পরিচিতি, তথাপি তাদের যোগ্যতা নেতা-মন্ত্রী, সেইল ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, লেবার অফিসার প্রভৃতির মদতপুষ্ট হয়ে। সুতরাং চা সম্পর্কে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও নিরীহ বাবু-শ্রমিকদের তাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করে যেতে হয়। তাতে বাগান ডুবে যাবে কি ভেসে থাকবে তাতে কারও কিছু যায় আসে না। এ সকল কর্তাব্যক্তির চা সম্পর্কে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা বাবু-শ্রমিকের উপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের দক্ষশাসক বলে প্রতিপন্ন করতে চান, নিজেদের আনাড়িপনা ঢাকতে ওরা দক্ষ এবং অভিজ্ঞ বাবু-শ্রমিককে পাত্তা দিতে চান না। তাই নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতাকে কাজে লাগান, যার ফল স্বরূপ অধিকাংশ বাগানই উৎপাদিত ফসলের টার্গেট পূর্ণ করতে পারে না এবং উন্নত মানের চা তৈরিও ব্যাহত হয়।
আজ দেশের অধিকাংশ বাগানই গুণগত মানের চা তৈরি করতে ব্যর্থ, মালিক পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখতে অধিক ফলন দেখিয়ে প-াকিং স্ট্যান্ডার্ড-কে ব্যাহত করেন ও কোয়ালিটি প্রডাক্ট পান না। চা বাগানগুলোতে ক্ষতির খতিয়ান তুলে ধরে বাবু ও শ্রমিকদের নায্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তারা এমনি মনোভাব পোষণ করেন যেন চা বাগানকে বাঁচিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা বাবু ও শ্রমিকদের। তাই অধিকাংশ বাগানে ক্ষতির খতিয়ান তুলে ধরে বাবু ও শ্রমিকদের দৈনিক দশ-বারো ঘণ্টা কাজ করে যেতে চাপ সৃষ্টি করেন। ছুটির দিনেও কাজ করে অনেকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান না। অথচ উপর মহলের কর্মচারীদের বাংলো, নকর-চাকর, গাড়ি দৌড়ানো ও মোটা অঙ্কের বোনাস ইত্যাদি পেতে আপত্তি নেই। আজকাল রাজনৈতিক দলগুলো চা বাগানকে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে মনে করে। তাই সময় সময় ভুয়া প্রতিশ্রুতি ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে শ্রমিক শ্রেণিকে ক্ষেপিয়ে তুলেন, যার কোনও সুষ্ঠু সমাধান কেউ খোঁজে পান না। এ অবস্থাতে অধিকাংশ বাগানই বন্ধ হয়ে যাবার পথে। চা বাগানগুলোর দুরবস্থার প্রভাব শুধু বাবু ও শ্রমিকদের উপরই বর্তায় না। তার আংশিক প্রভাব পড়ে দেশ জুড়ে, এমনকি শহরে ব্যবসায়ী মহলেও টানাপোড়েন চলতে থাকে।
আজকাল চা বাগানের দুরবস্থার জন্য অনেকেই দায়ী করেন চায়ের নিম্নমুখী বাজারদরকে। কিন্তু কথা হচ্ছে, আজ নিলামে চায়ের বাজার দর ৮০/৯০ টাকার উপর পাওয়া যায় না। মূল্য মূল খরচের অনুপাতে অত্যন্ত কম। এখন কথা হচ্ছে এ ‘অকশানে’র চা ই বাজারে খুচরো একশত টাকার উপরে বিক্রি হয়ে থাকে। আজকাল অতি নিম্নমানের চাও বাজারে একশত টাকার নিচে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই জনসাধারণ বুঝতে পারে এ চা চক্রে বড় রকমের কারচুপি বর্তমান। আমাদের সরকারও চা বাগানের এ সমস্যা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে বলে মনে হয় না। নতুবা এ চাকে সুষ্ঠু বাজারজাত করতে পারলে বাগানগুলো বন্ধ হয়ে যেতো না। এমনিতেই দেশে সুষ্ঠু কর্মসংস্থান নেই, তদুপরি যদি চা বাগানগুলো বন্ধ হয়ে লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে যায় তবে নেতা-মন্ত্রীরা কি পারবেন তাদের পুনর্বাসন করতে। তাই সময় থাকতে সবাইকে এক জোটে কাজ করে যেতে হবে। একে অন্যের উপর দোষারোপ করে একটা অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি না করে প্রত্যেকেরই উচিত সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। আজকাল অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের ও দালাল চক্রের হস্তক্ষেপে।
ভাবতে বিস্ময় লাগে, আজকাল চা বাগানের বাবু ও
শ্রমিকরা দীর্ঘ ৪০/৪২ বছর চা বাগানে চাকরি করে অবসর গ্রহণের পর সময় মতো তাদের পিএফও গ্র্যাচুয়িটি পান না। অবসরের পরও সকাল-সন্ধ্যা কর্তৃপক্ষের কাছে করজোড়ে হাত পেতে থাকতে হয়। এমনিতেই বাগান কর্মচারীদের পেনশনের কোনও ব্যবস্থা নেই, তদুপরি যদি প্রাপ্য টাকা সময় মত না পাওয়া যায় তবে অসহায় বাগানকর্মীদের অবস্থা অনুমেয়।
আজকাল চা বাগানগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। একপক্ষে চা-এর নিম্ন দর। তার উপর নানা রকমের টেক্সের বোঝা, রাজনৈতিক দল ও নানা ইউনিয়নের সব পাইয়ে দেবার বাঘা বাঘা প্রতিশ্রুতি চা বাগানের শ্রমিককুলকে এক ধন্ধে ফেলেছে। তাই ওদের স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কাজ করার বাসনা নেই বললেই চলে। যার ফলে বাবু-শ্রমিকদের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়ে থাকে। আজকাল অধিকাংশ বাগানের শ্রমিকরা ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে “আউট ডোর“-এর কাজে যোগ দেন এবং বেলা দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে কর্মস্থল ত্যাগ করেন, যার ফলে অধিকাংশ বাগানের “লেবার আউট পুট” নেই বললেই চলে অথচ কর্তৃপক্ষকে ন্যায্য মজুরি দিতে হয়। তাই ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত শ্রমিকদের বাঘা বাঘা প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া তারা যেন নিষ্ঠা সহকারে ৮ ঘণ্টা কাজ করে চা বাগানগুলোকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। সোনার হংসের ডিম পেতে হলে হাঁসকে যতœ-আত্তি করতে হবে। হাঁসকে মেরে ফেললে সমূহ ক্ষতি। মালিকপক্ষ ও কর্মচারীবৃন্দের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই বাগানগুলো টিকে থাকার প্রধান শর্ত। তাই প্রয়োজন নিষ্ঠা সহকারে কাজ করে যাওয়া, সেই সঙ্গে ত্যাগ করতে হবে ফাঁকি দেবার মনোভাব। তা না হলে ক্ষতি নিজেদেরই। কাজে ফাঁকি দেবার প্রবণতাই আজ চা বাগানগুলোকে দাঁড় করিয়েছে প্রশ্নচিহ্নের মুখে।
আজকাল অবশ্য দক্ষিণাঞ্চলের নদী-ভাঙনের শিকার হয়ে স্থানীয় লোকেরাও চা-বাগানের কাজে জড়িত হতে দেখা যায়। যদিও চা সম্পর্কে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আস্তে আস্তে তারা চা শিল্পকে আয়ত্ত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে তাই জাত শ্রমিক ছাড়াও স্থানীয় এবং বরিশাল অঞ্চলের লোকদের কাজ করতে দেখা যায়।
লেখক-সাংবাদিক ও কলামিষ্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (স্ব^র্ণপদক ১ম) প্রাপ্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন