ঈদকে ঘিরে মহাসড়কে চলছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। বছরের অন্যান্য সময় নিয়মিত চাঁদা আদায় করলেও ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বিদেশে পলাতক আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। চাঁদা দিতে না চাইলে দেয়া হচ্ছে হুমকি-ধমকি। পরিবার-পরিজন ও নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেকেই চাঁদা দিচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, পরিবহন শ্রমিক সংগঠন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুটিকয়েক অসাধু সদস্য পণ্যবাহী যানবাহন থেকে চাঁদা আদায়ে সম্পৃক্ত। কোনো কোনো এলাকায় সক্রিয় ডাকাত ও অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। বিভিন্ন যানবাহনকে টার্গেট করে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এদিকে ঈদযাত্রা নিরাপদ রাখতে মহাসড়কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছে তৎপর। পুলিশ বলছে, সড়ক-মহাসড়কে পরিবহন চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পেশাদার চাঁদাবাজরা বছরজুড়েই চাঁদা তুলে। ট্রাকে চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পণ্য পরিবহনের জন্য প্রায় তিন লাখ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। এসব ট্রাক থেকে মাসে তোলা হয় হাজার কোটি টাকার চাঁদা। সূত্র মতে, শুধু পণ্য পরিবহন সেক্টর নয় যাত্রীবাহী বাস, লেগুনাসহ অন্যান্য পরিবহন থেকেও তোলা হয় চাঁদা।
ঈদে যাত্রীদের চাপ থাকায় পরিবহন সেক্টরে বাড়তি আয় হয়। সেই সুযোগে চাঁদাবাজরাও বাড়তি আদায় করে। বিভিন্ন টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নামেই চলছে অতিমাত্রায় চাঁদাবাজি। রাজধানীর চারটি আন্তঃজেলা ও অভ্যন্তরীণ রুটের টার্মিনালসহ বিভিন্ন পরিবহন কাউন্টারে চাঁদাবাজির যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, মাসে অন্তত প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলা হয় বাসগুলো থেকে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় এসব টার্মিনাল থেকে।
এ হিসাবে সারাদেশে পরিবহন সেক্টরের অবস্থা কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে কয়েকজন গডফাদার পরিবহন মালিক সমিতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে দাবি সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। তাদের ভাষ্য, এই গডফাদাররা গত কয়েক বছরে নিজস্ব পরিবহন সংস্থার ব্যানারে শত শত বাস নামিয়েছেন। বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ পাচার করেছেন মালয়েশিয়া, কানাডা ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে।
অনুসন্ধান বলছে, মালিক সমিতির নামে বাস প্রতি ৩৬০ থেকে ৯৬০ টাকা (বাসের কোম্পানিভেদে), কমন ফান্ড বাবদ ২০০ টাকা ও ঢাকা সড়ক নামে ৮০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তাছাড়া ভাঙচুর ভর্তুকি, অফিস ক্রয়, কমিউনিটি পুলিশ, সিটি টোলের জন্য পৃথকভাবে ২০ টাকা করে মোট ১০০ টাকা এবং সুপারভাইজারের নামে ৬০ টাকা চাঁদা তোলা হয়।
সাধারণ বাস মালিকরা বলছেন, যা আয় হচ্ছে, তার একটি বড় অংশ পথে পথে চাঁদা দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সাম্প্রতিককালে পরিবহন ব্যবসায় ভদ্র, সৎ ব্যবসায়ীদের আর আগমনও ঘটছে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন বলেন, বাস-মিনিবাস, সিএনজি-অটোরিকশা, ট্রাক, হিউম্যান হলারসহ বিভিন্ন শ্রেণি মিলিয়ে দেশজুড়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৫০ বেসিক ইউনিয়ন রয়েছে।
এদিকে শ্রম আইনে উল্লেখ রয়েছে, টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার সময় ৫০ টাকা এবং মালিক সমিতি ৬০ টাকা নেবে। কিন্তু দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে অন্তত ২০ জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। পণ্য পরিবহনেও শ্রমিক ফেডারেশনের ইউনিয়নই চাঁদা আদায় করছে। রাস্তায় বাঁশ ফেলেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফেরিঘাটের নিয়ন্ত্রণ কর্তারাও ট্রাক প্রতি দুই হাজার টাকা চাঁদা নিচ্ছে।
এছাড়া যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চল থেকে মাছ যায় চট্টগ্রামে। নির্ধারিত সময়ে না পৌঁছলে মাছের উপযুক্ত দাম পান না তারা। মাছভর্তি এসব ট্রাক আটকে পাঁচ হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে ১১ লাখ বাণিজ্যিক যানবাহন রয়েছে। ফেডারেশনের হিসাবে, যদি ৫০ টাকা করেও নেয়া হয় তাহলে দিনে উঠে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু এক জায়গায় নয়, কমপক্ষে ১০ জায়গায় দিতে হচ্ছে। সে হিসাবে পাঁচ জায়গায় ধরলেও একেকটি যানবাহন থেকে ২৫০ টাকা করে দিনে সাড়ে ২৭ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল, কাঁচপুর, মদনপুর, ডেমরা, দাউদকান্দি এলাকায় ছোট-বড় সব যাত্রীবাহী পরিবহন থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী থেকে যাত্রীবাহী বাস ঢাকায় প্রবেশে প্রতি ট্রিপে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাসগুলো যেসব জেলার উপর দিয়ে আসে সেসব জেলায় মাসিক ভিত্তিতে পুলিশ সার্জেন্ট, থানা-ফাঁড়িকেও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা নানা সমিতি ও সংগঠনগুলোকেও চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা দিতে না চাইলে গাড়ির কাগজ ঠিক থাকার পরও মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কুমিল্লায় সম্প্রতি এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি অটোরিকশা থেকে ট্রাফিক পুলিশের নামে মাসে ১২০০ টাকা আদায় করা হতো।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দিনে পাঁচ শতাধিক গাড়ি প্রবেশ করে কক্সবাজারে। কক্সবাজার থেকে বের হওয়ার সময় সেসব গাড়িকে ৫০ ও ৬০ টাকা করে দুই দফায় ১১০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চালকদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, বিভিন্ন ফেরিঘাট, ওজন স্টেশন, বাজার কমিটি, পরিবহন সংগঠন ও শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশের নামেও চাঁদা তোলা হয়। এর বাইরের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও জড়িত আছেন।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, চাঁদাবাজি নিয়ে র্যাব খুবই সিরিয়াস। র্যাবের টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ডিএমপি মিডিয়ার ডিসি ফারুক হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে ক্রাইম ডিভিশন ও গোয়েন্দা পুলিশ তৎপর রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন