শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ইসলামই নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আমাদের জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষ পদে থেকে বিগত দুই দশক ধরে নারীরা দেশ পরিচালনা করছেন। এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার সবই নারী। বলা বাহুল্য, নারীকে মন্ত্রী বানালে, কোটা করে নারীকে এমপি বা চেয়ারম্যান বা মেম্বর বানালেই নারী নির্যাতন বন্ধ হয় না, যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো আমাদের দেশ। দেশের বহু নারী মন্ত্রী, এমপি, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও মেম্বর পদে রয়েছেন। তারপরও দেশে নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। অনেক ক্ষেত্রেও নারী নির্যাতনের মূলহোতা নারী। যেমন দেখা যায়, একজন মেয়ের বিয়ের পর সর্বপ্রথম শাশুড়ি, ননদের কাছেই অনেক সময় তারা নিগৃহীত হয়। এছাড়া গৃহকর্ত্রীর দ্বারা কাজের মেয়ে নির্যাতনের কথা সবারই জানা। নারীরা প্রাচীনকাল থেকে নানাভাবে নির্যাতিত ও শোষিত হচ্ছে। অথচ এই নারীর মাধ্যমেই সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখা ও সুন্দর জীবনের সূচনা হয়। প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর পালিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন’ বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। বাংলাদেশের নারীসমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়ে থাকে।
জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্ব অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করলেও এখনো কিছু কিছু নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা মানব সমাজকে পীড়া দেয়। এর একটি হচ্ছে নারী নির্যাতন। আমরা সভ্যতার মুখোশ পরলেও প্রকৃত অর্থে সভ্য নই। যুগে যুগে নারীরা ছিল নির্যাতিত, অধিকারহারা, দাসী, বাঁদি, ভোগ্যপণ্য কিংবা মনোরঞ্জনের সামগ্রী। রোমান সভ্যতায় নারী দাসী, গ্রিকদের কাছে বিকিকিনির পণ্য, খ্রিস্টানরা নারীকে শয়তানের প্রতিভূ মনে করত। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরব দেশে নারীদের সব দুঃখ-কষ্টের কারণ বলে গণ্য করা হতো। আরব দেশে শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো।
আধুনিকতাবাদীরা বলে থাকেন, পাশ্চাত্যের ভগ্নিদের দ্বারা সর্বপ্রথম নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয় যা মোটেই সত্য নয়। প্রকৃত নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রায় ১৫শ’ বছর আগে মহানবী (সা.)-এর যুগে। ইসলামই নারীকে মর্যাদা ও সম্মানের আসনে আসীন করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ ইসলামে পুরুষের মতো নারীরও সম্পত্তির অধিকার রয়েছে। বাবার সম্পত্তিতে, স্বামীর সম্পত্তিতে যে অধিকার দিয়েছে, বর্তমান সমাজে শতকরা ৯৮ ভাগ নারী তা বুঝে পান না। বাবার সম্পত্তির অংশ আনতে গেলে ভাইদের হাতে নাজেহালসহ নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হন।
জাহেলিয়াতের যুগে যখন কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করাই ছিল বাবার জন্য কলঙ্কজনক, কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলেই জীবন্ত কবর দেয়া হতো, তখন ইসলাম তার অধিকার দিয়েছে এবং এই নিষ্ঠুর প্রথার চরম নিন্দা করেছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন তাদেরকে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করার সুসংবাদ দেয়া হত তখন লজ্জায় তাদের চেহারা কালো হয়ে যেত। আর বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। তারা ভাবত লোকলজ্জা উপেক্ষা করে তারা কি তাদেরকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত মন্দ ছিল তাদের এ মনোভাব’ [সূরা নাহল]। মা হিসেবে ইসলাম নারীকে যে মর্যাদা দিয়েছে তা পৃথিবীর কোনো ধর্ম ও সভ্যতায় কল্পনাই করা যায় না। জনৈক সাহাবি রাসূল (সা.) কাছে জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার সদাচার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? রাসূল (সা.) বললেন, তোমার মা। সাহাবি বললেন, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবি বললেন, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবি বললেন, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা’ (বুখারি)।
ইসলামে শালীন পোশাক বা হিজাব নারীর মর্যাদাকে ক্ষুণœ করেনি। এটি পরিধান করে নারীর ব্যক্তিত্বের কোনো ক্ষতি হয় না কিংবা কোনো অসুবিধাও হয় না। বরং এটা মুসলিম নারীর বিশ্বাস ও মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ। মাথার স্কার্ফ, ওড়না বা হিজাব নারীদের জন্য সম্মানের প্রতীক। হিজাব পরিধান করায় নারীর ব্যক্তিত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। নারীদেরকে সমাজে এমনভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে হবে যাতে তাদের সম্মান ও মর্যাদা বজায় থাকে। বর্তমান সময়ে নারী-পুরুষের অবাধ ও বেপর্দা চলাফেরার ফলে নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নারীরা আজ নির্যাতিত। উপযুক্ত পোশাক বা হিজাব পরিধানের মাধ্যমে নারী লোলুপ পুরুষদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
নারীর ব্যাপারে রাসূল (সা.) যে আদর্শ রেখে গেছেন সেই আদর্শই নারীর সম্মান ও মুক্তির উপায়। এছাড়া মানবপ্রসূত যত আইন বা আদর্শ আছে সেগুলোর মাঝে নারীর শান্তি বা মুক্তি নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় মানুষ নারীর শান্তি খুঁজছে মানবপ্রসূত সভ্যতার মধ্যে। যে ইসলামের মধ্যে নারীর শান্তি-স্বস্তি নির্ভর করে, সে ইসলামকেই আজকে চিত্রিত করা হচ্ছে নারী উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে। ইসলামকে আজ নারীর শত্রুরূপে প্রধান আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইসলামের বিধান পালন করলে নারীরা পিছিয়ে যাবে। এ ধরনের মিথ্যাচার ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো বক্তব্য বিভিন্ন দিক থেকে শোনা যাচ্ছে। অপরদিকে যে পাশ্চাত্য সভ্যতার হাতে নারী জাতি বারবার লাঞ্ছিত-অপমাণিত ও নিগৃহীত তারাই উল্টো সেজে বসেছে নারীবাদী ও নারীদরদী।
বর্তমান সমাজে যৌতুক একটি মহামারি অভিশাপ হয়ে আছে। হিন্দু ধর্ম মতে, মেয়েরা বাবার ত্যাজ্য সম্পত্তিতে কোনো ধরনের অংশ পায় না। বিয়ের সময় যা উসুল করে নিতে পারে। এ জন্য কোন হিন্দু পরিবারে সামর্থ্য থাকুক কি-না থাকুক, মেয়েকে পাত্রস্থ করতে গেলে বা ছেলেকে বিবাহ করাতে গেলে যৌতুক দেয়া-নেয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। আজ এ প্রথা আমাদের মুসলিম সমাজেও সংক্রমিত হয়েছে। বিয়েতে মোহরানা হলো স্ত্রীর অধিকার, কিন্তু আমাদের সমাজে অনেকেই তা আদায় করে না। মনে করে মোহরানা না দিলেও চলে। আবার মনে করে তালাক দিলেই মনে হয় মোহরানা দিতে হয়, অন্যথায় নয়। এসব চিন্তা একেবারেই ভুল। বরং মেলামেশার আগেই স্ত্রীকে মোহরানা পরিশোধ করতে হয়। তবে স্ত্রী মোহরানা পরিশোধে অবকাশ দিলে ভিন্ন কথা।
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার প্রেম ও ভালোবাসার স্থান। সেখানে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্বামীর জন্য রাসূল (সা.)-এর জীবনই উত্তম আদর্শ। রাসূল (সা.) দিনভর দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করে ক্ষুধার্থ, ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যখন ঘরে ফিরতেন, জিজ্ঞেস করতেন খাবার তৈরি হয়েছে কিনা? কখনো কখনো স্ত্রীদের কাছ থেকে জবাব আসত, ঘরে তো কোন খাবার নেই অথবা এখনো খাবার তৈরি হয়নি। আল্লাহর রাসূল (সা.) কখনও রাগ করতেন না বরং স্ত্রীদের সঙ্গে ঘরের কাজে শরিক হতেন। তাদের সাথে সদাচার করতেন। স্ত্রীদের সঙ্গে খোশ-গল্প করতেন। তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। তিনি যখন তাহাজ্জুদের সময় উঠতেন তখন খুব আস্তে দরজা খুলতেন, যাতে ঘরের লোকদের ঘুমে ব্যাঘাত না হয়।
ইভটিজিং এখন বহুল প্রচলিত শব্দ। দেশে ২০১১ সালে উত্ত্যক্ত করাকে (ইভটিজিং) বা যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করে আইনের অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আইন ও প্রচারণার পরও নারী নির্যাতন থেমে নেই। অন্যদিকে নির্যাতিতদের খুব কমই আইনের আশ্রয় নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বল ও দরিদ্র নির্যাতিতরা নির্যাতনের ঘটনার বিচার চেয়ে আইনের দ্বারস্থ হয় না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নির্যাতিতদের মাত্র ২ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী নির্যাতনের ৯০-৯৫ ভাগ ঘটনারই কোনো সুষ্ঠু বিচার হয় না। নারী নির্যাতন, ইভটিজিংসহ নানাপ্রকার যৌন হয়রানির মাত্রা আশঙ্কাজনক ও লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। এখন নারীকে মডেল ও ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নারী স্বাধীনতার নামে নারীকে আপনহারা-বাধনহারা করার প্রচেষ্টা চলছে। পুঁজিবাদীরা পণ্য বিক্রি ও ব্যবসায় জৌলস বৃদ্ধির জন্য নারীদের অনুগত পুতুল বানাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনকে ধ্বংস করে দিয়ে তারা নারীদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ক্রেতা আকৃষ্ট করার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলছে। শুধু স্মার্ট ও সুন্দরী নারীদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের আবেদন করা হয়। যেখানে পুঁজিবাদীরা নারীকে একটি উত্তম ভোগ্যপণ্য বা বিজ্ঞাপনসামগ্রী হিসেবে ভাবে, সেখানে ইসলাম তাকে একটি পৃথক সত্তা ও মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন