(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নামাজের দোয়া :
নামাজের বিভিন্ন অবস্থার উপযোগী বিভিন্ন দোয়া পাঠ করা হয় বা পাঠ করা যায়। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) হতেও নামাজের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দোয়া পাঠ করার বর্ণনা পাওয়া যায়। এবং প্রত্যেক মুসলমান এগুলো থেকে যে কোনো একটি পাঠ করতে পারেন। কিন্তু নামাজের মূল দোয়া যার দ্বারা কোরআন শরিফ আরম্ভ করা হয়েছে, তা পাঠ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকিদ করেছেন। যে দোয়াটি তিনি সারাজীবন প্রত্যেক নামাজে পাঠ করেছেন। এই দোয়াটি প্রত্যেক মুসলমান আজো একইভাবে পাঠ করে আসছেন। তা হলো সূরায়ে ফাতিহা। যা নামাজের প্রতিটি অংশের সাথে সম্পৃক্ত ও পরিবেষ্টিত। এ কারণে ইসলাম এই দোয়াটিকে নামাজের মূল দোয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই দোয়াটি আল্লাহর ভাষায় প্রত্যেক বান্দাহ নিজ মুখে উচ্চারিত করে। ইরশাদ হচ্ছে, “সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই প্রাপ্য; যিনি দয়াময়, পরম দয়ালু; কর্মফল দিবসের মালিক; আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি; আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর, তাদের পথ যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ, যারা ক্রোধে নিপতিত নয়, পথভ্রষ্টও নয়।” (সূরা ফাতেহা) এই দোয়া শেষ করে আমীন বলে। অর্থাৎ হে আল্লাহ ! তুমি তা কবুল কর। তা এমন একটি দোয়া, যা প্রত্যেক মুসলমান সকল নামাজেই বার বার পাঠ করে। যা ব্যতীত নামাজ অসম্পূর্ণ ও দুর্বল থেকে যায়। (জামে তিরমিজী : কিরাআতে ফাতেহা) এই দোয়াটি ইসলামের সামগ্রিক শিক্ষার নির্যাস ও সারমর্মস্বরূপ। এর মাঝে আল্লাহর হামদ ও সানা, তাওহীদ, কর্মফলের শাস্তি ও পুরস্কার লাভের বিশ্বাস, একান্তভাবে ইবাদত আদায়ের স্বীকৃতি তাওফিক ও হেদায়েতের প্রত্যাশা, উত্তম লোকদের অনুসরণ করার একাগ্রতা এবং মন্দ লোকদের সংস্পর্শ হতে বেঁচে থাকার আখাক্সক্ষা বিধৃত আছে।
এই দোয়া পাঠের প্রাক্কালে বান্দাহ যখন স্বীয় জবানে, “সকল বিশ্বের প্রতিপালক” কথাটি উচ্চারণ করে তখন আল্লাহর যাবতীয় কুদরত ও নেয়ামত যা জমিন ও আসমানসমূহে বিস্তৃত আছে, তা চোখের সামনে হাজির হয় সৃষ্টিকূলের বিশেষত্ব অবলোকন করে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশালত্বের কল্পনা জেগে উঠে, একই প্রতিপালক কর্তৃক বিশ্বভুবন প্রতিপালনের ধারণা বদ্ধমূল হয়, একই সাথে মানুষ হোক চাই পশু, ভূচর হোক চাই খেচর, আমীর হোক চাই গরিব, মাখদুম হোক চাই খাদেম, বাদশাহ হোক চাই ভিখারী, কালো হোক চাই ধলো, আরব হোক চাই আজম, সারা মাখলুকাতকে সৃষ্টিসুলভ ভ্রাতৃত্বের নিরিখে একই বলে মনে হয়। আর আল্লাহকে ‘রহমান ও রহীম’ বলে ডাকার মাঝে তাঁর সীমাহীন রহমত ও সীমাহীন মায়া ও ¯েœহ, অগণিত বখশিশ এবং অসংখ্য প্রকার মহব্বতের সমুদ্রে বান ডেকে যায়, হিন্দোল দোলায়। তাছাড়া ‘বিচার দিবসের মালিক’-এর খেয়াল আমাদেরকে নিজ নিজ কাজকর্মের জিম্মাদারি এবং প্রতিফল সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এমনকি আল্লাহর শান্তি ও অভিসম্পাৎ হতে বেঁচে থাকার ভয় উৎপাদন করে। আর ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি’ বলে আমরা স্বীয় অন্তর হতে যাবতীয় শিরক ও অংশীবাদের গোড়া-শিকড় উৎপাটন করি। আর ‘আমরা তোমারই কাছে প্রার্থনা করি’ বলে আমরা দুনিয়ার যাবতীয় উপকরণ ও অবলম্বনগুলোকে নিরর্থক বিবেচনা করি এবং শুধুমাত্র আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি। এমনকি সবকিছু হতে বিমুক্ত হয়ে আমরা একই আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করি। পরিশেষে আমরা আল্লাহর কাছে সোজা পথে চলার তাওফিক চাই। এই সোজা পথ (সিরাতে মোস্তাকীম) কি? শরিয়তের আহকামই হচ্ছে সোজা পথ। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “বলুন এস, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন তোমাদেরকে তা পড়ে শোনাই। তা এই : তোমরা তাঁর কোনো শরিক করবে না, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্র্যের জন্য তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না, আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবকা দিয়ে থাকি। প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন হোক অশ্লীল আচরণের নিকটেও যেও না, আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না, তোমাদেরকে তিনি এই নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা অনুধাবন কর। এতিম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্য ছাড়া তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না এবং পরিমাণ ও ওজন ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দেবে, আমি কাকেও তার সাধ্যাতীত ভার অর্পণ করি না , যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ন্যায্য বলবে, স্বজনের সম্পর্কে হলেও এবং আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকারপূর্ণ করবে, এভাবেই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর এবং এই পথই আমার সরল পথ, সুতরাং এরই অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা সাবধান হও।” (সূরা আনয়াম : রুকু-১৯)
এই আয়াতসমূহের দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ‘অহীয়ে মোহাম্মদী’-এর ব্যবহারিক অর্থে সোজা পথ কি? অর্থাৎ শিরেক না করা, মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করা, সন্তান-সন্ততির সাথে ¯েœহ-বাৎসল্য প্রদর্শন করা, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যাবতীয় কাজ পরিহার করা, মাসুম ও নিরপরাধ লোকদেরকে সম্মান করা, নাহক হত্যা কাজ বর্জন করা, এতিমদের সাথে সদয় ব্যবহার করা, ওজন ও মাপে ঈমানদারী বজায় রাখা, সকল অবস্থায় সত্য কথা বলা, অঙ্গীকার পুরা করা ইত্যাদি এমন সব উৎকৃষ্ট গুণাবলী যাকে সংক্ষিপ্তভাবে সিরাতে মোস্তাকীম বলা যায় এবং যার ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রতিনিয়তই আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি। বস্তুত এগুলোই হচ্ছে সচ্চরিত্রতার অমূল্য সম্পদ এবং প্রত্যেক পুণ্য কর্মের প্রাণশক্তি। এই সকল উত্তম গুণাবলীর সাথে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহগণ সম্পৃক্ত ছিলেন। যার দরুন তাদের প্রতি বর্ষিত হয়েছে আল্লাহর অজ¯্র ফজল ও পুরস্কার। এখন কথা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর খাস বান্দাহ কারা? আল-কোরআনে এ প্রশ্নের সুষ্ঠু মীমাংসাও করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করলে, সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎ কর্মপরায়ণ যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী।” (সূরা নিসা : রুকু-৯)
এই নিরিখে প্রত্যেক নামাজি যে সোজা পথ এবং সরল রাস্তার জন্য দোয়া করে, তা হচ্ছে পুণ্যময় সেই বৃহৎ রাস্তা, যার ওপর আল্লাহপাকের প্রিয় সকল নেক বান্দাহ, আম্বিয়া, সিদ্দিকীন, শোহাদা এবং সালেহীন সঙ্গতি ও সামর্থ্য অনুসারে পদচারণা করেছেন।
মূলত সত্য পথ হতে বিচ্যুত হওয়ার দুটি তরিকা রয়েছে। (১) এফরাত অর্থাৎ অতিরঞ্জিত ও সীমাতিক্রমের দ্বারা এবং (২) তাফরীত অর্থাৎ কম করা বা সীমা হতে বহু পেছনে পড়ে থাকার দ্বারা। অতিরঞ্জন হচ্ছে এই যে, আল্লাহর দেয়া শরিয়তে আমাদের নিজেদের দিক হতে কোনো কিছু নতুন আরোপ করা। এটা হচ্ছে গোমরাহী। আর কম করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশাবলী কাজে পরিণত না করা, এগুলো ছেড়ে দেয়া। এর দরুন প্রতিটি জনপদে আজাব এবং গজব নেমে আসে এবং এরই ফলশ্রুতিতে যাবতীয় এনাম ও পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়া হয়। প্রথম তরিকার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে নাসারাগণ। যারা ধর্মের মাঝে নিজেদের তরফ হতে অসংখ্য কথা সংযোজন করেছে। আর দ্বিতীয় তরিকার নমুনা হচ্ছে ইহুদিরা। যারা আল্লাহর নির্দেশাবলীকে পেছনের দিকে ছুড়ে মেরেছে এবং সকল প্রকার দান ও অনুকম্পা হতে বঞ্চিত হয়েছে। সুতরাং মুসলমানদের দোয়া হচ্ছে এই যে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই উভয় প্রকার ভুল পথ হতে বাঁচিয়ে রাখুন এবং শান্তিময় মধ্যবর্তী পথে কায়েম রাখুন।
এই আলোচনার দ্বারা প্রতিপন্ন হলো যে, ইসলামের এই দোয়া (সূলারে ফাতেহা) দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দোয়ার সমষ্টি, দেহ ও মনের পুণ্য কর্মকা-ের প্রতীক এবং ঈমান ও আখলাক সংক্রান্ত শিক্ষা এর দ্বারা পরিব্যাপ্ত রয়েছে। এর মাঝে আল্লাহর হামদ আছে, বান্দাহর দোয়া ও মোনাজাত আছে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের লক্ষ্য করে বলেছেন, “যে নামাজে এই সূরা পাঠ করা হয় না, সে নামাজ অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত থেকে যায়।” আল্লাহপাক বলেছেন, “নামাজকে আমার এবং বান্দাহদের মাঝে দুটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। অর্ধেক আমার জন্য এবং বাকি অর্ধেক বান্দাহর জন্য। বান্দাহ যখন ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ বলে তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দাহ আমার প্রশংসা করেছে। তারপর যখন সে ‘আর রাহমানীর রাহীম’ বলে, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দাহ আমার প্রশংসা করছে। তারপর বান্দাহ যখন ‘মালিকি ইয়াউমিদ্দীন’ বলে, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দাহ আমার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করছে। আর এতটুকুই আমার অংশ। এবং আমার এবং আমার বান্দাহর মাঝে সম্পৃক্ত হচ্ছে, ‘ইয়্যাকানাবুদু, ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ এবং এরপর শেষ পর্যন্ত সবটুকুই হচ্ছে আমার বান্দাহর দোয়া। এ পর্যায়ে আমার বান্দাহ যা চেয়েছে, তা-ই তাকে দেয়া হয়েছে।” (জামে তিরমিজী : তফসীরে ফাতেহা; মোসনাদে ইবনে হাম্বল : ২ খ: ৪৬০ পৃ:) এই হাদিসে কুদসীর আয়নাতে ইসলামী নামাজের দোয়াসমূহ, যা প্রাণস্পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী বলে পরিদৃষ্ট হয়, এর দ্বারা অন্তরে দারুণ আকাক্সক্ষা এবং মনের বনে শান্তিময় আনন্দের উদ্রেক হয়। প্রকৃতপক্ষে ইহা এমন একটি অবস্থা যার পরিতৃপ্তির আকাক্সক্ষা একজন খ্রিস্টান বিদ্বজন এ. জি. উইন ছিঙ্ককেও আন্দোলিত করে তুলেছিল। যিনি ‘ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলাম’ গ্রন্থে ইসলামী নামাজ সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। যা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন (ইসলামের দৃষ্টিতে)Ñ নামাজ ‘হুজুরে কলবের’ সাথে আদায় হওয়া চাই। একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি রঙিন নকশাযুক্ত কাপড়কে এ জন্য খুলে দিয়েছিলেন যে, এর দ্বারা নামাজের মনোনিবেশে ব্যত্যয় সৃষ্টি হয়। বস্তুত নামাজ শুধু বাহ্যিক পদ্ধতিতে ও রীতি আদায় করার নামই নয়, বরং এর মাঝে আত্মিক বিনয় থাকাও দরকার। এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, যেখানে মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আমার কাছে তোমাদের দুনিয়ার দুটি জিনিস পছন্দনীয়। একটি হচ্ছে খোশবু এবং নারী। এবং আমার চোখের শান্তি হচ্ছে নামাজ। কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাঝে নামাজ আদায়ের সময় ভীষণভাবে কান্নার বান ডাকত। নামাজের দুটি বিশেষত্ব হচ্ছে এই যা আমরা দুটি হাদিসের আলোকে উপলব্ধি করতে পারি। এতে বলা হয়েছে যে, নামাজ হলো আল্লাহর সাথে সংগোপনে পরামর্শ করা ও কথা বলা এবং এরই বিশ্লেষণ আমরা এই হাদিসে কুদসিতে পাই : ‘সূরায়ে ফাতেহা আমার মাঝে এবং আমার বান্দাহর মাঝে বিভক্ত হয়ে আছে।’
দোয়ায়ে মোহাম্মদী (সা.)
ও
অন্যান্য আম্বিয়াদের দোয়ার তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য :
দুনিয়ার বুকে এমন কোনো পয়গাম্বর আসেননি, যাকে নামাজের হুকুম দেয়া হয়নি। এমনকি নামাজ আদায়ের জন্য তাদেরকে দোয়া-কালামও শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তুর পর্বতে আল্লাহর জ্যোতি বিকাশের সময় হযরত মুসা (আ.) নামাজের হালতে যে দোয়া পাঠ করেছিলেন তা বর্তমান প্রচলিত তৌরাতের নির্গমন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত আছে। তাছাড়া যাবুর কিতাব আগাগোড়া দোয়ারই সমাহার। কিন্তু এর নির্দিষ্ট দোয়ার ওপর এই শিরোনাম দেখতে পাওয়া যায় ‘দাউদের নামাজ’। ইঞ্জিলে আছে, হযরত ঈসা (আ.)-এর রাতের অধিবেশনে হাওয়ারীদের একটি নির্দিষ্ট দোয়া তালীম দিতেন। যা আজও খ্রিস্টানদের নামাজের মূল অংশ রূপে বিবেচিত। এ সকল দোয়াকে সামনে রেখে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাক জবানে অহীর মূর্ত প্রকাশ সমৃদ্ধ দোয়াসমূহের আকর্ষণীয় অবস্থা সুন্দর বাচন-বিন্যাস, পরিপূর্ণতা, স্বচ্ছতা ও সংক্ষিপ্ততাকে জরিপ করলে দেখা যাবে, এগুলোর সাথে অন্যান্য আম্বিয়াদের দোয়ার কোনো তুলনাই চলে না। এ কারণেই নামাজসমূহে এগুলো পাঠ করার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। আর এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে সাহাবি হযরত উবাই (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমরা নামাজে যে সূরা পাঠ কর, অর্থাৎ সূরা ফাতিহা বা উম্মুল কোরআন শপথ ওই পবিত্র সত্তার, যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত আছে, এই সূরাটি না তৌরাতে অবতীর্ণ হয়েছে, না ইঞ্জিলে এবং না যাবুরে। এমনকি এর সমতুল্য অন্য কোনো সূরা কুরআনুল কারীমেও নেই।’ (জামে তিরমিজী : ফাযায়েলে সূরা ফাতেহা। এই হাদিসের যথার্থতা ও সত্যতার একিন খোদ এ সকল দোয়াসমূহের প্রতি নজর করলেই অনুধাবন করা যাবে।
হযরত মূসা (আ.)-এর নামাজের দোয়া : তৌরাতের নির্গমন অধ্যায়ে আছে যে, হযরত মূসা (আ.) তৌরাত গ্রন্থ গ্রহণ করার জন্য এবং ঐশী তাজাল্লীর একটি ঝলক দেখার জন্য পর্বতে আরোহণ করলেন। তাজাল্লী দর্শন করেই তৎক্ষণাৎ আল্লাহর নাম স্মরণ করে সেজদায় পতিত হলেন। তখন আল্লাহপাক তাকে এই দোয়া শিক্ষা দিলেন, হে আল্লাহ! হে আল্লাহ! রাহীম, রহমান। বিপদের আশ্রয়স্থল, ¯েœহ ও করুণা বর্ষণকারী মহামহীম! হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য অনুকম্পা বর্ষণকারী; অপরাধ, ত্রুটি ও বিচ্যুতি ক্ষমাকারী, কিন্তু তিনি সর্বাবস্থায় ক্ষমা করবেন না! বরং পিতৃ পুরুষের অপরাধের বদলা সন্তান-সন্তুতি হতে এবং সন্তান-সন্ততির গোনাহের বদলা তাদের সন্তান-সন্ততি হতে, চতুর্থ পোশত পর্যন্ত গ্রহণ করবেন। (৪৪-৬) এই দোয়াটির প্রাথমিক বাক্যাবলী যদিও প্রাণস্পর্শী কিন্তু সমাপ্তি ঘটেছে খুবই নিরাশার মাঝে। প্রথম দিকে দান ও অনুকম্পার প্রত্যাশী করে শেষ পর্যন্ত দোয়া কবুলের পথকে তালাবদ্ধ করা হয়েছে। হযরত দাউদ (আ.)-এর নামাজের দোয়া : যাবুর কিতাবে ৯৬ অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে, ‘দাউদ (আ.)-এর নামাজ’। এতে বলা হয়েছে, ‘হে আল্লাহ! আমার প্রতি শ্রবণেন্দ্রিয় অবনত করুন, আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন আমি পেরেশান ও ¤্রয়িমাণ, আমার জানের হেফাজত করুন, আমি প্রকৃতই অনুগত, দীনদার, হে আমার আল্লাহ! স্বীয় বান্দাহর ওপর রহম করুন, যে তোমার ওপর ভরশা করে আছে। হে আল্লাহ। আমার প্রতি রহম করুন, আমি সারা দিন তোমারই সামনে রোনাজারী করছি। স্বীয় বান্দাহর প্রত্যাশা পূরণ করুন। হে আল্লাহ! আমি স্বীয় অন্তরকে তোমারই দিকে নিবেদিত রেখেছি, কেননা হে আল্লাহ! তুমি বড় উত্তম ও মহৎ এবং ক্ষমাশীল। এবং তোমার রহমত তাদের প্রতি অবারিত, যারা তোমাকে ডাকে।
হে আল্লাহ! আমার প্রার্থনা কবুল করুন। আমার মোনাজাতের শব্দের প্রতি কান দিন। আমি নিষ্কৃতির দিন অবশ্যই তোমাকে ডাকব। কেননা তুমি আমার প্রার্থনা শ্রবণ করবে। তোমার মতো কোনোই উপাস্য নাই এবং তোমার গুণাবলী কোথাও নাই। হে আল্লাহ! তোমারই সৃষ্ট আমার বংশের লোকেরা তোমারই সকাশে আগমন করবে, সেজদায় নিপতিত হবে, তোমার নামের মহিমা প্রচার করবে, তুমিই মহীয়ান, তুমিই অতি প্রাকৃতিক কর্মকা-ের নির্বাহকারী, তুমিই একমাত্র প্রভু।
হে আল্লাহ! আমাকে তোমার পথ দেখাও, আমি তোমার সত্য পথেই চলব, আমার অন্তরকে একাকীত্ব করে দাও, আমি তোমারই নাম স্মরণ করে ভীত হব। হে আল্লাহ! স্বীয় অন্তর দিয়ে তোমারই প্রশংসা করব। এবং শেষ পর্যন্ত তোমার নামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করব। তোমার রহমত আমার ওপর অজ¯্র ধারায় বর্ষিত হচ্ছে। তুমিই আমার প্রাণকে নি¤œতম পর্যায় হতে রক্ষা করেছ।
হে আল্লাহ! অহঙ্কারীরা আমার ওপর চড়াও হয়েছে। একটি বৃহৎ জনদল আমার বিরুদ্ধে লেগে আছে। তারা আমাকে তাদের নজরে রাখে নাই। কিন্তু হে আল্লাহ! রাহীম ও কারীম, ক্ষমাশীল ও দয়াবান। তোমার দয়া ও করুণাই আমাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। তুমি আমার প্রতি শুভদৃষ্টি নিক্ষেপ কর। আমার ওপর রহম কর, স্বীয় বান্দাহকে শক্তিদান কর, স্বীয় দাসীর পুত্রকে করুণা ভিক্ষা দাও, নিষ্কৃতি দান কর, আমাকে উত্তম পথের দিশা দান কর, যেন আমার বিরুদ্ধবাদীরা তা প্রত্যক্ষ করতে পারে এবং লজ্জাভিভূত হয়ে পড়ে। কেননা হে আল্লাহ! তুমিই আমাকে শান্তি দিয়েছ, সাহায্য করেছ।
এই দোয়ার মাঝেও আল্লাহর হামদ ও সিফাত, তাওহীদ ও ইবাদতের উল্লেখ আছে। সত্য পথের প্রত্যাশা, হেদায়েতের আকাক্সক্ষা এবং দুষ্টমতি ও গোমরাহদের থেকে পরিত্রাণ লাভের দরখাস্ত পেশ করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘভাবে বারবার ব্যক্তিত্ব বিকাশের রং প্রতিফলিত হওয়াতে এটি সর্বজনীন দোয়ার আওতাভুক্ত হতে পারে না। এমনকি এই দীর্ঘ দোয়া নামাজে পাঠ করার সুপারিশও এর মাঝে ব্যক্ত হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন