মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বন্যার্তদের পাশে নেই বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী

কোথায় যাচ্ছে সিএসআর

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

মানুষ মানুষের জন্য প্রচলিত এই কথাকে মূলমন্ত্র মেনে সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সময়ে-অসময়ে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাড়িয়ে দেয়া সহায়তার হাতের ওপর ভর করে নিঃস্ব মানুষও উঠে দাঁড়িয়েছে। সাজিয়েছে আগামীর স্বপ্ন। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া সেসব মানুষ ও সংগঠনগুলোই বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে হয়ে ওঠে মানবতার প্রতীক, সাহসের উৎস। যা এই মুহূর্তে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য ভীষণ জরুরি। এর মধ্যেই বানভাসি মানুষের পাশে সরকারের পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে পানিবন্দি অসহায় মানুষ বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষদের জন্য ৩০ লাখ টাকার অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন অভিনেতা, প্রযোজক অনন্ত জলিল। এমনকি পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারের জন্য রেস্কিউ টিম গঠনেরও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ঢাকাই সিনেমার শীর্ষ নায়ক শাকিব খান নিউইয়র্কে বসেই বানভাসি মানুষের জন্য গঠন করেছেন তহবিল। নিজেই বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। ঢাকাই সিনেমার অরেক নায়ক বাপ্পী চৌধুরীও এরই মধ্যে বন্যার্ত মানুষকে সহায়তা দিয়েছেন। একটি তহবিল গঠনের মাধ্যমে আরও বড় পরিসরে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বন্যার্তদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সমাজকর্ম অ্যালামনাই, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বপ্নোত্থান, শাবি প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠন।

নৌকা নেই, বিদ্যুৎ নেই, নেই খাবার। এমন পরিস্থিতিতেও গলাপানি অতিক্রম করে সেখানে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। পানি পেরিয়ে বানভাসি মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানোই যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গলাপানি অতিক্রম করে খাবার হাতে বানভাসি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যাচ্ছেন ব্র্যাক, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, সাজিদা ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি দেশের অসংখ্য মানুষও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে অনুদান দিয়ে। অথচ সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ হিসেবে করপোরেট হাউসগুলো এই সময়ে অসহায় এসব মানুষদের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো। অধিকাংশই শিল্প গ্রুপ হাত গুটিয়ে বসে আছে। যারাও কিছু ভূমিকা রাখছে তা খুবই যৎসামান্য। অথচ প্রতিবছর এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর’র ব্যয় দেখিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ লুটপাট করছে। যদিও ব্র্যাক, নগদসহ গুটিকয়েক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্যার্তদের সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষদের জন্য যা খুবই সামান্য। তাই বিশেষজ্ঞরা দেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাধ্যমতো বন্যাকবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

তথ্যমতে, বাংলাদেশে কয়েকশ’ বড় শিল্পগ্রুপ আছে। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেÑ চট্টগ্রামভিত্তিক এ কে খান গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, বেক্সিমকো, ইউনাইটেড গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, প্রাণ, পারটেক্স গ্রুপ, নোমান গ্রুপ, বিএসআরএম, কেডিএস গ্রুপ, হা-মীম, এসিআই লিমিটেড, ট্রান্সকম, ভিয়েলাটেক্স, প্যাসিফিক জিনস, কনফিডেন্স গ্রুপ ও ওয়ালটন। পাশাপাশি রয়েছেÑ দেশের ব্যাংকিং খাত, বড় বড় আবাসন প্রতিষ্ঠান, রড-সিমেন্ট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি। এসব কোম্পানি বা গ্রুপ দেশের মানুষের থেকে ব্যবসা করে আজ বড় বড় শিল্পগ্রুপে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর সিএসআর’র নামে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ দেখাচ্ছে। অথচ দেশের বর্তমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে এসব গ্রুপের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

সূত্রমতে, বন্যার পানিতে দিশেহারা সুনামগঞ্জ ও সিলেটের মানুষ। কয়েকদিন থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন এখানকার মানুষ। বন্যার ভয়াবহতা বাড়তে থাকায় সারাদেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে জেলা দুটি। হাসপাতালগুলোতে পানি ঢুকে যাওয়ায় জরুরি চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছে না। পানিবন্দি এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট। তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই এখন বন্যাকবলিত মানুষের জন্য বড় চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন লাখো মানুষ। বিপদ আরও বাড়াচ্ছে টানা বৃষ্টি। গতকাল রোববারও অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত ছিল। প্রায় সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। পানিবন্দি মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। স্থানীয় হাটবাজার তলিয়ে যাওয়ায় শুকনো খাবার কিনে এনে খাওয়ার সুযোগও নেই। কেউ ব্যক্তিগতভাবে, কেউ বা সংগঠনের মাধ্যমে আবার কোন প্রতিষ্ঠান যেভাবে পারছে, পানিবন্দি মানুষদের সহযোগিতা করছে। কিন্তু এ সাহায্য খুবই সামান্য।

যদিও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘নগদ’-এর কর্মীদের একদিনের বেতন সহায়তায় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক। পাশাপাশি চলতি মাসে নিজের বেতনের সম্পূর্ণ অংশ দুর্যোগ মোকাবিলায় অনুদান হিসেবে দিবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। মানবিক বিপর্যয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বন্যাদুর্গত গ্রাহকদের যোগাযোগের জরুরি প্রয়োজনে ১০ মিনিট ফ্রি টকটাইম দিয়েছে টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানটি। মানবিক এই উদ্যোগে অংশ নিতে সহজে অনুদান পাঠানোর জন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিকাশ পৃথক অ্যাপ তৈরি করেছে। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেছেন, ব্র্যাক প্রাথমিকভাবে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৩ কোটি টাকা সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সহায়তার পরিমাণ আরো বাড়ানো হবে।

এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় ঋণ বিতরণ বাড়ানোর পাশাপাশি বন্যার্তদের জন্য সিএসআর (ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা) খাত থেকে ব্যয়ের পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ব্যাংকগুলোও এখনো সিএসআর থেকে বন্যাদুর্গতদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়াতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এর আগেও করোনা মহামারির দুর্যোগের সময়ে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, এনআরবিসি, সিটিসহ গুটিকয়েক ব্যাংক ছাড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর খুব একটা নজির পাওয়া যায়নি। করোনার শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সিএসআর থেকে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের নির্দেশনা দিলেও অধিকাংশ সিএসআর ব্যয় হচ্ছে পরিচালকদের নির্দেশনায় এবং নিজ নিজ স্বার্থে।

দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (পিআর) মো. হুমায়ুন কবির ইনকিলাবকে বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় ওয়ালটনের কয়েকশ’ শো-রুম পানিতে ডুবে গেছে। অমরাও ভালো নেই, বিপদে অছি। মহামারি করোনার সময়ে ওয়ালটন সর্বাত্মকভাবে দেশের মানুষের পাশে ছিল। বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখনও অলোচনা পর্যায়ে অছে। অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে বন্যাদুর্গতরা, আশা করছি, অন্যান্য দুর্যোগের মতোই কোনো না কোনোভাবে পাশে থাকবে ওয়ালটন।
দেশের আরেক বড় শিল্প পরিবার প্রাণ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা ইনকিলাবকে বলেন, জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিমাণে পানি, জুস, চা এবং মুড়ি বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষদের জন্য পাঠিয়েছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সমাজকর্ম অ্যালামনাই’র সভাপতি প্রফেসর আলী ওয়াক্কাস সোহেল ইনকিলাবকে বলেন, বন্যাদুর্গতরা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট, তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই এখানকার মানুষের বড় চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুঃসময়ে দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠী থেকে শুরু করে সবাইকে বন্যাদুর্গতদের পাশে হাত বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Salauddin Sheikh ২১ জুন, ২০২২, ১০:২২ এএম says : 0
ছুটে এসো একসাথে মানবতার সেবায় বিপদে একদিন তোমারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন