শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পদ্মাসেতু

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

আজ দেশের বহুল কাক্সিক্ষত এবং স্বপ্নের পদ্মাসেতুর উদ্বোধন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতু উদ্বোধন করবেন। জাঁকজমকপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে সেতুটি উদ্বোধনের সকল প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সেতুটির নাম রাখা হয়েছে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ৫৯.৪ ফুট। দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক ১৪ কিলোমিটার। এর পিলার সংখ্যা ৪২টি, স্প্যান ৪১টি। অবস্থান তিনটি জেলা মুন্সিগঞ্জ (মাওয়া), শরীয়তপুর (জাজিরা) ও মাদারীপুর ((শিবচর) সংযোগস্থলে। এর ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রা রিখটার স্কেলে ৯। এ সেতুতে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াও থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যুক্ত করার সুবিধা। বিশ্বের বৃহত্তম সড়কসেতুর তালিকায় এর অবস্থান ২৫তম এবং এশিয়ায় দ্বিতীয়। এ সেতুর প্রকল্প ব্যয় ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অর্থ বিভাগের সাথে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, অর্থবিভাগ ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ১ শতাংশ সুদে ৩৫ বছরের মধ্যে এ অর্থ সেতু বিভাগকে পরিশোধ করতে হবে। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। পদ্মাসেতু বাংলাদেশের সক্ষমতার মাইলফলক। এই সেতু চালুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ ও দ্রুত হবে। নদীর ওপারে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ ঘটবে। জিডিপিতে যুক্ত হবে ১.২৩ শতাংশ। বাড়বে ২৯ শতাংশ নির্মাণ কাজ, ৯.৫ শতাংশ কৃষি প্রবৃদ্ধি, ৮ শতাংশ উৎপাদন ও পরিবহণ খাতের কাজ। ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এই সেতুর বহুমুখী অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বৃদ্ধি তো বটেই, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে যে সেতু আজ বাস্তব রূপ নিয়েছে, তার প্রধান রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সেতু নির্মাণের শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যায়। পরবর্তীতে এ অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হয়। অনেক বিশিষ্টজনই বলেছিলেন, এ সেতু করা সম্ভব নয়। তাদের এ আশঙ্কাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। সিদ্ধান্ত নেন, নিজস্ব অর্থায়নেই সেতু নির্মাণ করবেন। তাঁর অসীম দৃঢ়তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থিরচিত্তের কারণেই এ সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। এ সেতুর সাথে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর আবেগ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ়তা। আজ তিনি সেই স্বপ্নেরই বাস্তব রূপ নিজে উন্মোচন করবেন। পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ ও জটিল। বিশেষ করে পদ্মা এমন একটি নদী যা অত্যন্ত খরস্রোতা ও অস্থিতিশীল। অ্যামাজন নদীর পরই এর অবস্থান। এমন বিরূপ একটি নদী শাসন করে সেতু তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ ছিল। দুই পাড়ে ১২ কিলোমিটার নদী শাসন করতে হয়েছে। প্রথম দিকে নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। কোনো কোনো পিলার বসাতে নদীর তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় যাকে বলে ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’, এ পদ্ধতিতে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার বসাতে হয়। এ পদ্ধতি ব্যবহারের উদাহরণ বিশ্বে বিরল। এমন আরও বিস্ময়কর এবং জটিল প্রক্রিয়া পদ্মাসেতুর সাথে জড়িয়ে রয়েছে। একদিনের জন্যও এ সেতুর নির্মাণ কাজ থেমে থাকেনি। ভরা বর্ষায় পদ্মার ভয়ংকর রূপ এবং করোনা ভাইরাস, কোনো কিছুই নির্মাণ কাজ থামাতে পারেনি। এ সেতুর অবদান এবং উপকারিতা বহুমুখী। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রাজধানী ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনেকটা দূরদিগন্তের, এ সেতু তাতে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুল থাকায় এ অঞ্চল শিল্পায়নের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। পদ্মাসেতুর কারণে এ অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মংলা ও পায়রা বন্দরের কার্যক্রম গতিশীল হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কৃষকরা দ্রুত রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কৃষিপণ্য সরবরাহ করতে পারবে। পর্যটন খাতে পদ্মার আশপাশের এলাকাসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চল অমিত সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। গড়ে উঠবে বিভিন্ন রিসোর্ট, হোটেল, মোটেলসহ পর্যটনের আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্পট। দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলার মানুষ রাজধানীতে দিনে এসে দিনে ফিরে যেতে পারবে। পদ্মাসেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন খাতের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে।

পদ্মাসেতু শুধু একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন নয়, এটি দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। আমরা যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি, এর সার্থক রূপ দিতে এ সেতু যেমন স্মারক হয়ে উঠেছে, তেমনি অর্থনীতিকে বেগবান করতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে দেশের অর্থনীতি গতিশীল রাখবে। এ সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে এবং যানজটমুক্ত রাখতে যথাযথ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মূল সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাই নয়, সংযোগ সড়কসহ আশপাশের জেলার সড়ক পথ মসৃণ রাখতে হবে। যদিও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রাইভেট কার ও অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যা কম, এ কারণে শুরুর দিকে যানজট খুব একটা পরিলক্ষিত হবে না। তবে অর্থনীতির গতি ও মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সে সময় যানজট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে এখন থেকেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা পদ্মাসেতুর মতো একটি অর্থনৈতিক করিডোর এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে নেয়ার রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠচিত্তে অভিনন্দন জানাই। শত প্রতিকূলতা ও বাধা-বিঘ্নের মধ্যে তাঁর উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ়তা না থাকলে এ সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন