জন্মের পূর্বে হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানি (রহ.)-এর পিতা এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেন। দেখেন, সারা দুনিয়া গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। শূকর, বানর এবং ভল্লূুক মানুষদের হত্যা করে চলেছে। হঠাৎ তার বক্ষ হতে এক টুকরা নূর-জ্যোতি বের হয়েছে এবং তাতে একটি সিংহাসন প্রকাশ পেয়েছে। এ সিংহাসনে এক ব্যক্তি বালিশ পেতে বসে আছেন। তার সম্মুখে অত্যাচারী, নাস্তিক ও খোদাদ্রোহীদের ভেড়া-ছাগলের ন্যায় জবাই করা হচ্ছে এবং কোনো ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে বলছে : ‘জাআল হাক্কু অজাহাকাল বাতিলু ইন্নাল বাতিলা কানা জাহুকা’। অর্থাৎ সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে এবং বাতিল (অসত্য) অপসারিত হয়েছে। নিশ্চয়ই অসত্য অপসারিত হওয়ারই বস্তু।
ভোরে তিনি এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা হযরত শাহ কামাল কেথলীর নিকট জানতে চান। শাহ কামাল (রহ.) ছিলেন কাদেরিয়া সিলসিলার পীর এবং বিখ্যাত কামেল সাধক বুজুর্গ। খোদ হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানি (রহ.) তার সম্পর্কে বলেছেন যে, কাদেরিয়া সিলসিলায় হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর পর শাহ কামাল কেথলি (রহ.)-এর দৃষ্টান্ত খুব কমই দেখা যায়। হযরত মাখদুম শায়খ আবদুল আহাদ (রহ.)-এর জবানি তার স্বপ্নটি শ্রবণ করার পর শাহ কামাল (রহ.) বলেন, আপনার একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করবে। তার দ্বারা নাস্তিক ও কুসংস্কারের (বেদাত) অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। বাস্তবে তাই হয়েছিল এবং কীভাবে হয়েছিল তার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
হযরত শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দী (রহ.)-এর বহু উপাধি প্রচলিত। তবে প্রসিদ্ধ দুটি হলো ইমামে রাব্বানী ও মোজাদ্দেদে আলফেসানি। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা.)-এর বয়স অনুযায়ী ৬৩ বছর বয়সে হিজরি ১০৩৪ সালের ২৮ সফর ওফাতপ্রাপ্ত হন। জীবনের শেষ ভাগে শাবান মাসের মাঝামাঝি রাতে নিয়ম মোতাবেক এবাদত বন্দেগীর জন্য তার নির্জন ঘরে চলে যান। সকালে যখন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন বিবি সাহেবা বলেন, জানি না আজ (শবেবরাতে) কার কার নাম দুনিয়ার দফতর হতে কর্তন করা হলো। কথাটি শুনে ইমাম সাহেব বললেন, তুমি তো সন্দেহবশত কথাটি বলেছ। কী অবস্থা হবে সেই ব্যক্তির, যে খোদ আপন চোখে দেখেছে যে, তার নাম দুনিয়ার দফতর হতে মুছে ফেলা হয়েছে।
অতঃপর তিনি ইরশাদ ও হেদায়েতের সকল দায়িত্ব সাহেবজাদাগণের ওপর অর্পন করেন এবং নিজের সমস্ত সময় কোরআন মজীদ তেলাওয়াত, জিকির আজকার ও তরীকত সাধনায় ব্যয় করতে থাকেন। নামাজ ব্যতীত তিনি গোশানশিনী (নির্জন) হতে বের হতেন না। এ সময় তিনি নফল রোজা এবং দান সদকার মাত্রাও বহু বাড়িয়ে দেন।
জিলহজ মাসের মধ্য ভাগে হযরত ইমামে রাব্বানী (রহ.)-এর মধ্যে হাঁপানি রোগ দেখা দেয়। কাঁপানো তীব্র জ্বর শুরু হয়ে যায় এবং ক্রমে তা বাড়তে থাকে। এ সময় একদিন তিনি বললেন, ‘আমি পীরানে পীরকে দেখেছি, তিনি আমার প্রতি খুবই অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন।’ ১২ মহররম তারিখে বললেন, ‘আর চল্লিশ পঞ্চাশ দিনের মধ্যে আমাকে এ ক্ষণস্থায়ী জগৎ হতে সফর করতে হবে’। শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটে এবং হিজরি ১০৩৪ সালের ২৮ সফর ৬৩ বছর বয়সে তার ওফাত হয়, যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
যে রাতের সকালে তিনি ইন্তেকাল করেন সেই রাতে তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য স্বস্তির সাথে অজু করে নামাজ পড়েন এবং খাদেমদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা সবাই সেবাশুশ্রƒষায় খুব কষ্ট করেছ, আজ এ কষ্টের সমাপ্তি ঘটেছে। শেষ সময়ে আল্লাহর জিকিরের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। জিকিররত অবস্থায় তার পবিত্র আত্মা ‘রফি’কে আলা মহান বন্ধুর সান্নিধ্যে চলে যায় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
হযরতের দ্বিতীয় সাহেবজাদা হযরত মোহাম্মদ সাঈদ (রহ.) জানাজার নামাজ পড়ান এবং জ্যেষ্ঠ সাহেব জাদাহ হযরত খাজা মোহাম্মদ সাদেক (রহ.)-এর কবরের সামনে বিশিষ্ট শহর সিরহিন্দে দাফন করা হয়। এই স্থান সম্পর্কে খোদ ইমাম রাব্বানী তার এক মকতুবে লিখেছেন :
‘আমার অন্তরের আলোকমালা সেখানে জগমগ করে।’
হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানি (রহ.) হিজরী ৯৭১ সালে যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন সম্রাট জালালউদ্দীন আকবরের সিংহাসন আরোহণের অষ্টম বছর ছিল। তিনি আকবরী যুগ পেয়েছেন প্রায় চল্লিশ বছর। হযরত মোজাদ্দেদের জীবনের এ গোটা সময় অতিবাহিত হয় জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানলাভে এবং বাতেনী কামালাত লাভে। যৌবনে তিনি আগ্রায় ও গমন করেছিলেন, সেখানে আকবরী দরবারে দুই বিখ্যাত আলেম, নবরতেœর সেরা দুই প-িত আবুল ফজল ও ফয়জী ভ্রাতৃদ্বয়ের সাথে অনেকবার সাক্ষাৎ হয়। তার অসাধারণ প্রতিভা-যোগ্যতা দেখে আবুল ফজল ও ফয়জী খুবই মুগ্ধ হন। খ্যাত আছে যে, সাওরাতিউল এলহাম (নোকতাবিহীন তফসীর) নামক বিখ্যাত তফসীর রচনার কাজে ফয়জী তখন ব্যস্ত ছিলেন। এ কাজে হযরত মোজাদ্দেদ সাহেবেরও ভূমিকা ছিল। একদিনের ঘটনা, ফয়জী যে শৈল্পিক কৌশলে তফসীর রচনা করছিলেন, সে অনুযায়ী তিনি অগ্রসর হতে পারছিলেন না। বিষয়টি তিনি ইমামে রাব্বানীর কাছে উল্লেখ করেন। বলা হয়, তিনি কলম হাতে নিয়ে একবারেই পূর্ণ বিষয়টি ফয়জীর রীতি অনুযায়ীই নোকতাহীনভাবে লিখেদেন। ফয়জী তার এ অসাধারণ প্রতিভা দেখে খুবই বিস্মিত হন।
এ সময়কার আরো একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এই যে, ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। শরিয়তের প্রমাণ ছাড়াই সম্রাট আকবর ঈদ করার ঘোষণা প্রদান করেন। তার ঘোষণার ফলে লোকেরা রোজা ভঙ্গ করে। ওই দিন মোজাদ্দেদ সাহেব আবুল ফজলের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। জিজ্ঞাসা করায় আবুল ফজল জানতে পারেন যে, ইমাম সাহেব রোজা রেখেছেন। কারণ জানতে চাওয়ায় ইমাম বলেন, চাঁদ দেখা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত শরয়ী শাহাদাত (সাক্ষ্য) পাওয়া যায়নি। আবুল ফজল বলেন, বাদশাহ তো নির্দেশ জারি করেছেন, এখন আপত্তি কিসের? তৎক্ষণাৎ তার মুখ দিয়ে এই বাক্য উচ্চারিত হয়- ‘বাদশাহ বেদীনাস্ত, এতেবারে নিস্ত।’ বাদশাহ বেদীন, বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বক্তব্যটি শ্রবণ করে আবুল ফজল চুপ হয়ে যান। এর পরেও পানির পাত্র উঠিয়ে ইমামের মুখে ধরেন, কিন্তু তিনি হাত দিয়ে পানির গ্লাস ঠেলে দেন, ক্ষুব্ধ হয়ে গৃহে ফিরে যান এবং বলে পাঠান যে, জ্ঞানী লোকদের সাথে মেলামেশার আগ্রহ থাকলে তাদের সাথে মেলামেশার রীতিনীতি শেখা উচিত। আবুল ফজল ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অতঃপর পুনরায় আসা-যাওয়া শুরু হয়। এরপর ইমাম সাহেব তার পিতার ডাকে সিরহিন্দে প্রত্যাবর্তন করেন এবং জীবনের বাকি সময় সে কসবায় অতিবাহিত করেন। হজের উদ্দেশ্যে একবার দিল্লিতে আগমন করেন। এখানে হযরত বাকীবিল্লাহ (রহ.) কোনো গায়েবি ইঙ্গিতে এশিয়া মাইনর থেকে দিল্লি পৌঁছে কারো অপেক্ষায় ছিলেন। উভয়ের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে। অতঃপর কী ঘটে তা আল্লাহই জানেন। তিনি সিরহিন্দে চলে যান এবং মোর্শেদের তত্ত্বাবধানে থাকেন।
আবুল ফজল ও ফয়জীর সং¯্রবে থাকার ফলে ইমামে রাব্বানী (রহ.) যথেষ্ট উপকৃত হন। তাদের কাছ থেকে তিনি ‘ফেতনা’র কারণসমূহ এবং সেগুলোর প্রভাব প্রতিক্রিয়াগুলো অনুধাবন করার উত্তম সুযোগ পান, যেগুলো বাদশাহ এবং তার সরকারকে যে সীমা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল এবং সম্ভবত সেখানেই তিনি ওসব অস্ত্রের সন্ধান লাভ করেন, যেগুলোর সাহায্যে এসব লোক তাদের উদ্দেশ্য সাধনে সফলকাম হচ্ছিল। ক্রমে তিনিও সব অস্ত্রে নিজেকেও সজ্জিত করেন।
সংক্ষেপে বলা যায়, আকবরের যুগটা ছিল হযরত মোজাদ্দেদের প্রস্তুতির যুগ। এর পর আকবর ইন্তেকাল করেন এবং জাহাঙ্গীর সিংহাসন লাভ করেন। তখন মোজাদ্দেদ সাহেব ময়দানে অবতীর্ণ হন। সার কথা এই যে, ‘মকতুবাত’ শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের সিংহাসন লাভের সঙ্গে সঙ্গে মোজাদ্দেদ সাহেব তার কাজ আরম্ভ করেন। প্রায় একই সময় তার বয়স চল্লিশ বছর পূরণ হয়েছিল। আর এটা অসম্ভব ছিল না যে, তিনিও যদি দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে সরকারের কোনো উচ্চ পদ গ্রহণ করতেন এবং যে ধরনের উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধা তার জন্য বর্তমান ছিল, কিন্তু বাহ্যত তিনি নিজেকে সা¤্রাজ্য থেকে একেবারেই আলাদা রাখেন। তার মকতুবাত হতে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের দরবারের এমন কোনো বিশিষ্ট সদস্য নেই যার নামে তিনি কোনো পত্র লেখেননি। খানে আজম, খানে জাহান, খানে খানান, মির্জা, কেলিজ খান, খাজা জাহান এবং নবাব সৈয়দ ফরিদ প্রমুখের নামে বহু পত্র লেখেন তিনি। এসব পত্রের মূল উদ্দেশ্য কেবলমাত্র এটাই ছিল যে, আকবরী যুগে ইসলামের যে বিরাট ক্ষতি করা হয়েছে তার বিলুপ্তি সাধন করতে হবে।
জাহাঙ্গিরী যুগের শুরু থেকে আকবরী যুগের সকল প্রকারের অনাচার-কুসংস্কারের উৎপাটনের প্রথম অস্ত্র হিসেবে দরবারী ওমারা ও বিশিষ্টজনদের নামে পত্র প্রেরণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। আর এটাই ছিল শাহী দরবারের বহু খোশামোদী ও শাসকবর্গ এবং একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী ও ক্ষমতালোভী মুফতি উলামার মাথায় বজ্রপাতের মতো। ইসলামবিদ্বেষীরাও তাদের সাথে হাত মিলিয়ে মোজাদ্দেদবিরোধী হয়ে হয়ে ওঠে এবং তার বিরুদ্ধে অপবাদ ও মিথ্যাচার প্রচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফতোয়াবাজরা ছিল এসব অপপ্রচারে অগ্রভাগে। কেউ ফতোয়াফদের কোয়রের, কেউ ফাসেক বলে আখ্যায়িত করে, আরো কত কিছু। তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার প্রচারের পাশাপাশি বাদশাহর কান ভারি করার তৎপরতাও ছিল জোরেশোরে। একশ্রেণির আলেমের পক্ষ হতে জাহাঙ্গীরের কানে মোজাদ্দেদ সাহেবের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি বাদশাহকে ইহুদিদের বাদশাহ মনে করেন। এভাবে সাধারণ মানুষের মনকেও তার সম্পর্কে বিষিয়ে তোলার অপচেষ্টার এক বিশাল জাল বিস্তার করা হয়, যাতে তার বিরুদ্ধে বাদশাহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। তাদের এ অস্ত্র ব্যবহার বৃথা যায়নি এবং যাতে তাদের আনন্দ-উল্লাসেরও সুযোগ হয়ে যায়। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন