শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই

সম্পাদকীয়-১ | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

যতই দিন যাচ্ছে ততই রোহিঙ্গা সমস্যা জটিল হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সমাধানের কোনো পথ দৃশ্যমান নয়। এখন আর মহল বিশেষ নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নির্বিশেষে সবাই বলছেন যে, মিয়ানমার মানে হলো রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য একটি মৃত্যুপুরী। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, যে সাধারণত রক্ষণশীল পত্রিকা হিসেবে পরিচিত, সেই পত্রিকা পর্যন্ত বলেছে যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্মী সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মিয়ানমারের হতভাগ্য রোহিঙ্গা মুসলমানরা আজ নিজ ঘরে পরবাসী। স্মরণাতীত কাল থেকে বার্মার আরাকান প্রদেশে দুই নৃতাত্ত্বিক জাতি বাস করে আসছে। একটি হলো রাখাইন, অপরটি হলো রোহিঙ্গা। রাখাইনরা ধর্ম বিশ্বাসে বৌদ্ধ, প্রকারান্তরে রোহিঙ্গারা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। কালের আবর্তনে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। আরাকান প্রদেশের নাম হয়েছে রাখাইন এবং বার্মার নাম হয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর রাখাইন বৌদ্ধদের পাশবিক জুলুম এতোটুকু বন্ধ হয়নি। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে তাদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি থেকে উৎখাতের অভিযান শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এই উৎখাতকে একটি আইনগত ভিত্তি দেয়ার জন্য বার্মার জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বাধীন মিলিটারি সরকার সব রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব বাতিল করে। জন্ম-জন্মান্তর থেকে যারা আরাকান তথা রাখাইনের নাগরিক এবং সেই সুবাদে মিয়ানমারের নাগরিক, তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা কোনো আইন সমর্থন করে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও জেনারেল নে উইনের এই যুক্তিহীন হঠকারী কাজকে সমর্থন করেনি। কিন্তু যুক্তি ও ন্যায়নীতির ধার না ধেরে বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায় রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন চালিয়ে যেতে থাকে।
১৯৯১ সালে সবচেয়ে বীভৎস জুলুম ও হত্যাকা- সংঘটিত হয়। বর্মী সামরিক বাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধের সম্মিলিত হামলায় আহত ও নিহত হওয়া ছাড়াও লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান তাদের অভিন্ন প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। শতাব্দীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকারও মানবিক বিবেচনায় এসব বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দান করে। সেই থেকে কক্সবাজারে বান্দরবানসহ পার্বত্য জেলাগুলোয় এবং চট্টগ্রামে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে। আজও এসব ছিন্নমূল শরণার্থী তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটামাটিতে ফিরে যেতে পারেনি। বর্মী সেনাবাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধের হামলা আজও অব্যাহত আছে। সেই হামলার ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে সংঘটিত হয় আরেকটি ভয়াবহ হামলা। ওই হামলায় প্রায় দুই শ’ ব্যক্তি নিহত হয়। সর্বশেষ হামলাটি সংঘটিত হয়েছে গত মাসে এবং আজও সেই হামলা চলছে। এই নারকীয় হামলায় আনুমানিক দেড় শ’ রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত হয় এবং ১২শ’ মুসলিম বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্মী সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িঘরে গিয়ে তল্লাশি চালায়। ভীত সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গারা পড়ে উভয় সংকটে। তাদের বিপদ হলো ‘পানিতে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ’। তারা এখন উদ্বাস্তু। দেশে ফিরে গেলে সাক্ষাৎ মৃত্যু, আর বাংলাদেশে এলে বাংলাদেশের সীমান্ত প্রহরী অর্থাৎ বিজিবি তাদেরকে ঠেলে পাঠাচ্ছে বার্মায়। আজ তারা না ঘরকা, না ঘাটকা। তাই শ’ শ’ নয়, হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান এখন পানিতে ভাসমান। নাফ নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে এসব রোহিঙ্গাবাহী নৌকা। তারা জানে না তাদের গন্তব্য কোথায়। এই অনিশ্চিত যাত্রায় কেউ কেউ পাড়ি জমাচ্ছে গণচীনের দিকে, আবার কেউ পাড়ি জমাচ্ছে মালয়েশিয়ার দিকে। চীনের সাথে বার্মার কোনো সীমান্ত নেই। তারপরেও প্রতিবেশী ভারতের বিশাল ভূখ- পার হয়ে এক ফোঁটা আশ্রয়ের সন্ধানে রোহিঙ্গারা চীনে যাচ্ছে। সর্বশেষ খবর মোতাবেক, চীন ইতোমধ্যেই তিন হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। আরো শরণার্থীকে তারা আশ্রয় দেবে বলে বলা হয়েছে। মালয়েশিয়াও এই বিপন্ন মানবতাকে আশ্রয় দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই ভয়াবহ দুর্দিনে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না। বরং বাংলাদেশে তাদের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। জীবন ভয়ে ভীত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গ্রেফতার করছে এবং আটক ব্যক্তিদেরকে মিয়ানমারে পুশ ব্যাক করছে।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়াবার মতো বিশ্বের কেউ নেই। পাশ্চাত্য দুনিয়া বৌদ্ধ সেনা এবং রাখাইনদের ভয়াবহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে লিপ সার্ভিস দিচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এবং বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেছেন, এটি একটি মানবিক সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করতে হবে মিয়ানমারকেই। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরে খ্রিস্টানদের ওপর জুলুমের অভিযোগ উঠেছিলো। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়া এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এবং পূর্ব তিমুরকে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র বানিয়ে দেয়। সুদানের দক্ষিণ অঞ্চলে খ্রিস্টানদের ওপর অবিচার ও জুলুমের অভিযোগ ওঠে। তখন পশ্চিমা দুনিয়া দক্ষিণ সুদানকে মূল সুদান থেকে আলাদা করে খ্রিস্টানদের জন্য স্বাধীন দক্ষিণ সুদানের জন্ম দেয়। কিন্তু মুসলমানরা যেখানে নির্যাতিত হচ্ছে, সেখানে এই পশ্চিমা দেশসমূহের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর এবং রাখাইন প্রদেশ বা আরাকান রাজ্য তার জ্বলন্ত প্রমাণ। অথচ আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপরে শুধু পশ্চিমা দুনিয়াই নয়, জাতিসংঘ এবং ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনও নির্বিকার। অং সান সূচী মিয়ানমারের ডিফাক্টো প্রেসিডেন্ট। রোহিঙ্গাদের এত বড় মানবিক বিপর্যয়েও তিনি নির্বিকার। বরং ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় সাক্ষাৎদানের পর সাংবাদিক মিশেল হোসেন সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে, তিনি যদি জানতেন যে ঐ সাংবাদিক মুসলমান তাহলে তিনি তাকে সাক্ষাৎকার দিতেন না। এমন একজন মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি শান্তির নোবেল প্রাইজ কতদিন ধারণ করবেন সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার নোবেল প্রাইজ প্রত্যাহার করার জন্য লক্ষাধিক ব্যক্তি লিখিত দরখাস্ত করে নরওয়ে নোবেল কমিটির নিকট আবেদন জানিয়েছে। বাংলা-বার্মা সীমান্ত আজ যেভাবে সীল করা হয়েছে অতীতে এরকম সীল করা ছিলো না। এই মানবিক বিপর্যয়ে সাময়িকভাবে হলেও সীমান্ত খুলে দিতে হবে। তবে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বিশ্ব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। অবিলম্বে সমস্ত নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, তাদেরকে বর্মী নাগরিকত্ব ফেরত দিতে হবে। সেই সাথে সব রকমের নাগরিক অধিকার এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ফেরত দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Md.Anam bin A.Hamid ২৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:৪৯ এএম says : 0
جزاك الله
Total Reply(0)
৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১০:০১ এএম says : 0
আমি বলতে চাই. রোহিঙ্গা মুসলমাদের বাংলাদেশে আসার জন্য. শিমানত খুলেদেয়া হক....
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন