শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বাজেটের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৭ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই, সর্বত্রই দুঃসংবাদ। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে জনজীবন চিড়েচ্যাপ্টে। এ বছর দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া হলেও পাওয়া যাচ্ছে, আগামীতে টাকা থাকলেও পাওয়া যাবে না। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা রয়েছে বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে জাতিসংঘ। এক বছরে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। সামনে এক ভয়াবহ দুর্বিষহ সময় অপেক্ষা করছে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সরকারের পক্ষ থেকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন বাণিজ্যমন্ত্রীসহ খোদ প্রধানমন্ত্রী। এমনই এক পরিস্থিতিতে ৯ জুন ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে বাজেট ঘোষণা করছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্ধারণই বাজেটের একমাত্র লক্ষ্য নয়। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, স্থূল জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা, আমদানি-রফতানি প্রবৃদ্ধি, মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা, সুষ্ঠু রাজস্ব নীতি ও কর্মসংস্থানসহ আরও লক্ষ্য বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্জিত হয়। বাজেট প্রণয়নে কোন লক্ষ্যমাত্রার ওপরে বেশি-কম জোর দিতে হবে, তা নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। এটি মূলত একটি রাজনৈতিক দলিল। বাজেটের সব আয়-ব্যয়ের সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক তাৎপর্যের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে।

বাজেটের পরিমাণ ও পরিণাম যা-ই হোক না কেন, রাজনীতিবিদরা বাজেট নিয়ে রাজনীতি করবেন- এটিই প্রচলিত রেওয়াজ। বিরোধী দল বাজেটের দুর্বলতা নিয়ে হইচই আর সরকারি দল বাজেটের আকার বা সবলতা নিয়ে গর্ব করে-এটিই স্বাভাবিক। লক্ষণীয় বিষয় হলো, স্বাধীনতার পর থেকেই বাজেট ক্রমবর্ধমান এবং প্রতিবছরই অর্থ মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী এটি সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করে। মন্ত্রণালয়গুলোর বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা, অর্থসংস্থান বা বরাদ্দের গুণগতমান বিবেচনা না করেই বছর বছর বাজেটের আকার বড় করাই রাজনীতির অংশ বলে অনেকে মনে করেন। নতুন বাজেট বাংলাদেশের ৫২তম। সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে চতুর্থ- যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই মূল চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। তা চলতি অর্থবছর ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে এটি অনেকটাই বৈশি^ক বাজারনির্ভর। আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের চেয়ে এটি ৪৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আয় তেমন বাড়ছে না। তাই সরকারের ঋণের পাল্লা ভারী হচ্ছে দিন দিন। তা ভবিষ্যত অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। মহামারীকালে সারাবিশ্বের মতো আমাদেরও স্বাস্থ্য খাতের হতাশাজনক দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্য খাতে জনবলে পিছিয়ে বাংলাদেশ। শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি খরচ জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। বরাবরের মতো আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরে গবেষণায় একটি টাকাও খরচ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যসেবার পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার সূচক অনুযায়ী সেবার আওতায় আছে। আর ৪৯ শতাংশ মানুষ মানসম্পন্ন সেবা পায় না। ভাবনার বিষয় হলো, আমাদের গড় আয়ু ৭৪ বছর হলেও সুস্থ আয়ু ৬৪ বছর। শেষের ১০ বছর মানুষ নানা ব্যধিতে ভুগতে থাকে। ফলে ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয় যেমন বেড়েছে আবার তাদের সেবা থেকেও দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধিই নয়, সঠিক বাস্তবায়ন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। গত দ্্্্্ইু বছরে যেসব খাতে সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম এবং এ ক্ষতি অপূরণীয়। যেখানে প্রতিবছর শিক্ষার্থী বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। সেখানে সরকারি তথ্যমতে, ২০২১ সালে প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থী কমেছে ১৪ লাখ ৬১ হাজার। ঝরে পড়ার হার ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। তা ২০২০ সালে ছিল ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ। মহামারীকালে পরীক্ষা না হওয়ায় ঝরে পড়ার হার কম দেখাতে পারে। ২০২২ সালের তথ্য এলে এই হার বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে ও শিখন ঘাটতি পূরণ করতে একটি পরিকল্পনা করতে হবে। তাই শিক্ষা খাত বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার। নতুন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো-ব্যক্তিসত্তার বিকাশ। মনে রাখতে হবে, আজকে যারা প্রতিভাবান তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান। জ্ঞান তথা শিক্ষা ও গবেষণাই উন্নয়ন। তাই গবেষণায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি আমাদের শত বৈরিতার মধ্যে একমাত্র নির্ভরযোগ্য খাত। এখনো বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ গ্রামীণ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। বাংলাদেশ শ্রমশক্তির হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪১ শতাংশই কৃষিতে নিয়োজিত। তাই কৃষকদের কথা ভেবে কৃষিবান্ধব বাজেট হবে- এটিই সবার প্রত্যাশা। নতুন বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। তা চলতি অর্থবছরে ছিল ২৪ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে হবে না-বিপণন দুর্বলতা ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

দুই বছরে মহামারীর কারণে দরিদ্র বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি। ফলে তাদের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। দরিদ্র মানুষের কথা চিন্তা করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা তথা সঠিক সুবিধাভোগী বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সরকার ২০১৫ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে ২০২৫ সালের মধ্যে সব দরিদ্রকে সুরক্ষার আওতায় আনতে সুরক্ষা কৌশলপত্র ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন বাজেটে ভাতাভোগী বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আসন্ন অর্থবছরে আরও ১০০ উপজেলায় ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত বয়স্ক, বিধবাদের ভাতার আওতায় আনা হচ্ছে। তা বর্তমানে ২৬২টি উপজেলায় দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের আওতা ও ভাতা বাড়ানো হচ্ছে। আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বরাদ্দ বেড়েছে ৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। তবে এই বরাদ্দ জিডিপির হিস্যায় কমেছে। এটি জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। উন্নত বিশে^ তা ২০-২৫ শতাংশের মতো। আবার এ খাতের বরাদ্দ বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে এতো স্বল্পভাতা দিয়ে কখনই দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। দারিদ্র্য নিরসনে সবচেয়ে কার্যকর কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যথাযথ বরাদ্দ ও তা বাস্তবায়ন করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্য পরাভূত করা সম্ভব।

টাকার অভাবে সরকার অনেক দরিদ্র মানুষের ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে না। অথচ বরাদ্দের আড়ালে অপচয়ের অর্থের অভাব হয় না। বহু পুরাতন একটি প্রবাদ অছে, ‘সরকার কি মাল দরিয়া মে ডাল।’ এ থেকেই বোঝা যায়, সরকারি অর্থ অপচয় মোটেও অভিনব নয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে কৌটিল্য সরকারি অর্থ অপচয় ও আত্মসাৎকারীদের মৃত্যুদন্ড প্রদানে পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের সম্পদ হেফাজতে কৌটিল্য সবচেয়ে জোর দিয়েছেন হিসাব নিরীক্ষার ওপর। তবে নিরীক্ষায় সরকারি অপচয়ের সামান্যই ধরা পড়ে। অসাধু লোকজন যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও আইনের মধ্য থেকেই অপচয় করে বলেই নিরীক্ষায় তা অপচয় হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। আইনগত ও অর্থনৈতিক অপচয় রোধে নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত, সাহসী কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তা ছাড়া কোনোভাবেই জনগণের অর্থ অপচয় রোধ করা সম্ভব নয়। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ওই বাজেটের চেয়ে বাজারমূল্যে আগামী অর্থবছরের বাজেট ৮৬২ গুণ বড়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গাণিতিকভাবে এ তথ্য সঠিক মনে হলেও এটি বাজারমূল্যে তুলনা করা যাবে না।

মনে রাখতে হবে, ৫০ বছরে বাজারমূল্যের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেট ছিল তখনকার মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ সালের বাজেট মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৫০ বছরে বাজেট জিডিপির হিস্যা হিসাবে বৃদ্ধি পায়নি, বরং কমেছে। কাজেই বাজেটের আকারে আমাদের আনন্দিত হওয়া বা কৃতিত্ব নেওয়ার কিছু নেই। বাজেটের সংখ্যাকে বিচার-বিশ্লেষণ করে মূল্যায়ন করতে হবে। এভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, বাস্তবায়ন অযোগ্য, ঘাটতি বাজেট করা ঠিক নয়। বাজেটের ব্যয় প্রস্তাব অনুমোদনের আগে আয়ের ব্যবস্থা প্রয়োজন। আর এর প্রথম ধাপ হলো রাজস্বপ্রাপ্তি প্রাক্কলন। তাই ধীরে ধীরে করের আওতা বাড়িয়ে আয় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে যত আয়করযোগ্য মানুষ আছে, তার ২০ শতাংশও আয়কর দেয় না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন সাধন করতে হবে। যথাযথ কর প্রদান করে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে।

লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন